যতই দিন যাচ্ছে, ততই প্লাস্টিক আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বা ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর মতো সবকিছুতেই ব্যবহার হচ্ছে প্লাস্টিক। তবে ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশ, বন্যপ্রাণী, সামুদ্রিক জীব এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

এদিকে যত বেশি প্লাস্টিক উৎপাদন হচ্ছে, সেই অনুসারে উৎপন্ন প্লাস্টিক পরিবেশের সাথে মিশে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। কেননা, প্রাকৃতিক ভাবে প্লাস্টিকের রাসায়নিক বন্ধন ভেঙে পরিবেশের সাথে মিশে যেতে কয়েকশো থেকে শুরু করে হাজার বছর সময় পর্যন্ত লাগতে পারে।

এদিকে প্রতিদিনই প্রায় ৮ মিলিয়ন প্লাস্টিকের টুকরা বর্জ্য হিসেবে সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। সমুদ্র ছাড়াও প্রকৃতিতে বিভিন্ন ভাবে ফেলে দেয়া প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকের সাথে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর শরীরে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

প্লাস্টিক বর্জ্যের মাধ্যমে হরমোনের সমস্যা, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল রোগ মানুষের শরীরে দেখা দিতে পারে।

তবে গরুর পাকস্থলিতে যেসব অণুজীব বা মাইক্রোব আছে, তা দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু প্লাস্টিক গলানো সম্ভব। বিশেষ করে এর মাধ্যমে পলিইথিলিন টেরেপথেলেট বা পিইটি (PET) প্লাস্টিক রিসাইকেল করা যাবে।

এ ধরনের প্লাস্টিক মূলত সোডা বোতল, সিন্থেটিক ফেব্রিক এবং খাবার প্যাকেজিংয়ে ব্যাবহার করা হয়।

বিজ্ঞানীরা এই অণূজীব প্রাণীর রুমেন থেকে বের করা একধরনের তরল পদার্থ থেকে আবিষ্কার করেছেন। রুমিন্যান্ট বা যেসব প্রাণী জাবর কাটে, তাদের পাকস্থলীর সবচেয়ে বড় অংশ হলো রুমেন। রুমিন্যান্ট প্রাণীদের মধ্যে গরু এবং ভেড়ার মতো সেসব প্রাণী রয়েছে, যাদের খুর থাকে আর যারা তাদের তৃণ খাদ্য হজম করার জন্যে অণুজীবের সাহায্য নিয়ে থাকে।

মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশ করা তথ্য অনুযায়ী, রুমেন মূলত অণুজীব জন্মানোর ক্ষেত্রে একধরনের ইনকিউবেটর হিসেবে কাজ করে, যা গরু বা অন্যান্য রুমিন্যান্ট প্রাণীদের খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে। গবেষকরা সন্দেহ করেন যে, গরুর রুমেন-এ থাকা অণুজীবগুলি পলিয়েস্টার হজম করার ক্ষমতা রাখে। পলিয়েস্টার এমন এক পদার্থ, যার অণুগুলি তথাকথিত ‘এস্টার গ্রুপ’ দ্বারা সংযুক্ত।

বিশেষ করে নিরামিষভোজী হওয়ার কারণে গরু তার খাদ্যের মাধ্যমে একধরনের প্রাকৃতিক পলিয়েস্টার গ্রহণ করে থাকে, যার নাম কিউটিন। সিন্থেটিক পলিয়েস্টার হিসেবে পিইটি (PET) প্লাস্টিকও প্রাকৃতিক কিউটিনের মতো একই ধরনের রাসায়নিক গঠনে তৈরি। এ নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তাদেরই একজন ডরিস রিবিটস। তিনি ভিয়েনায় অবস্থিত ‘ইউনিভার্সিটি অফ ন্যাচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস’-এর সিনিয়র সায়েন্টিস্ট। তিনি বলেন, প্রাকৃতিকভাবে কিউটিকল-এ যা থাকে, তার পুরোটাই কিউটিন দ্বারা তৈরি। উদ্ভিদ কোষ প্রাচীরে মোমের মতো মসৃণ যেই আবরণ থাকে, সেটাই কিউটিকল। এটি টমেটো এবং আপেলের খোসার মতো প্রকৃতিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।

ড. ডরিস রিবিটস

রিবিটস জানিয়েছেন, “ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া যখন এই জাতীয় ফলে প্রবেশ করতে চায়, তখন তারা এমন এনজাইম ছড়ায়, যা কিউটিন নামের এই পদার্থের রাসায়নিক বন্ধন আলাদা করে ফেলে। বিশেষ করে ‘কিউটিনেসিস’ নামে এক ধরনের এনজাইম কিউটিনকে হাইড্রোলাইজ করে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে একটি রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, যার ফলে পানির অণুর মাধ্যমে কিউটিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভেঙে যায়।”

