একটা কাজ আপনার টু-ডু লিস্টে অনেকদিন ধরে পড়ে আছে। আপনি ঠিক করেছিলেন যে আজ সকালেই কাজটা শেষ করবেন। কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর হল।
আপনি নিজেকে বললেন, ঠিক আছে। হাতের কাজটা শেষ করেই ওটা ধরব।
কিন্তু এর মধ্যে আপনার মনে অপরাধবোধ জমতে শুরু করল।
যখন আমরা এমন চাপের মধ্যে থাকি, তখন মনে হতে পারে আলসেমি করা যেন একটা লজ্জাজনক ব্যর্থতা। যেন এটা এমন একটা বদ-অভ্যাস যার থেকে সব সময় দূরে থাকতে হবে। ঢিলামির অভ্যাস যেন একটা ভয়ঙ্কর দানব, যাকে জিততে দেয়া যাবে না। যেন এটাই হচ্ছে আমাদের সফলতার পথে বড় শত্রু।
আন্না লডউইক
রিভিউ স্টুডিও, ১৯ মার্চ ২০২৪
তবুও ঢিলামি করার দোষ আমাদের সবার মধ্যে আছে। অনেক সফল ও সৃজনশীল মানুষের মধ্যেও ঢিলামি দেখা যায়—স্টিভ জবস, ফ্র্যাঙ্ক লয়েড রাইট, মার্গারেট অ্যাটউড… তালিকাটা বেশ লম্বা। অবশ্য তারা কোনো না কোনোভাবে তাদের কাজ ঠিকই শেষ করেন।
যদি বলা হয় ঢিলামি করা সহজাতভাবে কোনো খারাপ স্বভাব নয়? যদি কাজ ফেলে রাখার প্রবণতাই সৃজনশীলতার আসল চালিকা শক্তি হয়?
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটি—সঠিকভাবে ঢিলামি করার উপায় কী?
ঢিলামি ও সৃজনশীলতার বিজ্ঞান
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যদি সঠিকভাবে ঢিলামি করা যায়, তবে তা সৃজনশীল কাজের জন্য ভাল ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। মনোবিজ্ঞানী জিহায়ে শিন ও অ্যাডাম গ্রান্ট কর্মক্ষেত্রে ঢিলামি ও সৃজনশীলতা নিয়ে একাধিক পরীক্ষা করেছেন। এক পরীক্ষায় তারা দেখতে পান, যারা মাঝারি মাত্রায় ঢিলামি করেন, নিজেদের কাজে সৃজনশীলতা বের করে আনার ক্ষেত্রে তারা তুলনামূলক ভাল করেন। আরেকটি পরীক্ষায় দেখা যায়, কর্মীদের মধ্যে মাঝারি পর্যায়ের ঢিলামি করার প্রবণতা যাদের আছে, তাদের ম্যানেজাররা বেশি সৃজনশীল মনে করেন।
বিজ্ঞানীদের এই অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে, যখন আপনি হাতের কাজটি বাদ দিয়ে অন্য কিছু করেন, তখন আপনি আসলে আপনার মস্তিষ্ককে সময় দেন যেন তা ব্যাকগ্রাউন্ডে থেকে সমস্যাটি নিয়ে চিন্তা করে এবং নতুনভাবে চিন্তা করার পথ খোঁজে। অবচেতন মনে এভাবে চিন্তা করাকে বলে ইনকিউবেশন। এটাই হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে হঠাৎ করে কোনো সমাধান বা আইডিয়া আমাদের মাথায় চলে আসে। অথচ তখন হয়ত আমরা অন্য কোনো কাজ করছি।
ঢিলামি বা আলসেমি করা আমাদের মনকে দিবাস্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দেয়। মনকে তার ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াতে দিলে কল্পনার দরজা খুলে যায় এবং অনুসন্ধান শুরু হয়। এটি আপনাকে সৃষ্টিশীল কোনো আবিষ্কারের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
আর আপনি যখন অন্য কিছুর ওপর মনোযোগ দেন, তখন আপনি আশপাশের জগত থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার সুযোগও পান—এটা একধরনের ‘সৃজনশীল দৈব ঘটনা’ (ক্রিয়েটিভ সিরেনডিপিটি)। কখন কোন অভিজ্ঞতা বা নতুন কিছু শেখা আপনাকে একদম অন্য রকম একটা দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেবে, তা আপনি জানেন না। আপনি যখন একটা কাজ শেষ করার জন্য তাড়াহুড়া না করে সময় নেন, তখনই নতুন কোনো দিক আবিষ্কারের সম্ভাবনা বাড়ে—কারণ তখনও আপনার কাজের গতিপথ বদলানোর সুযোগ থাকে।
কতটা ঢিলামি করলে সেটা বেশি হয়ে যায়?
