প্রডাক্টিভ আর অলস লোকদের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, প্রোডাক্টিভরা একটা একটা করে তাদের তালিকায় থাকা কাজ শেষ করেন, আর অলস লোকেরা কাজ শুরু করতেও গড়িমসি করেন। কাজ অনেক সময় করতেও চান না। কিন্তু যে কাজগুলি না করলেই না, তা তো আর আপনার কাজ করতে মন চাওয়ার ওপর নির্ভর করে বসে থাকবে না। আপনাকে কাজগুলি শেষ করতেই হবে। এমন অবস্থায় কী করেন আপনি? অলস লোকেরাও কীভাবে নিজেদের প্রতিদিনকার কাজ একে একে শেষ করতে পারে, তার জন্য একটি দারুণ কৌশলের কথা বলেছেন লেখক নাবিল আলোয়ানি। যার নাম ‘MVD’।

‘মিনিমাল ভায়াবল ডে’ (MVD) কী?

সফটওয়্যার শিল্পের বিভিন্ন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানে ‘মিনিমাল ভায়েবল প্রডাক্ট’ (এমভিপি বা MVP) নামের একটি ধারণা প্রচলিত। ব্যাপারটা এমন যে, একটা প্রডাক্ট (সাধারণত সফটওয়্যার) বাজারে ছাড়ার উপযুক্ত সময় ঠিক তখনই যখন তা ইউজারদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারে। আর বাজারে ছাড়ার পরে আস্তে আস্তে এর পারফর্মেন্স বাড়াতে পারেন, ডিজাইন সুন্দর করে তুলতে পারেন এবং যোগ করতে পারেন নতুন সব ফিচার।

যেমন, হোয়াটসঅ্যাপ এর এমভিপি হল মেসেজ পাঠানোর কাজ। নির্মাতারা এটা চালু করার সময় এর প্রথম সংস্করণ বাজারে ছেড়েছিলেন। তারপর এটা দিয়ে গ্রুপ চ্যাট ও ভিডিও কল করার পদ্ধতি বের করেছিলেন তারা। এইভাবে প্রতিবারের চেষ্টায় এমভিপি আরো বেশি অত্যাধুনিক সংস্করণ হিসেবে ইউজারদের হাতে পৌঁছালো।

“এমন একটা পরিবেশ তৈরি করুন, যেখানে সঠিক কাজটি খুব সহজেই করা যায়।”

কাজ করার এই পদ্ধতিটা আমার খুব পছন্দের। প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা থেকে শুরু করে নতুন রান্নার রেসিপি ট্রাই করতেও এটা ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমি নিজে কাজ শুরু করার পর একে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি। এই পদ্ধতি মাথায় রেখেই আমার কাজের সময়সূচী ঠিক করেছিলাম। এটার একটা নামও দিয়েছিলাম—মিনিমাল ভায়েবল ডে (এমভিডি বা MVD)।

এমভিডি হচ্ছে প্রতিদিনই অল্প পরিমাণে উৎপাদনশীল কাজ করা। যেটা আপনার প্রতিটা কর্মদিবসকেই সফল করে তুলবে। যেমন, আমার MVD হচ্ছে এমন:

  • প্রতিদিনই ৮০০ শব্দের যাচ্ছে তাই কিছু লিখি
  • রান্না করি
  • একদিন লিংকডইনে তো অন্যদিন বিটক্লাউট-এ কিছু পোস্ট করি
  • এক ঘন্টা করে হাঁটি
  • ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুই পৃষ্ঠা পড়ি

তবে আমার অর্ধেক এমভিডি কোনো পেশাগত কাজ সম্পর্কিত নয়। হাঁটা ও পড়াকে মনে হতে পারে গড়িমসি করা, কিন্তু হাঁটলে এবং পড়লে আমার চিন্তার জট খুলে যায়। এভাবে আমার মনোযোগ ফিরে আসলে আমি কাজগুলি আরো ভালোভাবে করতে পারি।

সবই ঠিক আছে, কিন্তু আমার এমভিডি এত হতাশাজনক কেন?

