ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে (২০১৮) নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লেখক রিস বোয়েনের দ্য টাসকান চাইল্ড বের হয়েছে। গল্পের একটা বড় অংশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেন্দ্রিক হলেও এটাকে কেবলই যুদ্ধের উপন্যাস বলা যায় না। গল্পে একটা বড় অংশ নিয়ে আছে প্রেম আর রহস্য। চাইলে এটাকে প্রেমের বা রহস্যের উপন্যাস বলা যায়।

উপন্যাসে দুই সময় এবং প্রজন্মকে লেখক সমান্তরালে দেখিয়েছেন। গল্প শুরু হয়েছে হিউগো ল্যাংলিকে দিয়ে। হিউগো অভিজাত বংশের সন্তান, পেশায় বম্বার পাইলট। তার স্ত্রী আর একটা মেয়ে আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সে মিত্রশক্তির হয়ে যখন ইতালিতে যুদ্ধ করছিল তখন তাদের প্লেনে হামলা হয়। তার সঙ্গীরা সবাই মারা যায়। জীবন বাঁচিয়ে কোনোভাবে প্যারাসুট নিয়ে লাফ দেয় সে প্লেন থেকে। তার এক পায়ে মারাত্মক জখম হয়। সৌভাগ্যবশত সে প্রাণে বেঁচে যায়।


অর্জয়িতা রিয়া


সোফিয়া বার্টোলি ছিল ইতালির সালভাতোরের বাসিন্দা। এক ছেলে আর তার স্বামীর দাদিকে নিয়ে থাকে সেখানে। তার স্বামী অক্ষশক্তির (অক্ষশক্তির প্রধান তিনটি রাষ্ট্র ছিল জার্মানি, ইতালি ও জাপান) হয়ে  যুদ্ধে গেছে। তবে অনেকদিন হল সে ফিরে নাই। এর মধ্যে কোনো খোঁজ খবরও নেয় নাই তাদের। সোফিয়ার ধারণা সে হয়ত মারা গেছে।

হিউগোর প্লেন ওই অঞ্চলেই অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল। সোফিয়া হিউগোকে ঘটনাস্থলে জখম অবস্থায় দেখতে পায়। তার তাকে সাহায্য করা উচিৎ কিনা কোনোরকম না ভেবে হিউগোকে সেখান থেকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যায় এবং লুকিয়ে রাখে।

প্রথম যেদিন সোফিয়া তার সঙ্গে কথা বলতে আসে, হিউগোর শরীরের অবস্থা তত ভাল না, সে বিছানায় শুয়ে ছিল। পায়ে ভয়ঙ্কর ব্যথা। ঝাপসা চোখে দেখছিল কেউ একজন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

…সে একজন নারী। কালো রঙের পোশাক পরে আছে, মাথা আর কাঁধ ওড়না দিয়ে ঢাকা। তার কাছে যেই ঝুড়িটা ছিল সেটা সে এখন সামনে ধরে রেখে নিজেকে রক্ষা করছে।

সে তার আঞ্চলিক ইতালীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী জার্মান? ডাচ?”

“না, আমি জার্মান না, ইংলিশ।”…

“আমি বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কে শুনেছি। জানি না এটা কী ছিল। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম জার্মানরা না আবার কিছু উড়িয়ে দেয়।…জার্মানদের তাড়ানো আপনাদের জন্যে সহজ হবে না। আর এখানে থাকাটাও আপনার জন্যে নিরাপদ না, আপনাকে দক্ষিণে যেতে হবে।…”

“আমি হাঁটতে পারি না, মানে আমার পায়ে গুলি লেগেছে। এই ক্ষত যতদিন না সারে ততদিন আর এখন কী করা উচিত না জানা পর্যন্ত আমার একটা লুকানোর জায়গা দরকার। …”

“আমি একা হলে হ্যাঁ বলতাম, ঝুঁকি নিতাম। কিন্তু আমার ছোট একটা ছেলে আছে, আমার স্বামীর দাদি আমার সাথে থাকে, ওদেরকে তো আমার রক্ষা করতে হবে।”

হিউগোর দেশ অর্থাৎ ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির শত্রুপক্ষ ছিল। সোফিয়া তা জেনেও হিউগোকে জার্মানদের হাতে তুলে দেয় নি। বরং তাকে আরো নিরাপত্তার জন্যে একটা ভাল জায়গা খুঁজে দিয়েছে। সোফিয়া প্রতিদিন গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে, খোঁজ খবর নেয়, এমনকি যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে। সে হিউগোকে পরামর্শও দেয়, যত দ্রুত পারে সে যেন দক্ষিণের দিকে যায়, কারণ জার্মানরা এর মধ্যেই তাদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।