এখন যারা ভাবছেন তাহলে তো ইনস্টাগ্রামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করার বা এক বসাতে প্রিয় সিরিজ দেখার লাইসেন্স পেয়ে গেছি—তাদের জন্য দুঃসংবাদ আছে। সেটা হচ্ছে,অতিরিক্ত ঢিলামি করলে কিন্তু আপনার সৃজনশীলতা বাড়বে না।
শিন এবং গ্রান্ট দেখিয়েছেন যে, ঢিলামি ও সৃজনশীলতার মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা উল্টা U-আকৃতির গ্রাফের মত। অর্থাৎ যারা খুব কম বা খুব বেশি ঢিলামি করেন, তারা সৃজনশীলতা অর্জন করতে পারেন না। তবে মাঝারি মাত্রায় যারা ঢিলামি করেন তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা বেশি আসে।
হিডেন ব্রেইন পডকাস্টে এই গবেষণার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অ্যাডাম গ্রান্ট ব্যাখ্যা করে বলেন:
“যদি আপনি কাজের একেবারে শুরুতেই ঝাঁপিয়ে পড়েন, তখন প্রথমে যে আইডিয়াটি মাথায় এসেছিল, সেটা নিয়েই আপনি কাজ করেন। সেরা আইডিয়ার জন্য তখন আর অপেক্ষা করেন না। আবার যদি একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, তখনও আপনাকে তাড়াহুড়া করে একটা সহজ আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে হয়। কারণ সেই সময় আর সবচেয়ে ভাল আইডিয়া বাস্তবায়ন করার সময় থাকে না।”
তাই আপনার লক্ষ্য হওয়া উচিত একটা মাঝামাঝি অবস্থান খুঁজে বের করা। আপনাকে এমন একটা ভারসাম্য আনতে হবে, যেখানে আপনি আইডিয়া স্ফূটন (ইনকিউবেশন) ও দৈবক্রমের (serendipity) জন্য কিছুটা সময় রাখবেন। আবার সেই সঙ্গে কাজটা ঠিকঠাকভাবে শেষ করারও পর্যাপ্ত সময় হাতে থাকবে।
যে ধরনের ঢিলামি করা ভুল
এই বিষয়টা বোঝা জরুরি যে আপনি যদি কোনো কাজেই আগ্রহ না দেখান, তাহলে ঢিলামি আপনাকে কোনো সাহায্য করবে না। গ্র্যান্ট ব্যাখ্যা করেন: “শুধুমাত্র তখনই ঢিলামি করা কাজে দেয়, যখন আপনি সমস্যাটি সমাধানে আগ্রহী। তবে আপনি কাজটি পিছিয়ে দিচ্ছেন কারণ এটা কঠিন বা আপনি এখনও এর সমাধান বের করতে পারেননি। এই সময় আপনি নিজের অজান্তে কিছু ভাবনাচিন্তা করেন, যা সমাধান বের করতে সহায়ক হতে পারে।”
যখন কোনো বিষয় নিয়ে আপনি বিরক্ত হয়ে যান বা উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেন, তখন ঢিলামি করলে সেটা কোনো লাভ দেবে না (যদিও তখন সেটা খুব লোভনীয় মনে হয়)। তবে এটাকে সরাসরি এড়িয়ে যাওয়া বা পালিয়ে যাওয়া হিসাবে ভাবা যাবে না।
ঢিলামিকে যদি উপকার হিসাবে ব্যবহার করতে চান, তাহলে আপনাকে আগেই সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে আগ্রহী হতে হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে আপনি সাধারণত ঢিলামি করতেই চান না—আর এই ব্যাপারটা আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি।