এমভিডি এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে খেয়াল খুশিমতো কাজ করে কোনো কিছুকে সহজ করে তোলা। কাজ নিয়ে যাতে কেউ গড়িমসি করতে না পারে তা নিশ্চিত করাই এমভিডি-র কাজ। এটা হচ্ছে সময়ের সাথে নিজেকে দিয়ে আরো বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার একটা কৌশল। প্রতিদিন কিছু অর্থহীন শব্দ লিখে রাখলে মাস শেষে ডজন খানি আর্টিকেল লেখা হয়ে যায়। প্রতিদিন এক ঘন্টা করে হাঁটলে পেটের চর্বি কমিয়ে স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায়।

আরো পড়ুন: টাইম ম্যানেজমেন্ট এর জন্য সবচেয়ে প্রোডাক্টিভ ব্যক্তিরা যে ১৩টি টেকনিক ব্যবহার করেন 

অনুশীলনের পদ্ধতিটা হয়ত আপনার জানা আছে: ছোট কাজের বড় ও সম্মিলিত ফল। কিংবা ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।

এই বিষয়ে অনেক কথা হল। এখন কিছু বাস্তব চিত্র নিয়ে আলোচনা করা যাক।

নিজের জন্য এমভিডি তৈরির কৌশল

নিজের জন্য তৈরি এমভিডিতে লেগে থাকার সহজ কৌশল হচ্ছে এটাকে অভ্যাসে পরিণত করা। ‘Atomic Habits: An Easy  & Proven Way to Build Good Habits & Break Bad Ones’ বইটি লিখেছেন জেমস ক্লিয়ার। এই বইয়ে তিনি নতুন অভ্যাস তৈরির চারটি বৈজ্ঞানিক কৌশল খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে আপনার নিজের এমভিডিতে যুক্ত করার জন্য চার থেকে পাঁচটি কাজ ভেবে রাখুন। আপনি কি সেগুলি পেয়েছেন? তাহলে এখন বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

১. নিজের জন্য একটা সুস্পষ্ট এমভিডি তৈরি করুন

“প্রত্যেকটি অভ্যাস একটা সূত্র থেকে তৈরি হয়। ভাল অভ্যাস তৈরি হওয়ার এই সূত্রগুলি যাতে আপনার জীবনে বারবার আসে, সেই চেষ্টা করুন।”—জেমস ক্লিয়ার

এমভিডি-তে একখণ্ড কাগজ সূত্র হিসেবে ব্যবহার করুন। আপনি যেখানে কাজ করেন সেখানে এই কাগজটি রাখুন। যেমন, আমার নিজেরটা আমি আমার ল্যাপটপের বাম পাশে রাখি। কাজ করার সময় যখনই আমার চোখ স্ক্রিন থেকে সরে যায়, আমি কাগজটা দেখতে পাই।

আমাকে হয়ত সেঁকেলে মনে হতে পারে। কিন্তু যেকোন ডিজিটাল রিমাইন্ডারের চেয়ে এটা অনেক ভাল কাজ করে।

২. এমভিডি’কে আকর্ষণীয় করে তৈরি করুন

“কাজ শেষ করাই কেবল আমাদের উদ্দেশ্য না। কাজ সফল হওয়ার পর পুরস্কার পাওয়ার আশা আমাদেরকে কাজ শেষ করতে উৎসাহিত করে। প্রত্যাশা যত বড় হয় ডোপামিন নিঃসরণও তত বেশি হয়।”—জেমস ক্লিয়ার

একটা ছোট দৈনন্দিন কাজের সাথে আপনি কীভাবে আপনার প্রত্যাশা যোগ করতে পারেন? খুব সহজেই। যে কাজটি আপনাকে আনন্দ দেয় সেই কাজের সাথে ছোট কাজটিকে একসাথে করে ফেলুন।

যেমন: আমি যখন লিখি, পড়ি, রান্না করি, অথবা হাঁটি, তখন আমি গান শুনতে থাকি। এটা একটা বোঝাপড়া করে নেয়ার মতো ব্যাপার। গুরুত্বপূর্ণ কিছু করার সময় আমি আমার পছন্দের শিল্পীদের গান শুনি।

