জাপানের সাইতামা প্রদেশের ইয়াশিও শহরে বিশাল সিংকহোলে পড়ে যাওয়া ট্রাকচালককে উদ্ধারের জন্য তৃতীয় দিনের মত অভিযান চলছে। ৭৪ বছর বয়সী ওই চালক গত মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) সকালে দুই টনের ট্রাকসহ সিংকহোলে তলিয়ে যান। শুরুতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও পরে তিনি কোনো সাড়া দেন নাই, যেটা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
কীভাবে সৃষ্টি হল এই সিংকহোল?
দ্য জাপান টাইমস জানায়, সিংকহোলটি মূলত ১০ মিটার গভীরে থাকা একটা পুরোনো পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের ক্ষয়ের ফলে তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে মাটি ও বালির চাপে পাইপ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, ফলে এটি ভেঙে যায় এবং আশপাশের মাটি ধসে পড়ে।
সাম্প্রতিক ডেস্ক
সূত্র: মেইনিচি শিমবুন, ইয়োমিউরি শিমবুন, আসাহি শিমবুন, দ্য জাপান টাইমস, এনএইচকে ও দ্য গার্ডিয়ান
৩০ জানুয়ারি, ২০২৫
ইয়াশিও শহরটি সাইতামা প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩ মিটার উচ্চতায় রয়েছে। এমন নিচু এলাকায় সাধারণত মাটির নিচে পানি জমার প্রবণতা বেশি থাকে, যা মাটিকে নরম ও দুর্বল করে তুলতে পারে। যদি সেখানে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত না হয় বা ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে মাটি ধসে গিয়ে সিংকহোল তৈরি হতে পারে।

এই ধরনের নিচু এলাকায় পানি জমে থাকা, মাটির স্তরে ফাঁকা স্থান তৈরি হওয়া এবং দুর্বল অবকাঠামো সিংকহোল তৈরির ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। ইয়াশিও শহরের সিংকহোলের ঘটনায়ও এর প্রভাব থাকতে পারে, তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে হয়ত তা আরও পরিষ্কার হবে।
সিংকহোল কী?
সিংকহোল এমন একটি গর্ত বা নিম্নভূমি, যা মাটির উপরিভাগ ধসে পড়ার ফলে তৈরি হয়। সহজভাবে বললে, এটি এমন স্থান যেখানে মাটির নিচে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয় এবং একসময় ওপরের মাটি হঠাৎ করে ধসে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের গর্ত ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়, আবার কখনও হঠাৎ করেই মাটির উপরিভাগ ভেঙে পড়ে বিশাল গর্তের সৃষ্টি করে।
অনেক সময় সিংকহোলকে ডোলাইন (doline) বা শেকহোল (shakehole) বলা হয়। এগুলি সাধারণত নিচু এলাকার চৌবাচ্চার মত দেখতে হয়। কিছু সিংকহোল এমন জায়গায় তৈরি হয়, যেখানে ওপরের পানি সরাসরি মাটির নিচে চলে যায়। এ ধরনের সিংকহোলকে পোনর (ponor), সোয়ালো হোল (swallow hole) বা সোয়ালেট (swallet) বলা হয়।
সিনোটে (cenote) আরেক ধরনের বিশেষ সিংকহোল, যা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে উন্মুক্ত করে। সাধারণত মেক্সিকোতে প্রচুর সিনোটে দেখা যায়, যেখানে মানুষ সাঁতার কাটতে বা ডাইভিং করতে যায়। এটি আসলে সিংকহোলের এমন একটা রূপ, যেখানে মাটির স্তর ধসে পড়ার পর নিচে স্বচ্ছ পানি দেখা যায়।
সিংকহোল তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ কার্স্ট (karst) প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় বৃষ্টির পানি চুনাপাথরের মত কার্বনেট শিলাকে ধীরে ধীরে গলিয়ে ফেলে, যার ফলে ভূগর্ভস্থ ফাঁকা স্থান তৈরি হয়। একসময় ওপরের মাটির স্তর ভারসাম্য রাখতে না পেরে ধসে পড়ে এবং সিংকহোল সৃষ্টি হয়। কিছু সিংকহোল ধীরে ধীরে তৈরি হয়, আবার কিছু মুহূর্তের মধ্যেই সৃষ্টি হতে পারে।
সিংকহোল সাধারণত গোলাকার হয় এবং এর ব্যাস ও গভীরতা কয়েক মিটার থেকে কয়েক শ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। কিছু সিংকহোল মাটির স্তর দিয়ে আবৃত থাকে, আবার কিছু পাথরের কিনারাযুক্ত গভীর খাদে পরিণত হয়।