গত ২ জুলাই ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন বায়োঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি’ জার্নালে এ নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। গবেষকরা নতুন এই গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন যে, গরুর রুমেন থেকে পাওয়া অণুজীব কেবল পিইটি প্লাস্টিকই নয়, বরং আরও দুই ধরনের প্লাস্টিকের রাসায়নিক বন্ধন ভাঙতে পারে। এই দুই ধরনের প্লাস্টিক হলো, কম্পোস্টেবল প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহৃত পলিবিটিউলিন অ্যাডিপেট টেরেফথ্যালেট বা পিবিএটি (PBAT) এবং উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত উপকরণ দিয়ে তৈরি প্লাস্টিক পলিথিলিন ফিউরেনোওয়েট বা পিইএফ (PEF)।

রুমেনে জন্ম নেয়া এসব অণুজীব যেভাবে প্লাস্টিক খায়, তা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে একদল গবেষক কয়েক ধরনের প্লাস্টিক ৩ দিনের জন্যে রুমেন থেকে নির্গত তরলে রেখে দিয়েছিলেন। এরপর তারা প্লাস্টিক থেকে বের হওয়া উপজাত দ্রব্য বা বাইপ্রোডাক্ট বিশ্লেষণ করেন। এর মাধ্যমেই তারা বোঝার চেষ্টা করেছেন যে, কীভাবে জীবাণুগুলি প্লাস্টিকের উপাদানগুলি ভেঙে দিচ্ছে। গবেষক দল জানিয়েছে যে, রুমেন থেকে নির্গত তরল পিইএফ (PEF) প্লাস্টিকের রাসায়নিক বন্ধন সবচেয়ে দক্ষতার সাথে ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু বাকি ৩ ধরনের প্লাস্টিকের রাসায়নিক বন্ধনও পাল্টে দিয়েছে।

প্লাস্টিক ভাঙার পেছনে ঠিক কোন অণুজীব দায়ী, তা শনাক্ত করার জন্যে গবেষকদের দল পরবর্তীতে রুমেন থেকে নেয়া তরল থেকে ডিএনএ স্যাম্পল নেয়। সেখানে থাকা প্রায় ৯৮% ডিএনএ-ই ছিল ব্যাকটেরিয়ার। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেই পর্বের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গিয়েছে, সেটার নাম হলো সিউডোমোনাস। এই পর্বের বেশ কয়েকটি প্রজাতি অতীতেও প্লাস্টিক ভাঙার ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছিল।

রিবিটস এবং তার গবেষক দল প্লাস্টিক খাদক ব্যাকটেরিয়াকে সম্পূর্ণভাবে শনাক্ত করতে চান। একইসঙ্গে তারা চিহ্নিত করতে চান যে, ঠিক কোন এনজাইমের মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিকের উপাদান ভাঙে। যদি তারা এনজাইম শনাক্ত করতে পারেন, তবে সেটার মাধ্যমে প্লাস্টিক রিসাইকেল করা সম্ভব হতে পারে। আর তা হলে ভবিষ্যতে সেই এনজাইম কৃত্রিম ভাবে অধিক পরিমাণে উৎপাদন করা শুরু করা যাবে।

এভাবে এই অণুজীব বা এনজাইম সংগ্রহ করার জন্যে আর গরুর পাকস্থলির প্রয়োজন হবে না। রিবিটস জানান, অনেক কম খরচে এবং সহজে এই এনজাইম উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

রিবিটস এবং তার গবেষক দল ইতিমধ্যেই রিসাইকেল করার একটি পদ্ধতির জন্যে পেটেন্টের আবেদন করেছেন। এই পদ্ধতিতে টেক্সটাইল উপকরণ একে একে বিভিন্ন এনজাইমের সংস্পর্শে আসে। দলটি এর আগের এক গবেষণায় এই এনজাইমগুলি চিহ্নিত করেছিল।

এনজাইম-এর প্রথম ব্যাচ উপাদানের মধ্য থেকে কাপড়ের তন্তু খেয়ে ফেলে, এবং এর পরের ব্যাচ কিছু নির্দিষ্ট পলিমার খেয়ে ফেলে। এর কারণ হচ্ছে, প্রত্যেকটা এনজাইমই কিছু নির্দিষ্ট রসায়ানিক বন্ধনে তৈরি উপাদান খেয়ে ফেলতে পারে। তবে এর বাইরে অন্য কোনো উপাদান তাদের পক্ষে খাওয়া সম্ভব না। এই পদ্ধতিতে একাধিক উপাদান থাকা টেক্সটাইল পণ্যে অন্যান্য উপাদানের কোনো ক্ষতি না করেই রিসাইকেল করা সম্ভব বলে জানান রিবিটস।

ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োসিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মলিকিউলার বায়োলজিস্ট এবং বায়োটেকনোলজিস্ট ডিউড লেভিন বলেন, নতুন এই গবেষণা থেকে গরুর রুমেন-এর মাধ্যমে প্লাস্টিক ভাঙতে পারে, এমন এনজাইম পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো। তবে এমন এনজাইম প্রকৃতির বিভিন্ন স্থানেই পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

লাইভ সায়েন্স অবলম্বনে যাইয়ার আযান