চলতি বছরের (২০২২) আগস্টে ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তি বা দেশভাগের ৭৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এই অঞ্চল থেকে বিদায় নেয়ার ফলে ভারত ও পাকিস্তান এই দুটি নতুন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।

সে সময়ে ব্রিটিশরা যেই প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর করে, তাতে নানা ভাগে বিভক্ত এই অঞ্চলের সমাজকে খুব সরলভাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। আর সম্পূর্ণ বিষয়টাকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছিল, যাতে মনে হয় সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে বিভক্ত করা এবং নতুন করে সীমানা টেনে দেয়ার কাজটা যৌক্তিক এবং এমনকি সম্ভবও। অথচ দেশভাগের এই সিদ্ধান্তের কারণে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অভিবাসনের ঘটনাটি ঘটে। এক কোটিরও বেশি মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত পার হয়েছিল তখন।


নভতেজ কে পুরেওয়াল এলেনর নিউবিগিন
দি কনভারসেশন,  ১২ আগস্ট, ২০২২
অনুবাদ. ফারহান মাসউদ


এ বছরের মতো প্রতিটা জয়ন্তীর আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এ সময়ে অতীতের দিকে তাকিয়ে ইতিহাসকে নতুন করে বিচার করা যায়। দেশভাগের এই ঘটনা কীভাবে হয়েছে, সে ব্যাপারে স্বীকৃত একটা ধারণা হলো, এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। অনেকেই ভাবেন, দক্ষিণ এশিয়ার সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে থাকা বিভেদ এবং ধর্মীয় উত্তেজনার ফলেই দেশভাগ হয়েছে। ঐতিহাসিক সেই ঘটনার ৭৫ বছর পরে এসে আজ ইতিহাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত কিছু ধারণা নতুন করে মূল্যায়ন করার সময় হয়েছে।

নানান মিথের ওপর ভিত্তি করে দেশভাগের ইতিহাস ঘিরে অনেক ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি মিথ নিয়ে আলোচনা করা হলো:

 

মিথ ১: মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় বিভেদ দূর করা

শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমেই দক্ষিণ এশিয়ার সমাজকে বুঝতে চাইত ব্রিটিশরা। হিন্দু ও মুসলিম পরিচয়ের মানুষদের এ অঞ্চলের বৃহত্তম গোষ্ঠী হিসেবে কল্পনা করার মাধ্যমে ভারতবর্ষের ব্যাপারে অতি সরল একটা দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে।

আর দেশভাগ নিয়ে বর্তমানে জনপ্রিয় যেসব বিবরণ চালু আছে, তাতে ব্রিটিশদের সেই ধারণাই নতুন করে বলা হয়। অথচ কয়েক দশক ধরে করা গবেষণায় দেখা গেছে যে, ধর্মীয় পার্থক্য দিয়ে আসলে দেশভাগের ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায় না।

দেশভাগ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকেই ঢালাওভাবে ধর্মীয় বিভাজন নিয়ে কথা বলেন। কিন্তু এসব ব্যাখ্যায় জটিল রাজনৈতিক এবং সামাজিক যেসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ গড়ে উঠেছে, সেগুলি পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় না। অথচ দেশভাগের ফলেই ভারতবর্ষের মানুষদের নির্দিষ্ট একটা ধর্মীয় পরিচয় বেছে নিতে হয়েছে। আর সেই পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করেই তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর তাদের মুখে সেই ইতিহাসের বর্ণনার দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, দেশভাগের এই সিদ্ধান্তের ফলে কার্যকর কোনো রাজনৈতিক সমাধান হয়নি। বরং জাতীয়তা আর ধর্মের ওপর ভিত্তি করে নতুন সব বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে।

ব্রিটিশ ভারতের অধিবাসী বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে মানুষের পরিচয় এবং রীতিনীতিতে যে বিশাল বৈচিত্র্য আছে, দেশভাগের সময় এর ওপর কোনো গুরুত্বই দেয়া হয়নি। এর বদলে ধরে নেয়া হয়েছিল যে, এখানে ধর্মকে কেন্দ্র করে সংঘাত চলছে। অথচ এখানকার অধিবাসী বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের একই ভাষা, সাহিত্য বা সঙ্গীত থেকে শুরু করে আঞ্চলিক এবং স্থানীয় ঐতিহ্য রয়েছে। আর এর মাধ্যমেই ব্রিটিশদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

ধরে নেয়া হয়েছিল যে, এখানে ধর্মকে কেন্দ্র করে সংঘাত চলছে। অথচ এখানকার অধিবাসী বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষদের একই ভাষা, সাহিত্য বা সঙ্গীত থেকে শুরু করে আঞ্চলিক এবং স্থানীয় ঐতিহ্য রয়েছে।