বিশ্বের নানা জায়গায় সিংকহোল দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, ২০১০ সালে গুয়াতেমালায় একটি বিশাল সিংকহোল তৈরি হয়েছিল, যেখানে একটি পুরো ভবনসহ রাস্তা গর্তে তলিয়ে গিয়েছিল! এটি প্রমাণ করে যে সিংকহোল কখনও কখনও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এবং বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করতে পারে।
সূত্র: উইকিপিডিয়া
তদন্ত কমিশন
সাইতামা প্রদেশের ইয়াশিও শহরে সিংকহোল তৈরির কারণ অনুসন্ধানে স্থানীয় প্রশাসন একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে জানা গেছে, ১০ মিটার গভীরে থাকা একটি পুরোনো পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের ক্ষয়ের ফলে প্রথম সিংকহোলটি সৃষ্টি হয়েছে। পরে, আশপাশের এলাকায় জমে থাকা বর্জ্য ও পানির লিক মাটিকে আরও আলগা করে দেয়, যার ফলে দ্বিতীয় সিংকহোলের সৃষ্টি হয়। তদন্ত কমিশন এই ঘটনার বিস্তারিত কারণ, অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ঘাটতি ছিল কিনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে কাজ করছে।
উল্লেখ্য, ট্রাকচালকের নাম এখনও প্রকাশ করা হয় নাই। জাপানের সংবাদমাধ্যমগুলি তার পরিচয় গোপন রেখেছে। এটি জাপানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার প্রচলিত নীতির অংশ, বিশেষ করে যখন তদন্ত চলমান থাকে বা পরিবারের সম্মতি না পাওয়া যায়।
উদ্ধার অভিযানের চ্যালেঞ্জ
উদ্ধারকর্মীরা প্রথম থেকেই নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে। আসাহি শিমবুন জানায়, গর্তের চারপাশের মাটি অত্যন্ত নরম হয়ে যাওয়ায় উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া, ভূগর্ভস্থ গ্যাস পাইপের সম্ভাব্য ঝুঁকি ও পানির লিক উদ্ধারকর্মীদের সতর্ক থাকতে বাধ্য করছে।
বুধবার ভোরে দ্বিতীয় সিংকহোল ধসে পড়ার পর উদ্ধার কাজ সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখতে হয়। দ্য গার্ডিয়ান প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, উদ্ধারকর্মীরা নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছেন, কারণ একটি রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড ও একটি টেলিগ্রাফের খুঁটি নতুন সিংকহোলে তলিয়ে যায়।
পানি নিয়ন্ত্রণ ও বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া
জাপান টুডে জানায়, স্থানীয় প্রশাসন সিংকহোলগুলির বিস্তার ঠেকাতে কাছের একটি নদীতে বর্জ্য পানি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই পানি ক্লোরিন দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হলেও, এটি পরিবেশগত উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এদিকে, আসাহি শিমবুন জানায়, ভূগর্ভস্থ গ্যাস পাইপের ঝুঁকির কারণে ঘটনাস্থলের ২০০ মিটারের মধ্যে থাকা বাসিন্দাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়েছে। প্রায় ১২ লাখ মানুষকে পানি কম ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অনেক বাসিন্দাকে রাত কাটাতে হয়েছে পৌর অফিস ও অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রে।
এক স্থানীয় বাসিন্দা ইয়োমিউরি শিমবুন‘কে বলেছেন, “আমি কখনও ভাবি নাই যে সিংকহোল এত বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে!” আরেকজন বলেন, “যদি আমার বাড়ির কাছেও সিংকহোল তৈরি হয়! হয়ত কিছুদিন বাড়ি ফিরতে পারব না।”
আটকে পড়া চালকের অবস্থা
প্রথম দিকে চালকের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হলেও, দ্য জাপান টাইমস জানায়, বুধবার সকালে তিনি কোনো সাড়া দেননি।
আসাহি শিমবুন জানায়, বুধবার সকালে গর্তে পানি জমতে শুরু করে, যা ধীরে ধীরে ট্রাকের চালকের আসন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এখন পর্যন্ত তার অবস্থা জানা যায় নাই, যা উদ্ধারকর্মী ও স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
