সুজন মিয়া কাজে এসেছেন। তিনি বহুমুখী দক্ষতার অধিকারী। অবশ্য বহুমুখী দক্ষতা ছাড়া এই প্রজাতির মানুষদের বিশেষ যে কোনো উপায় আছে তাও নয়। মাত্র মাস তিনেক আগে তিনি এসেছিলেন আমার বাসায় বাথরুমের উপরে ফলস-সিলিংয়ের উপর এক অনাকাঙ্ক্ষিত পানিপ্রবাহের কারণে।

সেই অনাকাঙ্ক্ষিত পানি, ওইরকম একটা জায়গায়, এমনকি আমার মতো বাংলাদেশের হিসাবে উঁচালম্বা লোকের জন্যও দর্শনীয় ছিল না। বরং দ্রব্যগুণে তার যে সৌরভ সেটাই প্রথম আমার মনোযোগে এসেছিল। আরো এসেছিল ওই ফলস-সিলিং চুঁইয়ে ওই প্রবাহ পড়তে শুরু করার কারণে। ফলস-সিলিংগুলো যেভাবে বানায় তাতে পানি চোঁয়ানো খুবই সাধারণ বিষয়। বেশি ধ্বস্তাধ্বস্তি করলে আস্ত মানুষও ভেঙে গলে পড়তে পারে। তখন আমাদের পরিত্রাতা হিসাবে সুজনকে খুঁজে পাই।

সুজন মিয়ার কোনো সন্দেহ নাই যে এই কৃতকর্মের দায় কাউকেই দেয়া যায় না। এটা যথেষ্ট যত্ন করে না করার কারণে পাইপ নির্মাতা আর পাইপ লাগানেওয়ালাদের দেয়া যায়। কিন্তু এখন কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পানি যেহেতু নিম্নমুখী এই পানির উৎস ফ্ল্যাটের মালিককে অবশ্যই আমি খরচ করাতে পারি।

আমার তখন এই কাজের খরচদার খোঁজার থেকেও পরিত্রাণ অনেক জরুরি ছিল। সুজন মিয়া আমার আকুতি ও বাস্তবতা বুঝতে পেরে অনায়াসে একটা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল হাজির করতে পারতেন। বলাই বাহুল্য, শিক্ষিতদের মতো চতুর ও চৌর্যময় প্রপোজাল দক্ষতা তাঁর থাকবার কথা নয়। কিন্তু তাই বলে কোনো ধরনের ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট তিনি বানাতে পারবেন না তা ভাবার কোনো কারণ নেই। তিনি ওসব কিছু না করে একা পারবেন না বলে বের হয়ে গিয়ে আরেক চৌকষ, কম কথা-বলা, সম্ভবত কিছু প্রবীণ লোককে নিয়ে হাজির হলেন। ঘণ্টা দুয়েকের গুঁতাগুঁতি করে আমার ঘর পর্যন্ত পরিষ্কার করে দেবার উদ্যোগ নিয়েছেন। তার দরকার ছিল না। এই হলো সুজন মিয়া।

এদফা তিনি এসেছেন প্রক্ষালন ও স্নান কক্ষে। মান ও গুণ বিচারে, আগের কাজের তুলনায়, এটা রীতিমতো ফুলবাগিচায় পরিচারণের মতো। প্রক্ষালন কক্ষকে কারা ও কবে প্রসাধন কক্ষ নাম দিয়েছিলেন তা নিয়ে সুস্পষ্ট ও গভীর গবেষণা করা সম্ভব। হয়তো করা দরকারও। এতে সত্যবচন হয়েছে, কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটেছে, এবং মানমর্যাদা তো বেড়েছেই। আমাদের বাসার এই ঘরখানাকে প্রায় শয়নকক্ষই বলা যায়। মাপের বিচার বাদ দিলে, এর অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কারণে। সুজন বললেনও সে কথা। “এইখানে তো ঘুমায়াই থাকা যায়।”

আসলে ঘরটির স্থপতিরা যে লক্ষ্যে বানিয়েছিলেন সেই লক্ষ্যে এই বাসায় ব্যবহার হয় না। তারপরও পানির পাইপ ছুটে গেলে অশান্তি তো লাগেই। সেই অশান্তি দূর করতেই সুজন মিয়াকে তলব করা হয়েছে। তিনি কয়েক মিনিট তদন্ত করেই জানালেন যে তিনি পুরা কল বাদ দেবার কথা বলতে পারতেন, কিন্তু আমাকে তিনি তা বলবেন না। বরং তিনি জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা করবেন। করলেনও অল্প কিছু টাকাতে।