ঢিলামি করার সঠিক উপায়
ঢিলামি শুরু করার জন্য আমাদের অধিকাংশ মানুষের কোনো গাইডলাইনের প্রয়োজন হয় না। এই কাজ আমরা এমনিতেই করতে পারি। কিন্তু আপনি যদি চান ঢিলামির মাধ্যমে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ বের করে নিয়ে আসবেন, তবে কয়েকটি বিষয় মনে রাখা দরকার।
প্রথম ধাপ: একটি ভিত্তি বা কাঠামো তৈরি করুন
সৃজনশীল চিন্তা করা নিয়ে গ্রাহাম ওয়ালাসের ৪ ধাপের একটি মডেল আছে, যা আপনি ব্যবহার করতে পারেন।
১. সৃজনশীল প্রক্রিয়ার শুরু হয় প্রস্তুতি (preparation) ধাপ দিয়ে। এটা হচ্ছে সেই পর্যায় যখন আপনি আপনার চ্যালেঞ্জ বা কাজ নিয়ে যতটা সম্ভব চিন্তা করেন এবং যত বেশি সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করেন।
২. এরপর আসে ইনকিউবেশন (incubation) বা আইডিয়া পূর্ণতা পাওয়ার ধাপ। এই ধাপে আপনার অবচেতন মনে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা চলতে থাকে।
৩. তারপর আসে আইডিয়ার স্ফুলিঙ্গ তৈরি হওয়ার ধাপ (illumination)। এই সময় সৃষ্টিশীল চিন্তা বিদ্যুতের মত ঝলকানি দিয়ে আসে। অথবা সেটা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।
৪. সবশেষ হল যাচাইকরণ (verification) ধাপ। এখানে আপনি চিন্তাটি যাচাই করে দেখেন এবং তা আরও নিখুঁত করে তোলেন।
ঢিলামি করে উপকার পেতে হলে প্রস্তুতি (preparation) ধাপটি খুব জরুরি। যদি প্রস্তুতির অংশ ঠিকমত না করা হয়, তবে আপনি দরকারি তথ্য ছাড়াই ইনকিউবেশন পর্যায়ে চলে যাবেন। তখন কাজ করার জন্য আপনার মস্তিষ্কের কাছে সঠিক জিজ্ঞাসা বা ধারণাই থাকবে না। তাই আপনাকে অবশ্যই আগে কী চিন্তা করবেন সেটার মূল ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। তারপরই আপনি সেটাকে নিজের অবচেতন মনের কাছে ছেড়ে দিতে পারবেন।
ঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে চাইলে প্রথমে ভাবুন আপনি কী অর্জন করতে চাইছেন এবং কেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। মাথা খাটান বা ব্রেইনস্টর্মিং করুন, যাতে আপনার মস্তিষ্কের কাছে বিশ্লেষণ করার মত বিকল্প থাকে। নিজেকে এমন কিছু প্রশ্ন করুন, যার উত্তর আপনি এখনও জানেন না।
দ্বিতীয় ধাপ: ঢিলামি করার সময় আপনি কী কাজ করবেন সে ব্যাপারে কৌশলী হন
গবেষণা বলে, পুরোপুরি বিশ্রামে থাকা ইনকিউবেশন পর্যায়ের জন্য সব সময় ভাল না। আবার এই সময় আপনি যদি একেবারে ভিন্ন ধরনের কঠিন কোনো কাজ করেন, সেটাও সহায়ক হবে না।
তাই এমন কাজ বেছে নিন, যেটা আপনার মনোযোগ খানিকটা ধরে রাখবে। কিন্তু সেটা যেন এতটা কঠিন না হয় যে আপনার মানসিক শক্তি পুরাপুরিভাবে চলে যাবে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কম ভাবনা চিন্তা করা লাগে অফিসের এমন কোনো কাজ, যেমন ইমেইল ইনবক্স খালি করা।
