রাফির গল্প
রাফি ছিল ক্লাসের এক নীরব ছাত্র। সহপাঠী ও শিক্ষকরা তাকে দুর্বল ভাবতেন, আশা করতেন তার থেকে বড় কিছু হবে না। ফলে রাফিও নিজেকে অক্ষম মনে করত। কিন্তু এক নতুন শিক্ষিকার আগমন সব বদলে দেয়। তিনি রাফির খাতা দেখে বললেন, “তোমার লেখায় ভাবনা আছে, তুমি পারো!” এই উৎসাহে রাফি পড়াশোনায় মন দিল, ধীরে ধীরে ক্লাসের শ্রেষ্ঠ ছাত্রদের একজন হয়ে উঠল এবং শেষে ফার্স্টবয় হল।

এটিই পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট—যখন কেউ আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখে, তখন আমরাও নিজেদের ওপর বিশ্বাস তৈরি করি।

পিগম্যালিয়ন ইফেক্টের ধারণা ও ইতিহাস
পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট হল মনোবিজ্ঞানের একটি ধারণা, যেখানে অন্যের প্রত্যাশা কারও আচরণ বা পারফরম্যান্সকে প্রভাবিত করে। আমরা যদি কাউকে ভাল কিছু করবে বলে বিশ্বাস করি, তিনি সেই প্রত্যাশা পূরণে বেশি চেষ্টা করেন। উল্টোদিকে, নেতিবাচক প্রত্যাশা তাকে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

এই ধারণাটি গ্রিক পুরাণের ভাস্কর পিগম্যালিয়নের গল্প থেকে এসেছে। পিগম্যালিয়ন ছিলেন সাইপ্রাসের একজন ভাস্কর, যিনি নারীদের প্রতি হতাশ হয়ে একটি হাতির দাঁতের নারীমূর্তি তৈরি করেছিলেন। মূর্তির সৌন্দর্যে তিনি এতই মুগ্ধ হন যে এর প্রেমে পড়ে যান! তারপর, প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির কাছে মূর্তিটিকে জীবন দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করেন। আফ্রোদিতি তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন এবং মূর্তিটি জীবন্ত হয়ে ওঠে। পিগম্যালিয়ন মূর্তির নাম রাখেন ‘গ্যালাতিয়া’।

মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট
১৯৬৮ সালে মনোবিজ্ঞানী রবার্ট রোজেনথাল এবং শিক্ষিকা লেনোর জ্যাকবসন ক্যালিফোর্নিয়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গবেষণা চালান। তারা শিক্ষকদের ভুল তথ্য দিয়ে বলেন, কিছু ছাত্রের “বুদ্ধির হঠাৎ বৃদ্ধি” হবে। বাস্তবে এই ছাত্রদের এলোমেলোভাবে বাছাই করা হয়েছিল। কয়েক মাস পর দেখা গেল, এই ছাত্ররা সত্যিই ভাল ফল করছে, এমনকি তাদের আইকিউ স্কোরও বেড়েছে। কারণ? শিক্ষকদের ইতিবাচক প্রত্যাশার ফলে তারা এই ছাত্রদের প্রতি বেশি যত্নশীল, উৎসাহী এবং সহানুভূতিশীল ছিলেন। এই গবেষণা প্রমাণ করে, প্রত্যাশা শুধু চিন্তা নয়, এটি আচরণের মাধ্যমে ফলাফলকে প্রভাবিত করে। তবে এই গবেষণায় শিক্ষকদের ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য দেওয়া নিয়ে নীতিগত প্রশ্ন উঠেছিল।

যে শিক্ষার্থীদের তারা “ভাল” বা “প্রতিভাবান” ভেবে নিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে তারা বেশি যত্নসহকারে, উৎসাহ দিয়ে ও সহানুভূতির সঙ্গে ব্যবহার করছিলেন। ফলে সেই ছাত্রদের মধ্যে নিজের ওপর বিশ্বাস তৈরি হচ্ছিল এবং তারা ভাল করছিল।

প্রত্যাশা কীভাবে আচরণ ও ফলাফল প্রভাবিত করে
এই গবেষণা প্রমাণ করেছিল, প্রত্যাশা শুধু মানসিক ভাবনা নয়, সেটা আচরণে ফুটে ওঠে। এবং ইতিবাচক প্রত্যাশা কাউকে সত্যিই বদলে দিতে পারে। শিক্ষক বা নেতা হিসাবে আমাদের মনোভাব অন্যদের সফলতা-ব্যর্থতায় বড় ভূমিকা রাখে।