আরো পড়ুন: যে ৭টি মানসিক বাধা আপনাকে সফল হতে দেয় না

যে কাজটি পছন্দ করেন, সেটার প্যাটার্নগুলিকেও গ্রহণ করুন। তারপর সেই প্যাটার্নগুলিকে যুক্ত করুন আপনার কাজের সাথে। এতে কাজটি নিয়ে আপনি আগের চেয়ে আরো বেশি কিছু প্রত্যাশা করতে পারেন। যেমন: শারীরিক পরিশ্রম করার সময় পডকাস্টে কিছু শুনুন। রান্না অথবা কোনো কিছু পরিষ্কার করার সময় বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলতে পারেন। একসাথে অনেক ইমেইল করা, বা উত্তর দেয়ার কাজটি যেমন আপনার কোন পছন্দের ক্যাফেতে বসে করতে পারেন।

৩. এমভিডি যতটা সম্ভব সহজ করুন

আপনাকে বিশ্বাস করানোর জন্য এখানে আমার জেমস ক্লিয়ারের কাছ থেকে সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আসল কথা হচ্ছে, আমরা সবাই সেই কাজটিই করতে চাই যেটা আমাদের কাছে সহজ মনে হয়। এমভিডি’তে উল্লেখিত কাজ করতে আপনি যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হন সেগুলি কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন।

অলস
নিজের জন্য একটা সিস্টেম তৈরি করতে পারেন। মনমেজাজ ভাল বা মন্দ যেই অবস্থাতেই থাকুক না কেন, এই সিস্টেম আপনাকে দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে চলতে সাহায্য করবে।

উদাহরণ: যদি দীর্ঘ সময় হাঁটার সম্ভাবনা বাড়াতে চান, তাহলে আপনার স্পোর্টস শু’গুলি দরজার পাশে সাজিয়ে রাখুন। ঘুমানোর আগে যদি কিছুক্ষণ বই পড়তে চান তবে খাটের পাশেই একটা বই রাখুন। স্বাস্থ্যকর কোনো খাবার রান্না করতে চাইলে ফ্রিজে বিভিন্ন রকমের রান্নার উপকরণ রাখুন, এবং ফোনে রেসিপি।

ক্লিয়ার যেমনটা বলেছেন: এমন একটা পরিবেশ তৈরি করুন, যেখানে সঠিক কাজটি খুব সহজেই করা যায়।

৪. আপনার এমভিডি’কে সন্তোষজনক করে তুলুন

ক্লিয়ারের আরেকটি অসাধারণ উদ্ধৃতি হল, “আপনি যদি কোনো অভ্যাস রপ্ত করতে চান, তাহলে নিজেকে তাৎক্ষণিকভাবে সফল ভাবতে শেখান। এমনকি অল্প হলেও নিজেকে সফল ভাবতে শিখুন।”

ভালভাবে কোনো কাজ শেষ করার পর নিজেকে পুরস্কৃত করার কথা মাথায় রাখুন। যেমন, কাজের শেষে আপনার প্রিয় কোনো শো দেখতে পারেন। অথবা সামাজিক মাধ্যমে সময় কাটাতে পারেন। এমনকি পছন্দের কোনো খাবার খেয়ে কাজ শেষ করাটাকে উদযাপন করতে পারেন।

উৎসাহ থেকে সিস্টেম বেশি কাজে দেয়

আপনার ভেতর কাজ ফেলে রাখার বা কাজ নিয়ে গড়িমসি করার মনোভাব তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে এমন মনোভাব এড়ানোর জন্য নিজের মধ্যে উৎসাহ তৈরি হবে, সেই আশা করতে পারেন।

অথবা নিজের জন্য একটা সিস্টেম তৈরি করতে পারেন। মনমেজাজ ভাল বা মন্দ যেই অবস্থাতেই থাকুক না কেন, এই সিস্টেম আপনাকে দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে চলতে সাহায্য করবে।

তবে সিস্টেমকে খুব বেশি অভিনব করার দরকার নেই। এমভিডি শুধু একখণ্ড কাগজ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ছোট কাগজটি আপনাকে প্রোডাক্টিভ কাজে আরো বেশি উৎসাহিত করে তুলবে।

সঠিক সময়ে কাজ করতে আমার মত এমন অলস মানুষটিকে যদি এই কাগজটি সাহায্য করতে পারে, আমি নিশ্চিত যে আপনিও এতে উপকৃত হবেন। কাজেই, আর অপেক্ষা কেন?

এখনই কাগজটি হাতে নিন।

নাবিল আলোয়ানী, মিডিয়াম
অনুবাদ. মাহতাবুল আলম