কিন্তু সপ্তাহখানেক পর যখন আবার ছুটে গেল, তখন সুজন মিয়ার পক্ষে আরো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া ছাড়া রাস্তা ছিল না। তবে তিনি আবারো আমার খরচ কমানোর দিকে মনোযোগ দিলেন। সারালেন অল্প টাকায়, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সমেত। তাঁর যুক্তি হলো, যেহেতু এই ‘ভাল’ কলে স্টিলের পানির পাইপ, সেটার সকেট থাকা উচিত ছিল আরো নিচে। যেহেতু তা নেই, তাই এই চাইনিজ স্টিলের পাইপগুলোর ঘেডিতে অনেক চাপ পড়ে। তাই ছুটে যায়। তাঁর ব্যাখ্যা নিজগুণে মনোমুগ্ধকর। আমার মনে হলো এই ব্যাখ্যারও একটা কনসালটেন্সি ফি থাকা উচিত। যাহোক সেসব তিনি নেননি, তিনি আধা পাইপের মূল্যমানের সঙ্গে তাঁর একটা হাতচালানো ফি নিয়ে চলে গেছেন। যাবার আগে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আমাদের বেশ নিজ নিজ পেশা নিয়ে গল্প হয়েছে। আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল “কে কত বড় চোর হবার সামর্থ্য রাখেন।”

তো সুজন কোনো একটা স্কুলের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছেন। সেই স্কুলের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রকল্প ব্যয় কত সেই খবরও সুজনের জানা। ৩৫ লাখ টাকা। উন্নয়ন-কর্মকাণ্ডের দুইটা বৈশিষ্ট্য প্রায় সকলেরই জানা। একটা হলো লাগাতার কনস্ট্রাকশন, এটা দেশের সকলে জানেন। ছেলে-বুড়ি সকলে। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সঞ্চয়ন, জমিয়ে রাখা। এই যেমন আমাদের এই প্রক্ষালন বা প্রসাদন কক্ষটি উন্নত। কেন? কারণ আমরা এটাকে জমিয়ে রেখেছি। এটাতে যে ধরনের প্রক্ষালনকেন্দ্রিক বা গোসলমূলক কাজকর্ম করার কথা তা গুরুত্বপূর্ণ হারে এখানে না-করা হয়ে থাকে। তো সেভাবেই জমিয়ে-রাখন হচ্ছে উন্নতির একটা অত্যাবশ্যকীয় ধাপ।

এখন কনস্ট্রাকশনকে যদি আমি মনোনিবেশ করি, তাহলে দেখতে পাব যে সেখানে নানাবিধ ভাগ থাকে, যাকে বলা হয় স্পেশালাইজেশন। এখানে অন্তত চারভাগে ওই স্কুলের কাজগুলোকে সাবলেট দেয়া হয়েছে। আচ্ছা, ভাল কথা, উন্নয়নের আরেকটা অবধারিত দিক হলো সাবলেটিং বা সাবকন্ট্রাক্টিং। কৃষিতে উন্নয়ন কীভাবে বোঝা যাবে? যাবে যে তরমুজ যে বানায়, আর যে খায়, তার মধ্যে ১৭ রকমের মধ্যস্বত্বভোগী থাকবে যেমন, তেমনি নানান বৃহৎ প্রকল্প ভাঙতে ভাঙতে, বিকেন্দ্রীকরণ যাকে বলে, একদম কুচি কুচি করে নানান জোয়ানমর্দ লোকের কাছে দিয়ে দেয়া হবে। এখানে এই সাবকন্ট্রাক্টিং বা বিকেন্দ্রীভবন হলো—রাজমিস্ত্রী, বিদ্যুৎমিস্ত্রী, প্লাম্বার, কাঠমিস্ত্রী। এই চারবর্গের মধ্যে একটা অন্তত ইংরাজি বর্গ না রেখে পার পাওয়া যাচ্ছিল না। আন্দাজ করাই যাচ্ছে যে সুজন মিয়া সেই ইংরাজি বর্গটাতেই পড়েছেন। পানিমিস্ত্রী বলেও যেটা সারা যেত।

তো ওই যে ৩৫ লাখ টাকা, সেটা হলো প্রকল্প ব্যয়। শিক্ষকদের কোনো এক আলাপ থেকে সুজন মিয়া কানে ধরে নিয়েছেন। অনুমান করা যেতে পারে, সুজন মিয়াকে ডেকে প্রকল্প ব্যয় বিষয়ক কোনো সভাতে চা-খাইয়ে এই আলাপ তোলেননি শিক্ষকেরা। সুজন মিয়ার সহ-সাবকন্ট্রাক্টর যাঁরা রয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও এটা সত্য হবার কথা। এমনকি যে মূল ঠিকাদার এই কাজ নিয়েছেন তাঁর সঙ্গেও ৩৫ লাখ টাকার বিষয়ে আলাপ হবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া যায় না। বরং তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে তিনি কত টাকায় এই কাজ করতে রাজি আছেন সেই বিষয়ে। কিন্তু ঠিকাদারের সঙ্গে দরকষাকষির সময়ে সুজনের আশপাশে থাকার কোনোই উপায় ছিল না। বরং ঠিকাদার ভালমতো ঠিকাদার হতে পারার পরই উপ-ঠিকাদারদের আবার ভাড়া করা হয়েছে। মেলা সব প্যাঁচ।

