• এটি আদৌ শিল্পকর্ম কি না, এই নিয়েও কিছু বাৎচিত হয়েছে
  • আনুমানিক বিক্রয় মূল্যের চেয়ে প্রায় ৪০গুণ বেশি দামে বিক্রি হল
  • গত ৫০০ বৎসর সময়কালে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা ১৫ হাজার পোর্ট্রেট কম্পিউটারকে দেখানো হয়

এই অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে অকশন হাউজ ক্রিসটিজ নিউ ইয়র্কে একটি বিশেষ শিল্পকর্ম নিলামে তুলেছিল, বিক্রি হয়েছে প্রায় অর্ধ লক্ষ মিলিয়ন ডলারে।

দাম খুব অবাক করা কিছু নয়, এরকম দামে চিত্রকর্ম বিক্রি হয়; যদিও ঐ শিল্পকর্মটির বেলায়, নিলামের পূর্বে ধার্যকৃত আনুমানিক বিক্রয় মূল্যের চেয়ে প্রায় ৪০গুণ বেশি দামে বিক্রি হল। ক্রেতা নিজের নাম প্রকাশ করতে চান নি।

নিলামে এই শিল্পকর্মটি বিক্রি হওয়াই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

নাম ‘Portrait of Edmond de Belamy’, চিত্রকর্মটি অসম্পূর্ণ বলে মনে হয়, ক্যানভাসে কিছু অংশে রঙ পড়ে নি, পোর্ট্রেটের মুখমণ্ডল অস্পষ্ট, এবং ছবিটি যেন ক্যানভাসের একপাশে পড়ে গেছে। অনেকে এটিকে চিত্রকর্ম হিসেবে কুৎসিতও বলেছেন।

এটি আদৌ শিল্পকর্ম কি না, এই নিয়েও কিছু বাৎচিত হয়েছে। কারণ, এটি কোনো মানুষের নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আঁকা ছবি।

শিল্পীর স্বাক্ষরের জায়গাটি চমকপ্রদ, এলগোরিদম তার কোডের অংশ লিখে স্বাক্ষর করেছে min max Ex[log(D(x))] + Ez[log(1-D(G(z)))]।

প্যারিসের শিল্প উৎসাহী তিন বন্ধু, প্রত্যেকেই পঁচিশ বছর বয়সী, ‘অবভিয়াস’ নাম নিয়ে দলবদ্ধ হয়েছেন। তারা আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সকে দিয়ে ‘ফ্যামিলি অব বেলামি’ নামের শিল্পকর্ম সিরিজ সৃষ্টি করিয়েছেন। এ বছরের শুরুতে একজন ফরাসি চিত্র সংগ্রাহক প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ডলার দিয়ে এই বেলামি পরিবার সিরিজের একটি চিত্রকর্ম নিলাম ছাড়া অবভিয়াস এর কাছ থেকে সরাসরি কিনে নেন। সেই সংবাদে উৎসাহিত হয়ে নিলাম হাউজ ক্রিস্টিজ এই ‘পোর্ট্রেট অব এডমন্ড বেলামি’ ছবিটি নিলামে ওঠায়। তাদের প্রাথমিক ধারণা ছিল, নিলামে এর দাম সাত থেকে দশ হাজার পাওয়া যেতে পারে। দামের চেয়ে, মূল আকর্ষণ ছিল, ইতিহাসে প্রথমবারের মত এআই চিত্রকর্ম নিলাম করা।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আঁকা শিল্পকর্ম

নতুন প্রযুক্তির, নতুন কিছুর মুখোমুখি হওয়ার বেলায় সমাজের প্রতিক্রিয়া বেশ উপভোগ্য বটে, এ সংক্রান্ত কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম লক্ষ্য করি:

১. This AI-generated portrait just sold for a stunning $432500 (CBS News)
২. This Ugly Painting Made by a Robot Just Sold for $432,500 (Observer)
৩. AI Art at Christie’s Sells for $432,500 (NY Times)
৪. ‘Behold the future’: Portrait painted by an AI sells for $432,000 at Christie’s auction (despite only being expected to make $10,000) (Daily Mail)

দেখা যাচ্ছে, মেজর মিডিয়াগুলিতেও যার যার মত করে জেনারেটেড, মেইড, বলার প্রবণতা রয়ে গেছে। সবাই এখনও পেইন্টেড বলার অবস্থায় আসে নাই!

যা কিছু নতুন, তা নিয়ে দ্বিধা ও সংশয়, এবং কৌতূহল থাকেই। এআই আর্টকে আদৌ ‘আর্ট’ বলা যায় কি না, এই আর্ট টিকবে কি না, আমরা কোনো এ আই মাস্টারপিসের দেখা পেতে পারি কি না, এসব নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে।

নিলাম হাউজ ক্রিস্টিজ এর সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধান রিচার্ড লয়েড মনে করেন, শিল্পচর্চায় মানুষের পাশাপাশি আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্ট আর্টিস্টও থাকবেন। উনি স্মরণ করিয়ে দেন, অনলাইন পত্রিকা আসায় প্রিন্ট পত্রিকা হারিয়ে যায় নি, যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে বটে, তবে যোগ্যরা পরিস্থিতির সাথে সমন্বয় করে টিকে আছে।