ঢিলামি করার আরও কিছু উপায় বিবেচনা করতে পারেন:
কাজ করার মানসিক অবস্থা থেকে ব্যক্তিগত কাজ করার মানসিকতায় যান। যদি আপনি বৃহস্পতিবার বিকালে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ করার প্রস্তুতি নেন, আর এরপর শুক্র-শনিবার নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে সময় কাটান, দেখা যাবে হয়ত রবিবার আপনার মাথায় দারুণ কিছু আইডিয়া চলে এসেছে।
এমন কিছু করা যা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। ধাঁধা সমাধান করা বা নতুন কোনো দক্ষতা শেখার চেষ্টা করুন। এতে সৃষ্টিশীল কাজ করার আত্মবিশ্বাস ও কাজের গতি—দুটিই বাড়ে।
মজার কিছু করা। খেলাধুলা বা মজার কোনো কাজ আপনার মনোযোগ সরিয়ে দিবে। কিন্তু এতে আপনার মন পুরোপুরি ব্যস্তও হবে না। আর এর কিছু সৃজনশীল উপকারিতাও আছে।
হাঁটতে বের হওয়া। জায়গা বদল করা হলে আপনার মন কিছুক্ষণের জন্য অন্য কোনো ভাবনায় ডুবে যেতে পারে। আর এজন্য আপনাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। বিশেষ করে ধীরে ধীরে হাঁটার মত পুনরাবৃত্তিমূলক ব্যায়াম আপনার মনকে ছুটে বেড়াতে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়।
তৃতীয় ধাপ: কাজ পুনরায় শুরু করার সময় ঠিক করুন
আপনার কাজ শেষ করার জন্য যাতে যথেষ্ট সময় থাকে। সেজন্য আগে থেকেই ঠিক করে নিন কোন সময় আপনি ঢিলামি শেষ করে কাজে ফিরবেন। ঢিলামির পালা শেষ করতে কোনো ইউরেকা মুহূর্তের (light bulb moment) অপেক্ষায় বসে থাকবেন না। কারণ আপনি যে সব আইডিয়া পেয়েছেন, সেগুলি তখনই ধরা পড়বে যখন আপনি আবার কাজে হাত দেবেন।
কাজের ডেডলাইন থেকে পেছনের দিকে হিসাব করে দেখুন, নিজের জন্য আপনি কতটা সময় রাখতে পারবেন। যখন নির্ধারিত সময় চলে আসবে, তখন ঢিলামি করা থেকে বিরত থাকেন। সেটা আপনি প্রস্তুত হন অথবা না হন।
প্রো-ক্র্যাস্টিনেশন (Procrastination)–এ প্রো (দক্ষ) হওয়া
আপনার মস্তিষ্ককে যাতে অবচেতনভাবে বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে ভাবে, সেজন্য যথেষ্ট সময় ও স্বাধীনতা প্রয়োজন। আর সেজন্য ঢিলামি করাকে একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে মেনে নিতে হবে। তবেই আপনি আরও সৃজনশীল সমাধানে পৌঁছাতে পারবেন।
যেকোনো টুল বা পদ্ধতির মত, ঢিলামিকে কৌশল করে ব্যবহার করার বিষয়টিও জানতে হয়।
আপনাকে কাজের মূল ভিত্তি তৈরি করে রাখতে হবে। বুদ্ধি খাটিয়ে নিজের কাজটি বেছে নিতে হবে এবং এমন যথা সময়ে কাজে ফিরতে হবে যাতে আপনি যে নতুন সৃজনশীল আইডিয়া পেয়েছেন, সেগুলি কাজে লাগানোর জন্য যথেষ্ট সময় থাকে।
তাহলে আর কী, ঢিলামি করুন—তবে সঠিকভাবে।
ঢিলামি যেভাবে আপনাকে আরও সৃজনশীল করে তোলে