অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের ৮০ বছর বয়সী পর্যটক সুজান রিস একটি বিলাসবহুল ক্রুজ জাহাজে করে ৬০ দিনের ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু যাত্রার প্রথম বিরতিতেই এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের কাছে লিজার্ড আইল্যান্ডে হাইকিং করতে গিয়ে তিনি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এই ট্রিপটির খরচ ছিল প্রায় ৮০ হাজার ইউএস ডলার।
গার্ডিয়ানের খবর অনুসারে রীস-এর মেয়ে ক্যাথরিন রীস বলেছেন যে তার “সুস্থ” এবং “সক্রিয়” মা দ্বীপের ঐতিহাসিক কুকস লুক সামিট পর্যন্ত হাইকিং-এর সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, “আমরা পুলিশের কাছ থেকে জানতে পেরেছি যে দিনটি খুব গরম ছিল এবং পাহাড়ে ওঠার সময় মায়ের শরীর খারাপ লাগছিল। তাকে অসুরক্ষিতভাবে (un-escorted) একা নেমে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। তারপর জাহাজটি যাত্রী গণনা ছাড়াই নাকি ছেড়ে যায়। সেই ঘটনার কোনো এক সময়ে, বা তার অল্প সময়ের মধ্যেই, মা একাকী মারা যান।”
সুজানকে রাত প্রায় ৬টা পর্যন্ত নিখোঁজ হিসাবে রিপোর্ট করা হয়নি, যা ক্যাথরিন “যত্ন এবং সাধারণ জ্ঞানের ব্যর্থতা” বলে উল্লেখ করেছেন।
উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের উপর অবস্থিত লিজার্ড আইল্যান্ডকে জিগুররু (Jiigurru) বা দ্যিউগুররা (Dyiigurra) নামেও ডাকা হয়। এটি কুইন্সল্যান্ডের রাজধানী ব্রিসবেন থেকে ১,৬২৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।

তদন্তকারীরা এখন বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন যে সুজান কীভাবে আটকা পড়লেন এবং কেন জাহাজ কর্মীদের নিখোঁজ হওয়ার অ্যালার্ম বাজাতে এত দেরি হল। জাহাজটি আগের দিনই কায়র্নস থেকে দুই মাসের যাত্রা শুরু করেছিল। ঘটনার দিন জাহাজটি লিজার্ড আইল্যান্ডের কাছে নোঙর করে এবং যাত্রীরা হাইকিং ও স্নরকেলিংয়ে যান। উল্লেখ্য স্নরকেলিং হল পানির উপরিতল থেকে মাস্ক ও স্নরকেলের সাহায্যে মুখ ডুবিয়ে শ্বাস নিতে নিতে নিচের জলজ জগৎ দেখার একটি সহজ জলক্রীড়া। এর জন্য সাঁতারের বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার হয় না, কেবল মাস্ক, ফিন এবং একটি J-আকৃতির নল (স্নরকেল) ব্যবহার করা হয়।
কর্তৃপক্ষ মনে করে, সুজান লিজার্ড আইল্যান্ডের সর্বোচ্চ চূড়া ‘কুকস লুক’-এ ওঠার সময় বিশ্রাম নিতে থেমেছিলেন এবং ফেরার পথে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন।
হাইকিং গ্রুপটি সুজানকে ছাড়াই জাহাজটিতে ফিরে আসে। এরপর যখন জাহাজটি সমুদ্রে ফিরে যায়, তখন ক্রু সদস্যরা বুঝতে পারে যে তিনি নিখোঁজ। এর পরে জাহাজটি ঘুরে ভোর ২টার দিকে লিজার্ড আইল্যান্ডে ফিরে আসে। কাছাকাছি থাকা ট্রেসি আইরিস নামে এক ব্যক্তি জানান, জাহাজের কর্মীরা শুধু স্নরকেলিং করা যাত্রীদের গণনা করেছিল, দ্বীপে থাকা বাকিদের নয়। তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে শেষ যাত্রীরা সৈকত ছাড়ার পরই জাহাজটি খুব দ্রুত নোঙর তুলে চলে গিয়েছিল।
নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়ার পর রাত ৯টার দিকে অস্ট্রেলিয়ান মেরিটাইম সেফটি অথরিটিকে (AMSA) জানানো হয়। মধ্যরাতে একটি হেলিকপ্টার এবং সাতজন ক্রু সদস্য টর্চলাইট নিয়ে পাহাড়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ট্রেসি আইরিস জানান, তিনি দেখেছিলেন যে ভোরবেলা হেলিকপ্টারটি সরাসরি টেলস্ট্রা রক-এর দিকে যায়, যেখানে সুজানকে শেষবার দেখা গিয়েছিল। ট্রেসি নিশ্চিত করেন যে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল এবং তিনি সারাদিন ধরে সেখানেই পড়ে ছিলেন। বিকেল ৪টার একটু আগে তাকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে রবিবার ২৬ অক্টোবর দ্বীপটিতে তার দেহাবশেষ পাওয়া যায়। জাহাজের কর্মীরা যখন বুঝতে পারেন যে তিনি জাহাজে নেই, তখন ভূমি ও সমুদ্র পথে তল্লাশি চালানো হয়। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং ডেটা অনুসারে, ‘কোরাল অ্যাডভেঞ্চারার’ জাহাজটি যখন সুজান রীস-এর জন্য ফিরে আসতে শুরু করে, তখন সেটি প্রায় ১০০ কিমি দূরে ছিল।
‘কোরাল এক্সপেডিশনস’-এর সিইও মার্ক ফিফিল্ড তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ক্রু সদস্যরা কর্তৃপক্ষকে নিখোঁজ হওয়ার খবর দেন এবং এরপরই অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। তিনি বলেন, কুইন্সল্যান্ড পুলিশ তাদের জানায় যে সুজানকে লিজার্ড দ্বীপে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে তদন্ত চলাকালীন এই বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়, তবে তার পরিবারকে সব ধরনের সাহায্য দেওয়া হবে।
শনিবার, ১ নভেম্বর, কোরাল এক্সপেডিশনস (Coral Expeditions) ঘোষণা করেছে যে তাদের ‘কোরাল অ্যাডভেঞ্চারার’ (Coral Adventurer) ক্রুজটির বাকি যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। বিবিসি সংবাদ অনুসারে, কোরাল এক্সপেডিশনসের সিইও একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “সুজান রীস এর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং পূর্বের যান্ত্রিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে, বাকি যাত্রাটুকু বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
নির্জন লিজার্ড আইল্যান্ডে আটকা পড়ে ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধার মৃত্যু