হিন্দু বনাম মুসলিমের দ্বৈত ধারণার ওপর ভিত্তি করে দেশভাগের ঘটনা ব্যাখ্যা করার এক প্রবণতা রয়েছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে এসে দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের যে উত্থান দেখা যায়, তার রূপ দিতে সাহায্য করেছে এই প্রবণতাই। বানোয়াট আর কাল্পনিক এক ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ। এই ধারণা অনুসারে, সংখ্যাগরিষ্ঠরাই বাকি সবার জন্যে নিয়ম তৈরি করবে। ভারতকে একটা হিন্দু জাতিরাষ্ট্রে পরিণত করার যে দৃষ্টিভঙ্গি দেশটার বর্তমান সরকারের রয়েছে, তার মধ্যেই ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের ব্যাপারটা সবচেয়ে স্পষ্ট বোঝা যায়।

 

মিথ ২: দেশভাগের কারণে সৃষ্ট সহিংসতা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত

ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তা এবং দেশটির জাতীয়তাবাদী নেতারা দেশভাগের সময়কার সহিংসতার পেছনের কারণ নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাদের মতে, জটিল এক রাজনৈতিক আলোচনার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই মূর্খ এবং ধর্মীয় গোঁড়ামিতে ভরা এই সমাজ সহিংস হয়ে উঠেছিল। কিন্তু দেশভাগের সময়ে ঘটা সহিংসতা আসলে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। এবং এই দাবির পেছনে যথেষ্ট প্রমাণও আছে। ১৯৪৭ সালের সহিংসতা যে আকার ধারণ করেছিল, তা আসলে এর আগের ঔপনিবেশিক বিভিন্ন নীতির ফলাফল, যেসব নীতি অনুসারে নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে অন্যদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল।

এর একটা উদাহরণ হলো ‘মার্শাল রেস’ (martial races) বা ‘যোদ্ধা জাতি’র ধারণা। পুলিশ এবং সেনাবাহিনীতে এসব ‘যোদ্ধা জাতি’র মানুষদেরই নিয়োগ দেয়া হত। আবার ব্রিটিশ রাজের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে তাদেরকে দেয়া হত জমির মালিকানা। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পরে ‘মার্শাল রেস’ এর ধারণা বিকশিত হতে শুরু করে। ‘মার্শাল রেস’ এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করা শুরু হয়। এসব সম্প্রদায়ের জাতিগত বৈশিষ্ট্য, অতি পুরুষত্ব এবং সর্বোপরি ব্রিটিশ রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগের জন্যে তাদেরকে আদর্শ বলে বিবেচনা করা হত। শিখ, জাট, পাঞ্জাবি মুসলমান এবং গুর্খারা ‘মার্শাল রেস’ হিসাবে বিখ্যাত ছিল।

আরো পড়ুন: নিজেদের লোকদের সাদা বানাতে যে ৫ জাতি আমদানি করেছিল ইউরোপিয়ানদের

১৯৪৭ সালের সহিংসতায় দেখা গেছে, পুরুষরা একে অন্যকে আক্রমণ করেছে। এই সহিংসতার হাত থেকে নারীরাও রেহাই পায়নি। পুরুষরা অন্য সম্প্রদায়ের নারীদের যেমন ধর্ষণ ও হত্যা করেছে, তেমনি “পবিত্রতা” এবং “সম্ভ্রম” রক্ষার নামে নিজেদের নারী আত্মীয়দেরও হত্যা করেছে। বিশেষ করে পাঞ্জাবে এসব ঘটনা বেশি ঘটেছে, যেখানে ‘মার্শাল রেস’ হিসাবে বিখ্যাত অনেক জাতির মানুষেরা থাকত। দেশভাগের সময় পাঞ্জাবে যে সহিংসতা ঘটেছে, গবেষকরা পরবর্তীতে সেটাকে “গণহত্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে এই সহিংসতার পেছনে জাতিগত বিশুদ্ধতা এবং উগ্র পুরুষত্বের ধারণা বিশেষভাবে দায়ী। অথচ বছরের পর বছর ধরে একই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই ব্রিটিশরা তাদের অধীনে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ দিয়ে আসছিল।

 

