বর্তমান সময়ের মাংস খাওয়ার বিরোধী দুই দল ভিগান এবং ভেজিটেরিয়ানদের মাঝে পার্থক্য আছে। ভেজিটেরিয়ানরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি মাংস জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু ভিগানরা মাংস খাওয়া বাদ দেয়া ছাড়াও মাংস থেকে উৎপাদিত যে কোনও ধরনের দ্রব্য ব্যবহার করাই ছেড়ে দেন। অর্থাৎ, ভেজিটেরিয়ানিজম শুধু খাদ্যাভ্যাস, আর ভিগানিজম রীতিমত লাইফস্টাইল।

ভিগানদের মাংস খাওয়ার তীব্র বিরোধিতার সমর্থনে ২০১০ সালের আশেপাশে বিভিন্ন পত্রিকায় নানারকম আর্টিকেল ছাপা হয়। ২০১৬ এর মার্চ মাসে টাইম ম্যাগাজিনের সিনিয়র লেখক জেফরি ক্লুগার আপাত-বিজ্ঞানভিত্তিক সেসব লেখার বিরোধিতা করে একটি লেখা ছাপেন, যার শিরোনাম ছিল : “Sorry Vegans: Here’s How Meat-Eating Made Us Human.”


জেফরি ক্লুগার
টাইম ম্যাগাজিন, ৯ মার্চ ২০১৬
অনুবাদ: আয়মান আসিব স্বাধীন


উদ্ভিদ ভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস আমাদের শরীরের জন্য অবশ্যই ভাল। স্বাস্থ্যকর এই রীতি আমাদের বিপাকে বৈচিত্র‍্য আনে ও দৈহিক সন্তুষ্টি বাড়ায়। এছাড়া এর মাধ্যমে স্পষ্টতই অযাচিতভাবে মানুষের হাতে শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পায় অন্যান্য প্রাণি।

কিন্তু ভিগানিজম যখনই লাইফস্টাইল বা ডায়েটের সীমানা ছাড়িয়ে মতাদর্শে পরিণত হবার চেষ্টা নিয়েছে, তখনই বিজ্ঞানের সাথে সংকটে জড়িয়েছে এর সমর্থকরা। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে কীভাবে মাংস খাওয়া মানুষের জন্য কেবল বর্তমানে না, বরং সবসময়ই ক্ষতিকর ছিল। আমাদের দাঁত, চেহারার আকৃতি ও পরিপাকতন্ত্র নাকি প্রমাণ করে যে মাংস থেকে আহরিত ও উৎপাদিত কোনোকিছু আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর না। পেটা থেকে শুরু করে হাফিংটন পোস্টের বিভিন্ন আর্টিকেলে এরকম নমুনা পাওয়া যায়।

কিন্তু অবাস্তবিক এ দাবির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা পরিষ্কারভাবে বলেছে,  মাংস খাওয়া ও প্রক্রিয়াজাত করা মানুষের কাছে এসেছিল প্রকৃতির নিয়মেই। আদি মানবদের ডায়েটে যদি প্রাণিজাত প্রোটিন না থাকত, তাহলে আমরা হয়ত ঠিকমত মানুষই হতে পারতাম না—অন্তত বর্তমানে যে ধরনের বুদ্ধিমান ও আধুনিক মানুষ আমরা হয়ে উঠেছি তেমনটা তো নয়ই।

প্রায় ২.৬ মিলিয়ন বছর আগে আদি মানবদের ডায়েটে মাংস স্থান পাওয়া শুরু করে। তাদের জন্য তৃণভোজী হয়ে থাকা অবশ্যই সহজ ছিল, কারণ গাছপালা তো আর পালিয়ে যায় না। তবে শাকসবজি ও ফলমূলে অত্যধিক পরিমাণে ক্যালোরিও থাকে না। ফলে এর চাইতে ভাল বিকল্প ছিল মাটির নিচের কন্দজাতীয় উদ্ভিদ—গাজর, বিট, আলু ইত্যাদি। এগুলির পুষ্টিগুণ বেশি। কিন্তু কাঁচা খেলে তেমন একটা স্বাদ পাওয়া যায় না এসব থেকে, তাছাড়া চাবানোও অনেক কষ্ট।

নেচার জার্নালের যে গবেষণাপত্রের কথা বলা হচ্ছে, সেটার লেখক ছিলেন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির দু’জন বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী: ক্যাথরিন জিংক ও ড্যানিয়েল লিবারম্যান। তারা বলেন, কন্দজাতীয় সবজির বদলে মাংস খেয়ে নিজেদের শরীরের অনেক শক্তি সংরক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিল আদি মানবরা। রান্না করার পদ্ধতি মানুষ শিখেছে মাত্র ৫ লক্ষ বছর আগে, আদি মানবদের সেই সুযোগ ছিল না। তাই তারা প্রধানত তিন রকম উপায়ে মাংস প্রক্রিয়াজাত করত—কেঁটে ফালি করে, ছাড়িয়ে ও থেঁতলে। শিকার করা প্রাণীর মাংস এভাবে প্রস্তত করার মাধ্যমে ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাবারের যোগান দিত আমাদের পূর্বপুরুষরা। চাবানোর জন্য কষ্টও অনেক কম করতে হত এই তরিকায়।

ডায়েটের তিন ভাগের একভাগে প্রাণিজাত প্রোটিন ও বাকি দুইভাগে  কন্দজাতীয় উদ্ভিদ রাখার মাধ্যমে যে শক্তি ও সময় বাঁচত, তার ফলেই রাতের খাবারের জন্য আলাদা সময় বের করা সম্ভব হয়েছে। কারণ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়, প্রক্রিয়াজাত করা কন্দজাতীয় সবজির চাইতে মাংস চাবানোর জন্য গড়ে ৩৯% থেকে ৪৬% কম শক্তিপ্রয়োগ করতে হত তাদেরকে।

সব মিলিয়ে এর প্রভাব শুধু সময় ও শ্রম বাঁচানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আমাদের ব্রেইনের পুষ্টি চাহিদা ব্যাপক। কাজেই বড় সাইজের ব্রেইন গড়ে তোলার জন্য যে ক্যালোরি দরকার ছিল, মাংস খেয়ে অনেক কম পরিশ্রমেই তা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া শিকার করা প্রাণির দেহ থেকে সরাসরি খাওয়ার জন্য মাংস দাঁত দিয়ে কামড়াতে ও ছিঁড়তে হত। কিন্তু আমরা যখন মাংস প্রক্রিয়াজাত করা শিখলাম, তখন থেকে আমাদের দাঁত আর চোয়ালও ছোট হয়ে গেল। ফলে আমাদের কাঁধ ও খুলিতে পরিবর্তন আসা শুরু হয়—এতে ব্রেইনের সাইজ বড় হওয়ার সুযোগ পায়, শরীরের তাপের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ে এবং বাকযন্ত্রগুলিরও উন্নতি হয়।

কিন্তু সেই আদিম মানুষদের উত্তরসূরি হিসাবে আমাদেরও বেশি বেশি মাংস খেতে হবে, ব্যাপারটা মোটেও এমন না। আপনার নিয়মিত খাবারের তালিকায় থাকা ভুনা মাংস বা রোস্টের চাইতে বরং ভেগানদের খাদ্যাভ্যাস আপনার স্বাস্থ্য ও পৃথিবীর জলবায়ুর জন্য উপকারি হতে পারে। তবে আজকে আপনি মাংস না খেয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বলে আপনার জিন এবং ইতিহাসও যে একই রকম সিদ্ধান্ত দিবে, তা কিন্তু না।