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট একটি চক্রাকার প্রক্রিয়ায় কাজ করে। কেউ যদি আমাদের থেকে ভাল কিছু আশা করে, তাদের আচরণ (যেমন, উৎসাহ, সমর্থন) আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এই আত্মবিশ্বাস আমাদের কাজে প্রতিফলিত হয়, যা আবার তাদের প্রত্যাশাকে আরও শক্তিশালী করে। শিক্ষকরা এটি প্রকাশ করেন ইতিবাচক পরিবেশ, প্রশংসা, বেশি সময় বা জটিল বিষয় শেখানোর মাধ্যমে।

শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে পিগম্যালিয়ন প্রভাব
একাডেমিক ও বাস্তব জীবন উভয় ক্ষেত্রেই পিগম্যালিয়ন প্রভাবের গুরুত্ব রয়েছে। যদি একজন ম্যানেজার তার দলের দক্ষতার ওপর বিশ্বাস রাখেন, তাহলে সেই দল আরও ভাল পারফর্ম করে। অথচ ম্যানেজার যদি দলের ওপর বিশ্বাস না রাখে তবে একই দক্ষতা থাকলেও সে দলের পারফরমেন্স খারাপ হয়।

প্রত্যাশা কীভাবে আমাদের আচরণ গড়ে তোলার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে সেটা পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট থেকে বুঝতে পারি।

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট কাজ করে, কারণ অন্যরা আমাদের সম্পর্কে যেটা ভাবে অথবা আমাদের যে ট্যাগ দেয়, অনেক সময় আমরা নিজেরাও চেষ্টা করি সেই ট্যাগের সাথে মিলিয়ে চলতে—সেটা ভাল হোক অথবা খারাপ। অর্থাৎ কেউ যদি আমাদের থেকে ভাল কিছু আশা করে, তাহলে সেটার প্রভাব শুধু আমাদের ওপরই পড়ে না, যারা আশা করে তাদের ওপরেও পড়ে।

বিষয়টি বুঝতে একজন শিক্ষকের উদাহরণ নিয়ে ভাবা যাক।

যিনি প্রত্যাশা করেন, তিনি যে পরিবেশ তৈরি করেন সেটা হচ্ছে ক্লাইমেট। এখানে ক্লাইমেট তৈরি করা ব্যক্তিটি হচ্ছেন শিক্ষক। ক্লাইমেট তৈরির বিষয়টি অনেক সময় শিক্ষকের শরীরের ভাষা থেকে বোঝা যায়। যেমন হাসি, মাথা নাড়ানো বা চোখে চোখ রাখা। এসব আচরণের মাধ্যমে শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের সাথে একটি বন্ধুসুলভ আর ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করেন।

শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক যে মতামত দেন, সেটাই ফিডব্যাক। যাদের কাছ থেকে শিক্ষক বেশি আশা করেন, তারাই সাধারণত বেশি প্রশংসা আর বিস্তারিত মতামত পায়।

ইনপুট বলতে বোঝায়, শিক্ষক পাঠদানে কতখানি চেষ্টা বা শক্তি খরচ করছেন। অনেক শিক্ষক আছেন যারা ভাল শিক্ষার্থীদের জন্য বেশি সময় দেন। অনেক সময় তাদের জটিল সব বিষয়ও শেখান তারা। শিক্ষকেরা সাধারণত “ভাল” শিক্ষার্থীদের বেশি ডাকেন বা ক্লাসে তাদের বেশি বেশি অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ দেন। এই প্রবণতাকে আউটপুট বলা হয়।

ধরুন একজন শিক্ষক বিশ্বাস করেন, তার ক্লাসের সবাই সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেতে পারে। তিনি এই প্রত্যাশার কথা এভাবে প্রকাশ করেন যে, যদি শিক্ষার্থীরা পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নেয়, তাহলে তিনি নিশ্চিত যে তারা ভাল করবে।

পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে ধরে ক্লাসে বা মক পরীক্ষার সময়ও শিক্ষক এই ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখেন: তিনি প্রতিটি শিক্ষার্থীকে উত্তর দিতে ও ক্লাসে আলোচনায় অংশ নিতে উৎসাহ দেন। যখনই কেউ ভুল করে, তিনি সময় নিয়ে এর সঠিক উত্তর ব্যাখ্যা করেন।