মিথ ৩: দেশভাগ ছিল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ফল

১৯৪৭ সালের আগে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের যে দাবি উঠে এসেছিল, তার প্রতি এদেশের জনগণের ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। মুসলিম রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও এ বিষয়ে মতভেদ ছিল। তার ওপর কীভাবে বা কখন নতুন দেশ গঠন করা হবে, সে ব্যাপারেও পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিল না কারো। দেশের সীমানা কোথায় টানা হবে, তা নিয়েও কেউ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। ১৯৪৬ সালের শেষেরদিকে এসেই ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় উপমহাদেশ বিভাজনের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করে। এর আগে দেশভাগের দাবি মেনে নেয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশরা একেবারেই অনিচ্ছুক ছিল।

১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট, নয়াদিল্লীতে ভারতের স্বাধীনতা উদযাপন উৎসবে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে কোচে উঠেছেন লর্ড এবং লেডি মাউন্টব্যাটেন। তিন নারী ও এক শিশুকে কুচকাওয়াজের ভিড় থেকে উদ্ধার করে কোচে তুলেছেন মাউন্টব্যাটেন।

অবশেষে দেশভাগের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে ব্রিটিশরা প্রথমে ১৯৪৮ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা করে। সে সময় লর্ড আর্চিবাল্ড ওয়াভেল ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা করা হয় ভারতে ব্রিটিশ সরকারের নতুন প্রতিনিধি হবেন লুই মাউন্টব্যাটেন। এবং তিনিই ১৯৪৭ সালের আগস্টের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসের ৩ তারিখে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং জওহরলাল নেহেরু’র (স্বাধীনতার আগে ভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা) সঙ্গে মিলে মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা করেন, মাত্র নয় সপ্তাহ পরেই উপমহাদেশ বিভক্ত হবে।

ফলে ‘৪৭ এর জুন থেকে শুরু করে আগস্টের মধ্যে পাঞ্জাব ও বাংলা প্রদেশের মধ্য দিয়ে কীভাবে সীমানা স্থাপন করা যায়, তা নির্ধারণ করা শুরু হয়। আর এজন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের আইনজীবীরা যার যার অবস্থান থেকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু করে দেন।

বিভিন্ন মহলের মধ্যে সীমানা নির্ধারণের আলোচনা তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব ছিল সিরিল র‌্যাডক্লিফ নামের একজন ব্রিটিশ আইনজীবীর ওপর, যিনি এর আগে কখনো ভারতেই আসেননি। অথচ সীমানা নির্ধারণের জন্যে এই র‌্যাডক্লিফকে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছিল। তখন একদিকে নতুন একটি মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের যে দাবি ছিল, সেটা পূরণ করা হচ্ছিল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। অন্যদিকে সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আইনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার দায়িত্ব ছিল ‘বাউন্ডারি কমিশন’ এর ওপর। এই কমিশন প্রাকৃতিক সম্পদের দখল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিল।

আরো পড়ুন: অরুন্ধতী রায় ব্যাখ্যা করছেন কর্পোরেশনগুলি কীভাবে ইন্ডিয়াকে চালায়

নতুন রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চূড়ান্তভাবে সীমানা নির্ধারণের ঘোষণা আসে ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট, স্বাধীনতার দুই দিন পরে। মূলত অহেতুক দ্রুতগতিতে দেশভাগের এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার ফলেই সে সময়ে প্রচুর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া দেশভাগের জটিল রাজনীতির ব্যাপারে সমাজের সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্পষ্ট যোগাযোগ আর বোঝাপড়া না থাকাটাও সে সময়ে ঘটা সহিংসতার পেছনে দায়ী একটা কারণ।

 

মিথ ৪: সমগ্র ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের শাসনাধীন ছিল

সমগ্র ভারতের এক-তৃতীয়াংশ আইনত কখনোই ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল না। বরং ৫৫০টিরও বেশি দেশীয় রাজ্য [সার্বভৌম রাজ্য, যাকে ব্রিটিশরা বলত ‘প্রিন্সলি স্টেট’] নিয়ে গঠিত ছিল ভারতের এই অংশ। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে এসব রাজ্যের বিভিন্ন সাংবিধানিক এবং কূটনৈতিক চুক্তি ছিল। ব্রিটিশদের ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এসব রাজ্যের সাথে যথাযথ আইনি আলোচনার প্রয়োজন ছিল। অথচ এমন কোনো পদক্ষেপ ব্রিটিশরা নেয়নি।

সমগ্র ভারতের এক-তৃতীয়াংশ আইনত কখনোই ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল না। বরং ৫৫০টিরও বেশি দেশীয় রাজ্য [সার্বভৌম রাজ্য, যাকে ব্রিটিশরা বলত ‘প্রিন্সলি স্টেট’] নিয়ে গঠিত ছিল ভারতের এই অংশ।