এই শিল্প সৃষ্টিতে অবভিয়াস আনসুপারভাইজড মেশিন লার্নিং এর জন্যে ব্যবহৃত এক এলগোরিদম GAN (generative adversarial network) ব্যবহার করেছেন। গ্যান (GAN) নিয়ে শিল্পীদের কাজ করার কথা জানা যায় ২০১৫ থেকে। বিভিন্ন সময় কয়েকজন গ্যান আর্টের জন্যে মিডিয়ায় উল্লেখিত হয়েছেন।

এই শিল্পসৃষ্টির প্রক্রিয়া, অর্থাৎ, জেনারেটিভ এডভারস্যারিয়াল নেটওয়ার্ক অ্যালগোরিদম দিয়ে কীভাবে এই শিল্প সৃষ্টি হল, তা সহজবোদ্ধ করে এভাবে বলা যায় যে, গত পাঁচশত বৎসর সময়কালে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা পনের হাজার পোর্ট্রেট কম্পিউটারকে দেখানো হয়, এ থেকে গ্যান পোর্ট্রেট কী, তা ‘শিখে’। এরপর সে নিজে পোর্ট্রেট  আঁকতে উদ্যত হয়, অ্যালগোরিদম তখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করে, জেনারেটর অংশ তার কল্পিত একটি পোর্ট্রেট প্রস্তাব করে, ডিসক্রিমিনেটর অংশ তা ফিড করা কোন ইমেজের কপি মনে হচ্ছে, তা যাচাই করে এবং পরামর্শ দেয়। এই প্রক্রিয়ার শুরুতে প্রস্তাবিত ইমেজগুলি অ্যালগোরিদমকে দেখানো ইমেজের মত হয়, ডিসক্রিমিনেটর সেটাকে বাছতে বাছতে এক পর্যায়ে, দেখানো ইমেজ ও প্রস্তাবিত ইমেজ আলাদা করতে অসমর্থ অবস্থায় পৌঁছলে, সেটি এই অ্যালগোরিদমের সৃষ্ট শিল্পকর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

এর ফলে, শিল্প সৃষ্টির কৃতিত্ব কার, এই প্রশ্নের জবাবে অ্যালগোরিদমের কৃতিত্ব কেড়ে নেয়া, খুব সহজ নয়।

বিক্রির পরে, এর সৃষ্টিতে যে এলগোরিদম ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক ওঠে। রবি ব্যার‍্যাট নামে এক শিল্পী গ্যান আর্টের জন্যে আগেই নাম কুড়িয়েছেন। তার সুররিয়্যাল ন্যুড ও ল্যান্ডস্কেইপ বিভিন্ন সময় সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। উনি দাবি করেন, উনি এলগোরিদমের কোড অনলাইনে শেয়ার করেছিলেন, সেটা ব্যবহার করে অবভিয়াস এই শিল্পকর্মগুলি সৃষ্টি করেছে। তবে, অবভিয়াস তা অস্বীকার করে বলেছে, তারা রবি ব্যার‍্যাটের কোড নিয়ে সেটা মডিফাই করে নিয়ে কাজে লাগিয়েছে।

অবভিয়াসের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের দৃষ্টান্ত বরং ভাল। এই গ্যান এলগোরিদম প্রথমে ডিজাইন করেন ইয়ান গুডফেলো, ইয়ান তখন ছিলেন মাত্র ২৯ বছর বয়সী, পিএইচডি স্বীকৃতির অপেক্ষমান, এখন ইয়ান গুগল ব্রেইনে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে নিয়োজিত আছেন। ওপেন এআই-তেও ইয়ান জড়িত। অবভিয়াস যে চিত্রকর্মগুলির সিরিজের নাম বেলামি রেখেছে, এটা আসলে ইয়ানের প্রতি এক প্রকারের ঋণ স্বীকার। গুড ফেলো থেকে গুড ফ্রেন্ড, যার ফ্রেঞ্চ অনুবাদ “বেল আমি”, এ থেকে বেলামি।

ইয়ান গুডফেলো গ্যান ডিজাইন করেন, ২৯ বছর বয়সে। রবি ব্যার‍্যাট চিত্রকর্ম সৃষ্টির জন্যে তার গ্যান অ্যালগোরিদম কাস্টমাইজড করেন ১৯ বছর বয়সে। অবভিয়াসের তিনজনেরই বয়স ২৫ বছর। দেখা যাচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর শিল্পকর্ম প্রথমবারের মত নিলামে বিক্রি হওয়ার ইতিহাস সৃষ্টিতে যাদের অবদান, তারা সবাই বয়সে টগবগে তরুণ!

আনসুপারভাইজড মেশিন লার্নিং এ ব্যবহৃত এই অ্যালগোরিদম এআই আর্ট নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেও, গ্যান ব্যবহার করে কেউ কেউ গান করলেও, কর্পোরেটের কাজেই এর মূল প্রয়োগ, এবং, মেশিন লার্নিং এর ক্ষেত্রে অনেক বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে। মেশিন লার্নিং, হল মেশিনের নিজে নিজে শেখা, একজন মানুষ তাকে শেখানো-চালানোর প্রয়োজন নাই হয়ে যাওয়া, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য।

ইয়েজ, দ্যাট আলটিমেট জার্নি হ্যাজ অলরেডি বিগান!