শিক্ষক এখানে শিক্ষার্থীর যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং সফলতার পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তাই শিক্ষার্থীরা নিজেরাও এই বিশ্বাস নিজেদের মধ্যে ধারণ করে এবং পরীক্ষার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে।

এভাবে শিক্ষকের প্রত্যাশার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা তাদের আচরণ মানিয়ে নেয়। ফলে শিক্ষকের বিশ্বাস সত্য প্রমাণিত হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের উন্নতিতে আরও সাহায্য করার জন্য শিক্ষক উৎসাহ পান।

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের পারফরমেন্স ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।

একটি উদাহরণ 
ধরুন আপনি একজন মাধ্যমিক স্কুলের টিচার। স্কুলের প্রথম দিনেই আপনি খেয়াল করলেন, আপনার ক্লাসে এমন একজন ছাত্রী আছে যার দুই বড় ভাইবোন আগের বছরগুলিতে আপনার ক্লাসে ছিল। ওদের দুইজনই প্রায়ই ক্লাসে গোলমাল করত।

মনের অজান্তেই আপনি এই নতুন ছাত্রীকে দেখে মনে করলেন যে, “এও হয়ত তেমনই হবে।” আর এই মনে করাটা আপনার আচরণে প্রভাব ফেলল। এরপর ছাত্রীটি যখন একটু-আধটু দুষ্টুমি করে, সেটাই আপনি খুব বিরক্তির চোখে দেখেন। আপনার কাছে মনে হয় সে আপনাকে অসম্মান করছে।

যদিও মাঝে মাঝে অন্যরাও একই রকম দুষ্টুমি করে, তবুও আপনি তাকে অন্যদের চেয়ে বেশি কড়া শাসন করেন এবং অকারণে অনেক বেশি রেগে যান। এতে ছাত্রীটি মনে করে আপনি তার প্রতি অন্যায় করছেন। সে ধীরে ধীরে ক্লাসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তখন আপনি শুরুতে যা ভেবেছিলেন, সেটাই সত্যি হয়ে ওঠে—আপনার প্রত্যাশা বাস্তবে রূপ নেয়।

আমরা যখন ভিন্ন রকম প্রত্যাশা করি, তখন আমাদের ব্যবহারও ভিন্ন হয়। এমনকি অনিচ্ছাকৃতভাবেও এটা হতে পারে।

যদিও এই ব্যাপারটা সাধারণত আমাদের অজান্তেই ঘটে, তবুও কাউকে সাহায্য করার জন্য পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট কাজে লাগানো যায়। হতে পারে সেটা শিক্ষার্থী, অফিসের কর্মী, খেলোয়াড়—যে কেউ। ধরুন কোনো কোচ যদি তার খেলোয়াড়কে বোঝাতে পারেন যে কোচ তার কাছ থেকে আরও ভাল ফলাফল আশা করে, তখন সেই খেলোয়াড় অনেক ক্ষেত্রে নিজের পারফরমেন্স আরও ভাল করে তুলতে পারে।

নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে যারা থাকেন, পিগম্যালিয়ন প্রভাবের বিষয়টি যদি তাদের জানা থাকে, তবে তারা বুঝতে পারেন কীভাবে তাদের মনোভাব আর প্রত্যাশা অধীনস্থদের ওপর প্রভাবে ফেলে। নেতার মধ্যে যদি পক্ষপাত থাকে, তবে সেটা অধীনস্থদের প্রতি তার প্রত্যাশাকে প্রভাবিত করতে পারে। এতে অধীনস্থদের এমনভাবে ট্যাগ দেওয়া হতে পারে যেটা তাদের প্রতি অন্যায্য অথবা স্টেরিওটিপিক্যাল বা গতানুগতিক।

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট শুধু ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে না—এটি দল বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও কাজ করে। যেমন একটি প্রতিষ্ঠানের কোনো একটি বিভাগে এমন পরিবেশ থাকতে পারে যেখানে সবাই ধরে নেয় যে এখান থেকে বেশি কিছু আশা করা যাবে না। আবার এমন বিভাগ থাকতে পারে যেখানে সবাই বিশ্বাস করে যে তারা অনেক কিছু করতে পারবে।