কাশ্মীর ছিল এমনই এক দেশীয় রাজ্য। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে সেখানকার মহারাজা স্যার হরি সিং রাজ্যটিকে ভারতীয় সরকারের শাসনের অধীনে রাখার জন্য একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিপত্রকে বলা হয় ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ অ্যাক্সেশন’ বা ‘সংযুক্ত হওয়ার দলিল’। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ ব্যাপারে একটি গণভোটের আহ্বান জানায়। তবে এই ভোট পরে কখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। তখন থেকেই কাশ্মীরের শাসন এবং সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত আর অস্থিরতা চলছে।

৫৮৪টি প্রিন্সলি স্টেট বা দেশীয় রাজ্যসহ ১৯৪৭ সালের আগের ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্র।  লাল রঙে প্রিন্সলি স্টেট, হলুদে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া।  শিল্পী. কার্তিক দত্ত, ছবি. শাটারস্টক।

গোয়া, দমন এবং দিউ অঞ্চলের পশ্চিম উপকূলীয় এলাকা ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এবং ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ভারতীয় অঞ্চল পন্ডিচেরি বা পুদুচেরি ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল।

 

মিথ ৫: দেশভাগের প্রভাব শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই পড়েছে

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে সীমানা পার হয়ে অভিবাসী হয় প্রায় ১০ মিলিয়ন থেকে ১৭.৫ মিলিয়ন মানুষ (১ কোটি থেকে ১ কোটি ৭৫ লাখ)। এছাড়া তখন অনেক মানুষ দক্ষিণ এশিয়া ছেড়েই বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছে। এসব মানুষের অনেকে দেশভাগের ফলে ঘটা সহিংসতায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আবার অনেকে এর ফলে তৈরি হওয়া সহিংসতার কারণে পড়েছিল নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে।

দেশভাগের পর থেকে পাঞ্জাব, সিন্ধু, কাশ্মীর এবং সিলেট অঞ্চলের অনেক মানুষ যুক্তরাজ্য, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে থাকা শুরু করেছে। সেসব দেশে এসব অঞ্চলের মানুষদের কমিউনিটি এখন বেশ বড়। ঔপনিবেশিকতার যেসব প্রভাব দৃশ্যমান, তার মধ্যে এটা অন্যতম। দেশভাগের ফলে বিভাজন তৈরি হলেও বিভিন্ন ধর্ম আর গোষ্ঠীর মানুষেরা প্রবাসী হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একে অন্যের পাশাপাশি বসবাস করছে।

লেখক পরিচিতি

Navtej K Purewal

নভতেজ কে পুরেওয়াল: ‘সোয়াস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন’ এর রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান এবং ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক। তার লেখা সাম্প্রতিক বই ‘ব্লুমসবেরি পাবলিশিং’ থেকে প্রকাশ হয়েছে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত বইটির নাম ‘বিয়ন্ড রিলিজিয়ন ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান: জেন্ডার অ্যান্ড কাস্ট, বর্ডার অ্যান্ড বাউন্ডারিজ’ (Beyond Religion in India and Pakistan: Gender and Caste, Borders and Boundaries)। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ভাষাবিদ্যা (Languages, Cultures and Linguistics) বিভাগে স্বেচ্ছায় পাঞ্জাবি ভাষা শেখান তিনি।

Eleanor Newbigin

এলেনর নিউবিগিন: ‘সোয়াস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডন’ এর আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিভাগের সিনিয়র লেকচারার। ভারতে নাগরিকত্বের ধারণা এবং এর সাথে যুক্ত বিভিন্ন চর্চা নিয়ে গবেষণা করেন তিনি। বিশেষ করে উপমহাদেশের স্বাধীন হওয়ার সময়কাল নিয়ে তার আগ্রহ। এবং বিশেষত রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, পারিবারিক কাঠামো এবং ধর্ম-ভিত্তিক ব্যক্তিগত আইনের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করেন। ২০১৩ সালে ‘কেমব্রিজ স্টাডিজ ইন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি অ্যান্ড সোসাইটি’ নামের একটি সিরিজের অংশ হিসেবে তার লেখা বই প্রকাশ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা সংস্থা। ‘দ্যা হিন্দু ফ্যামিলি অ্যান্ড দ্যা ইমার্জেন্স অফ মডার্ন ইন্ডিয়া: ল, সিটিজেনশিপ অ্যান্ড কমিউনিটি’ (The Hindu Family and the Emergence of Modern India: Law, Citizenship and Community) নামের বইটি ছিল সিরিজের ২২ তম বই।