পাথরটির চারদিক সাদা রঙের। মাঝখানে গাঢ় লাল। দেখতে জেলি ডোনাটের মত।

নাসার বিজ্ঞানী ড. স্টিভেন স্কিয়ার্স সংশয় জানিয়েছেন, “এরকম জিনিস আমরা আগে কখনো দেখি নি। এটায় সালফারের পরিমাণ অনেক বেশি, ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি। আর আমাদের দেখা মঙ্গল গ্রহের কোনো জিনিসের চাইতে এটায় দ্বিগুণ ম্যাঙ্গানিজ। তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণ। আমরা জানি না এর অর্থ কী! আমরা সবাই সংশয়ে রয়েছি।”

শিল্পীর ছবিতে মঙ্গলের পৃষ্ঠে নাসা মার্স এক্সপ্লোরেশন রোভার। এই রোভারের যমজ সংস্করণ, ‘স্পিরিট’  এবং  ‘অপরচুনিটি’, ২০০৩ সালে যাত্রা শুরু করে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে মঙ্গলে পৌঁছায়।

নাসার বিজ্ঞানীদের সংশয়ের কারণ মঙ্গল গ্রহ অনুসন্ধানকারী রোবট অপরচুনিটি রোভারের পাঠানো একটি অবিশ্বাস্য ছবি। অপরচুনিটি ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিত মঙ্গলপৃষ্ঠের ছবি পাঠিয়ে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ৮ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখে পাঠানো ছবিতে একটি অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। আগের ছবিতে নির্দিষ্ট একটি পাথর ছিল না, পরের ছবিতে সে পাথরটি হাজির হয়েছে। পাথর কোত্থেকে কীভাবে এল তা নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা।

পরিষ্কার জানা না গেলেও পাথরের উপস্থিতি অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন অপরচুনিটি রোভার প্রজেক্টের প্রধান পর্যবেক্ষক স্টিভেন ডব্লিউ স্কিয়ার্স।

নাসার গবেষকরা পাথরের নাম দিয়েছেন ‘পিনাকল আইল্যান্ড’।

২.
অপরচুনিটি প্রায় ১৪ মাইল প্রস্থের একটি গিরিখাতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। এ জায়গার পাথরে লৌহ-আকরিক বেশি। আর্দ্র পরিবেশে এ ধরনের লোহাসমৃদ্ধ আকরিক থাকার কথা। যেটা ভূতাত্ত্বিক বিবেচনায় মঙ্গল সম্পর্কে একটি বিস্ময়কর তথ্য।

ড. স্টিভেন ডব্লিউ স্কিয়ার্স

অপরচুনিটি মঙ্গলের যে পরিবেশে এতদিন অনুসন্ধান চালিয়েছে সে এলাকায় বেশি অম্ল ছিল। রোবটটির বর্তমান অনুসন্ধানের এলাকা আগের তুলনায় কম অম্লীয়। সুতরাং ধারণা করা যেতে পারে মঙ্গলের আগের পরিবেশ হয়তো এখনকার তুলনায় প্রাণের বিকাশের উপযোগী ছিল।

স্কিয়ার্স বলেছেন পাথরটি এই জায়গায় দেখা যাওয়ার ব্যাপারে তার টিমের দুটি থিওরি আছে। পাথরটি দুইভাবে আসতে পারে। এক, রোভার চলার সময় এটিকে আগের অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে পারে; দুই, উল্কাপাতের কারণে সেটি মঙ্গলের বাহির থেকে এসেও রোভারের ডান পাশের সামনে পড়তে পারে। যদিও দ্বিতীয়টি ঘটার সম্ভাবনা খুব কম।

৩.
২০০৪ সালে অপরচুনিটি রোভারকে যখন মঙ্গল গ্রহে পাঠানো হয় তখন এই প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল তিন মাস।

বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী এর সোলার প্যানেলে ধূলার আস্তরণ পড়ে এবং ব্যাটারি ক্ষয়ে অপরচুনিটির পক্ষে তিনমাস সচল থাকা সম্ভব। তবে অপ্রত্যাশিতভাবে মঙ্গলের বায়ুপ্রবাহ অপরচুনিটির সোলার প্যানেল থেকে ধূলা সরিয়ে দেয়ার কারণে প্রায় এক দশক ধরে এই রোবটটি মঙ্গলে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে পারছে।