পরবর্তী পদক্ষেপ ও প্রশাসনের সতর্কতা
সাইতামা প্রদেশের গভর্নর মোতোহিরো ওনো জানিয়েছেন, “সিংকহোল আরও বড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।” (সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান )
উদ্ধারকর্মীরা মাটি স্থিতিশীল করার জন্য কংক্রিট ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করছেন, যাতে নিরাপদে নিচে নামা যায়। তবে, এনএইচকে জানায়, মাটির নরম অবস্থা ও পানির লিকের কারণে কাজটি অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।
জাপানি ঐতিহ্যবাহী দৈনিক মেইনিচি শিমবুন জানায়, পয়ঃনিষ্কাশন পাইপ কবে ঠিক হবে, সে সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হয়নি। উদ্ধার অভিযান যতই এগোচ্ছে, ততই এটি আরও জটিল হয়ে উঠছে। স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্ধারকর্মীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছেন এবং বাসিন্দাদের নিরাপদে থাকতে সতর্ক করা হয়েছে।
জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক আলোচনা চলছে। জনসাধারণ মূলত দুটি বিষয়ে বেশি সমালোচনা করছেন:
১. নগর অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ
Twitter (X) এবং Reddit-এ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, কীভাবে একটি পুরোনো পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের ক্ষয় এত বড় সিংকহোলের কারণ হতে পারে। নাগরিকরা স্থানীয় প্রশাসনের অবহেলা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে আরও কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন।
২. উদ্ধার অভিযানের গতি
কিছু মানুষ মনে করছেন, প্রযুক্তির এই যুগেও এমন একটি ঘটনায় দ্রুত এবং কার্যকর প্রতিক্রিয়া আশা করা স্বাভাবিক। তারা অভিযোগ করছেন যে উদ্ধার কাজ আরও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হওয়া দরকার।
সামগ্রিকভাবে, স্থানীয় বাসিন্দা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, এবং তারা দ্রুত সমাধানের দাবি জানাচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
জাপানি সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি
জাপানে দুর্যোগ বা বড় ধরনের দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সরকার সাধারণত কয়েকটি পর্যায়ে প্রতিক্রিয়া জানায়, এবং প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা নির্দিষ্ট কিছু শর্তে এসব বিষয়ে মন্তব্য করেন। প্রথমে, স্থানীয় প্রশাসনই সাধারণত নেতৃত্ব দেয়। প্রদেশীয় বা শহর প্রশাসন উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে, বাসিন্দাদের সরিয়ে নেয় এবং প্রাথমিক তদন্তের দায়িত্ব পালন করে। যেহেতু ইয়াশিও শহরের এই সিংকহোল দুর্ঘটনা এখনও স্থানীয় পর্যায়ে সামলানো যাচ্ছে, তাই কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ হয়নি।
যদি কোনো দুর্ঘটনা স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন জাতীয় সরকার হস্তক্ষেপ করে। জাপানের ক্যাবিনেট অফিসের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ এ ধরনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়। তবে ভূমিকম্প, টাইফুন, সুনামি বা পারমাণবিক বিপর্যয়ের মত বড় ধরনের জাতীয় দুর্যোগ হলে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বক্তব্য দেন। মাঝারি আকারের দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী সাধারণত মন্তব্য করেন না, তবে যদি ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যায় বা প্রাণহানি ঘটে, তাহলে তিনি বা মন্ত্রিসভার কেউ আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকেন।