ছবি তো আসলে দেখার ব্যাপার। তাছাড়া কোনো জিনিস একনাগাড়ে অনেকক্ষণ দেখলে বাড়তি কিছু সময় তার রেশ থেকে যাওয়া তো বৈজ্ঞানিক ঘটনাই। আর যে মুভিগুলিতে আমাদের প্রতিদিনের একেবারেই সাধারণ সব কারবার খুব ব্যাখ্যা দিয়ে দেখানো হয়, সেগুলির রেশ জোরালো হয় বেশি।
২০০৬ সালের ছবি ‘স্ট্রেন্জার দ্যান ফিকশন’ এর প্রধান চরিত্রের মানবিক প্রতিক্রিয়াগুলি নাই বললেই চলে। ফাঁকা তিন রুমের একটা অ্যাপার্টমেন্টে একাই থাকে সে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের বাহুল্য নাই। পরিপাটি জীবনে অভ্যস্ত ‘হ্যারল্ড ক্রিক’ নামের এই লোক চলে ঘড়ির ‘বিপ বিপ’ শব্দের ইশারায়। ভদ্রলোক খুব হিসাবি। হিসাবি মানে আক্ষরিক অর্থেই, তার সব কাজই গুনে গুনে করা। সে ব্রাশ করার সময় বত্রিশ দাঁত একেবারে চুয়াত্তর বার ঘষা হলো কিনা মাথায় রাখে, ট্যাক্স অফিস এজেন্টের তিতা চাকরি করে দায়িত্ব নিয়ে, বাস আসার একেবারে আগ মুহূর্তে স্টেশনে আসে প্রতিদিন; এমনকি হাঁটার সময় কদমও গুনে।
হ্যারল্ডের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় একজন মহিলা ন্যারেটর। কিন্তু দশ মিনিটের মাথায় দেখা যায়—সেই মহিলার গলা শুধু আমরাই না, হ্যারল্ড নিজেও শুনতে পাচ্ছে! হ্যারল্ডের প্রতিটা কাজ তার ব্রিটিশ বাচনে ধারাভাষ্যের মত বর্ণনা করে যাচ্ছে এই মহিলা। সাদাসিধা হ্যারল্ড প্রথমে বিব্রত হলেও এক সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ সেই মহিলা জানিয়ে যায়, তার মৃত্যুর বেশি বাকি নেই। বাধ্য হয়ে আসতে হয় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে।

ডাক্তার তার অবস্থাকে সিজোফ্রেনিয়া বলে দিয়ে নিষ্পত্তি করতে যান, কিন্তু হ্যারল্ডের একহারা প্রতিবাদে মাথা খাটিয়ে তাকে অন্য উপায় দেখিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু হ্যারল্ড তার মাথায় একজন ন্যারেটর এর কথা শুনতে পাচ্ছে, তাই ডাক্তার তাকে কোনো সাহিত্যবিশারদের সাথে দেখা করতে বলেন। এতে হয়ত সেই ন্যারেটরের গতিবিধি বোঝা যাবে।

এরকম আগ্রহ জাগিয়ে শুরু করার পর পরই ছবিটা একটা বোকামি করে ফেলে—আরেক নতুন চরিত্র নিয়ে আসে যার সাথে হ্যারল্ডের আপাত কোনো সম্পর্ক নাই, ফলে মনোযোগে বিক্ষেপ হয়। ক্যারেন আইফেল নামের এই চরিত্রটি একজন লেখিকার। তিনি লেখকদের প্রাচীন রোগ রাইটার্স ব্লকে ভুগছেন। এই নামকরা লেখিকার জন্য তার প্রকাশনি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিয়োগ দিয়েছে—যিনি তার ব্লক সারাতে সাহায্য করবেন।
উইল ফেরেল এর নন-কমেডিক অভিনয়ে হ্যারল্ড যতটা হাসি-আনন্দ দিচ্ছিল, তার কিছুই ‘এমা থমসন’ এর বাতুল মার্কা লেখিকার চরিত্রে পাওয়া যায় না। বরং সিনেম্যাটিক লেখকদের সমাধিমগ্ন ভঙ্গি আর সাহিত্য নিয়ে চতুর সব কিচিরমিচির বিরক্ত করে। অযাচিত কিছু প্রশ্ন ঘুরে মাথায়।

যদিও ছবির বাকি অংশে হ্যারল্ডের দিকেই মনোযোগ ছিল বেশি, তবুও এই লেখিকার সাথে হ্যারল্ডের সম্পর্ক ছবিটাকে একদমই ফ্যান্টাসি বানিয়ে ছেড়ে দিল। অনেকটা “গ্রাউন্ডহগ ডে (১৯৯৩)” এর আবহ—কিন্তু ওই ছবির মত এইখানকার মূল চরিত্রে ধীরে ধীরে কোনো পরিবর্তন আসে না, পুরো ছবিতেই সে একাকার।
ভাগ্য ভালো ছবিটাতে ডাস্টিন হফম্যান এর চরিত্রটা ছিল, যিনি কিনা নিজেই এই ছবির শেষ ভাগ দেখে মহা বিরক্ত।


হফম্যানের চরিত্রের নাম জুলস হিলবার্ট। সাহিত্যের এই প্রফেসরের কাছে হ্যারল্ড আসে পরামর্শ নিতে। তিনি প্রথমে হ্যারল্ডের আচরণে বিশেষ আগ্রহ না পেলেও তার মাথায় ঘুরতে থাকা ন্যারেটরের লেখকসুলভ শব্দচয়নে অবাক হয়ে যান। বিচক্ষণ ব্যক্তির মত হ্যারল্ডের সব কথাতেই সমান সন্দিহান তিনি। শেষ পর্যন্ত মুভির কাহিনি নিয়েই হতাশ হয়ে পড়েন এই লোক। জুলস হিলবার্টকে তাই এই ছবির পূর্বনিযুক্ত সমালোচক বলা যায়।

শিল্পের সর্বোচ্চ দাম কতদূর যেতে পারে?—সুন্দর প্রশ্ন। এই নিয়ে ছবিটাতে কোনো উত্তর নাই। তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু অন্তত প্রশ্নটা যখন উঠেছেই, তখন আরেকটু ঘাটাঘাটি করা ভালো দেখাত। হিলবার্টের মত তাই আমিও বিরক্ত হলাম খানিকটা, যদিও অন্য রকম কারণে।
তবে ওই যে রেশ থেকে যাওয়ার কথা বললাম—সেইখানে এই চলচ্চিত্র অনেক বেশি সফল। এক ধনী বন্ধুর হোম থিয়েটারে দেখেছিলাম ছবিটা; বাসায় আসার জন্য যখন রিকশা নিয়েছি—রাস্তার একেকজন মানুষের চেহারা মাথায় ঢুকছিল তীব্রভাবে। যেন আমি নিজে ক্যামেরা, আর আমাকে ধরে কে যেন লম্বা একটা ট্র্যাকিং শট নিচ্ছে।