যেখানে ১ কিলোমিটার অনুসন্ধানের কথা ছিল, অপরচুনিটি সেখানে প্রায় ৩৮.৭ কিলোমিটার অনুসন্ধান করেছে এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ছবি পাঠিয়েছে।

প্রতি বছর ১৪ মিলিয়ন ডলার খরচ হয় অপরচুনিটি রোভারের পিছনে। সাম্প্রতিক নাসার বাজেট নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কে অবশ্য মঙ্গল গ্রহ নিয়ে গবেষণার ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছে। টুইটারের মাধ্যমে আসা মানুষের বিভিন্ন বিদ্রুপমিশ্রিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে নাসা কর্তৃপক্ষকে। সেখানে “নাসা কি মঙ্গল গ্রহে পাথর ছুড়তে পারে এমন জীবের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা ভাবছে কিনা” এমন প্রশ্নও ছিল। তবে এই প্রশ্নের উত্তরে স্টিভেন জানান, ভিনগ্রহের প্রাণ অবশ্যই না, তবে মঙ্গলের বাইরের আকাশ থেকে এটা মঙ্গলে পড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

৪.
অপরচুনিটি রোভারের কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। এটার সামনের ডান পাশের চাকাটি ছাড়াও বেশ কিছু যন্ত্রাংশ ঠিকভাবে কাজ করছে না। মেমরি চিপ পুরাতন হবার সাথে সাথে এটা কখনো কখনো নিশ্চল থাকছে। নাসা এই যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো সারানো সম্ভব বলে জানিয়েছে।

প্যানক্যাম দিয়ে তোলা অপরচুনিটির সেলফ পোর্টেট, নিচে রোভারের মাঝামাঝি ছায়া পড়েছে প্যানক্যামের ; ২৩ জানুয়ারি ২০১৪

নাসার এই প্রকল্পের সাথে জড়িত গবেষকরা এই পাথরটিকে “বিশেষ” আবিষ্কার না বলে মঙ্গলে আবিষ্কারের যে ধারাবাহিক সুযোগ তৈরি হয়েছে তার একটি উদাহরণ মনে করেন।

একটা গবেষণার সুযোগকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যায় না, অপরচুনিটির বিজ্ঞানীরা এই পাথরটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যেতে চান। পাথরটি উলটে থাকার কারণে মঙ্গলের কোটি বছরে এই প্রথম পাথরটির নিচের অংশটি স্থানচ্যুত হয়েছে, এটাকে সুযোগ হিসেবেই দেখছেন তারা।

স্কিয়ার্স বলেন, “মঙ্গলের পরিবেশকে যেমন নিথর ভাবা হয় সেটা তেমন নয়, আশে পাশে কোন ধোঁয়ার অস্তিত্ব না থাকায় বাহির থেকে গ্রহাণু ছিটকে আসার সম্ভাবনা কম, আমরাই এটাকে স্থানচ্যুত করেছি।” অবশ্য অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পাথরটির উপস্থিতির কারণ খুঁজে বের করবেন বলে তারা জানান।

৫.
মঙ্গলকে নিকোলাস কোপার্নিকাস একটি গ্রহ হিসেবে শনাক্ত করার অনেক আগে থেকেই এই হাল্কা লাল ধরনের গ্রহটি সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল ছিল। সৌরজগতে সূর্য থেকে দূরত্বের হিসেবে এর অবস্থানের কারণে এখানে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে অনেক রকমের কথাবার্তা থাকলেও বিজ্ঞানীরা ১৯৭৬ সালেই মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব নাই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন।

মঙ্গলের আকার পৃথিবীর তুলনায় ছোট হওয়ার কারণে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের থেকে তুলনামূলক কম সুগঠিত ও পাতলা। পৃথিবীর বায়ুস্তরের থেকে মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলের উপাদানও আলাদা।

তবে এ নিয়ে নতুন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন ভূতত্ত্ববিদেরা। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে মঙ্গলের পূর্বের অবস্থা প্রাণের জন্য সহায়ক ছিল বলেই মনে করেন মঙ্গল গ্রহের ভূতত্ত্ব বিষয়ক গবেষকরা।


অপরচুনিটির মঙ্গল অবতরণের অ্যানিমেশন