ফলে সুজন মিয়ার যে একটা গভীর জিজ্ঞাসা যে আসল ঠিকাদার কত টাকায় এই কাজ করছেন সেটাকে খুব ন্যায্য মানতে হবে। সুজন মিয়ার মতো মনোযোগী বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণসম্পন্ন মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রশ্ন দেখা দেয়া খুবই স্বাভাবিক। ওই সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে আমার নিজেরও পেট গুড় গুড় করছিল। তবে সুজন মিয়া নিজের অঙ্ক থেকে আন্দাজ করতে পারেন, আমিও পারলাম যে, উপ-ঠিকাদারদের চুক্তিগুলো কত টাকার হয়ে থাকতে পারে। সুজন মিয়ার প্রাপনীয় প্লাম্বিং কর্মকাণ্ডের মূল্যমান ঠিক হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সকল ধরনের মালসামান খরিদকরণসমেত। সুজনের সহ উপঠিকাদাররাও কমবেশি ২ লাখের আশপাশে যথাক্রমে সিমেন্ট-রঙের কাজ, বিদ্যুৎসামগ্রির কাজ ও আসবাবপত্রের কাজের চুক্তি পেয়েছেন।

আধা-ক্ষুব্ধ, আধা-বিশ্লেষক, আধা চোর-খোঁজারু, এবং পুরা গরিব সুজনের বেশ কয়েকটা কনসার্ন। এক, সে নিজে একা যদি সব করত লাখ পনেরো টাকায় স্কুলটার সব সমস্যা ঠিক করে দিতে পারত। দুই, ঠিকাদার (ব্যাটা) আসলে কত মার(তে)ছে তার আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তিন, টাকার টানাটানিতে টাইলসের পেটের মধ্য দিয়ে পানির পাইপ চলে যাচ্ছে ইত্যাদিতে দেখতে আর সুন্দর থাক(তে)ছে না। চার, স্কুলের শিক্ষকেরা (মানে প্রশাসকেরা) যে কত টাকা কী করল সেই বিষয়েও শুধু আন্দাজ করা যাচ্ছে, হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচ, স্কুলের শিক্ষকরা যদি এরকম ‘চোর’ হয় তাহলে দেশের কী হবে! ছয়, তার ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার বিলও তো ছয় মাসের মধ্যে পাবার কোনো লক্ষণ নাই, যেহেতু এখন পর্যন্ত, প্রায় শেষের পথে, ২০ হাজারের বেশি টাকা তার হাতে আসে নাই।

এই জটিল চিন্তিত অবস্থায় সুজনকে সিঁড়ির গোড়ায় আমি বিদায় দিলাম। এবং সুজন বিলক্ষণ জানেন যে আমিও শিক্ষকতাই করি। ফলে বিদায় দেবার আগে, একবার মৃদুস্বরে জানালাম যে এইরকম কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করার মতো সক্ষম শিক্ষক আমি না।

শেষের পরের টীকা: ধরা যাক সুজনের নাম কল্পিত রাখব না। ধরা যাক তার নাম নুরু মিয়া এবং সেটাই সঠিক নাম। এমনকি এও ধরা যাক যে সেই সঠিক নামটি প্রকাশিত হবার পর, ওই স্কুলের কর্তৃপক্ষ কিংবা আসল ঠিকাদার এই রচনা পড়লেন। তাতে তাঁর ওই ১ লাখ ৬০ হাজারের বিলই আটকে গেল। কিংবা এমনকি হয়তো তিনি হামলারও শিকার হলেন। তাহলে যদি আমি প্রমাণ করতে পারি, যে কর্তৃপক্ষ এই রচনা পড়েছেন, তাহলেই, আশা করা যায়, নুরু মিয়ার প্রতি সুবিচারেরও ব্যবস্থা করা যাবে। দেশে যে কেবল উন্নয়নের মহাজোয়ার চলছে তাই নয় শুধু। বরং, এখানে গণতন্ত্র প্রায় আমৃত্যু সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেঁড়ে বসেছে। আর ন্যায়বিচারের কোনো সীমা নাই। ফলে আমি নুরুকে নিয়ে একটুও চিন্তিত না হয়ে এই রচনা শেষ করতে পারলাম।

আদাবর, ঢাকা, ৭ অক্টোবর  ২০২১
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. মির্জা তাসলিমা সুলতানা, ২০১৬