ধীরে ধীরে তাদের দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। এবং একপর্যায়ে তারা একে অন্যের প্রেমে পড়ে।

গল্পের দ্বিতীয় সময়টা হিউগোর মেয়ে জোয়ানাকে নিয়ে। বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনো তেমন একটা ভাল ছিল না। সে এইবার বাড়িতে ফিরেছে হিউগোর মৃত্যুর পর। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করতে।

বাড়িতে সে একটা চামড়ার বাক্স পায়। বিচিত্র সব জিনিসে ভর্তি। ওগুলির সাথে ইতালীয় ভাষায় লেখা একটা চিঠি ছিল। চিঠিটা লিখেছে তার বাবা। যাকে লেখা হয়েছে, তার বাবা তাকে শুরুতে ইতালীয় ভাষায় সম্বোধন করেছে ‘মিয়া কারিসিমা সোফিয়া’ নামে, যার অর্থ ‘প্রাণপ্রিয়া সোফিয়া’’। বাক্যটা দেখে জোয়ানা একটু অবাক হয়। তার বাবা তার মাকে ছাড়া অন্য আর কাউকে এভাবে ডাকতে পারে তা অভাবনীয়। চিঠির ভদ্রমহিলা থাকেন ইতালিতে, নাম, সোফিয়ার বার্টোলি। চিঠির পুরোটাই ইতালীয় ভাষায় লেখা। জোয়ানার পড়তে অসুবিধা হচ্ছিল। সে একটা ডিকশনারি এনে একেকটা শব্দের অর্থ বের করে পড়তে শুরু করে।

প্রিয় সোফিয়া,

তোমাকে প্রতিদিন মনে পড়ে। মনে হয় আমি তোমার সাথে ছিলাম তা না জানি কত কত মাস আগে। হাসপাতালের ওই পুরোটা সময়, জানতাম না তুমি নিরাপদে আছো কিনা, তোমাকে লিখতে কত ইচ্ছা করত কিন্তু সাহস  হত না। কিন্তু, একটা ভালো খবর আছে। তোমার স্বামী যদি আর বেঁচে না থাকে তাহলে আমরা চাইলেই বিয়ে করতে পারি। আমি শেষমেশ যখন ইংল্যান্ডে যেতে পেরেছি, গিয়ে জেনেছি আমার স্ত্রীও অন্য কাউকে পেয়েছে।… তার মানে হচ্ছে বীভৎস যুদ্ধটা শেষ হওয়া মাত্রই আমি তোমার কাছে আসব, প্রিয়তমা। এর মধ্যে জানতে চাই আমাদের সুন্দর ছেলেটা নিরাপদে আছে কিনা। তাকে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে যেখানে শুধু তুমিই ওকে খুঁজে বের করতে পারবে।

চিঠিটা পড়ে জোয়ানা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তার বাবার আরেকটা পরিবার আছে, আরেকটা সন্তান আছে! যে সন্তান আবার কোথায় আছে কেমন আছে তা নাকি শুধু তার বাবা আর ওই মহিলাই জানে।  আজকে এত বছর পরে নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে ওই মহিলা খুঁজে বের করেছে।

জোয়ানা সোফিয়া বার্টোলি আর তার বাবার ওই সন্তানের ব্যাপারে বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়ে। তাদের খোঁজে সে ইতালিতে যায়।

জোয়ানা বাবার ভালোবাসা কখনোই সেভাবে পায় নি। বিশেষ করে তার বাবার মৃত্যুর পর এই কথা মনে করে সে আরো বেশি কষ্ট পাচ্ছে। সে চায় মাথা থেকে সব কিছু ঝেড়ে ফেলে নতুন করে সব কিছু সুন্দরভাবে শুরু করতে। সে তার বাবার ব্যাপারে বলে, “আমি সারাজীবন চেয়েছি সে আমাকে ভালোবাসুক। মনে হয় সে বাসত, তবে তার মতো করে, মায়ের মত না। আমার মনে পড়ে না কখনো সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি যখন ছোট ছিলাম সে আমাকে তার হাঁটুর উপর বসিয়ে বই পড়ে শোনাতো। কিন্তু তখন আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমার মনে হয় না সে জানত কীভাবে একজন ভাল বাবা হতে হয়।”

বাবার স্মৃতি বলতে জোয়ানার শুধু মনে পড়ে ল্যাংলি হলে তাদের দারোয়ানের ছোট ঘরে তার বাবা মা সে অার তাদের জীবন কেমন কষ্টকর ছিল। কোনো সুখের স্মৃতি মনে পড়ে না।

জোয়ানা যখন ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তখনকার সময়টা ১৯৭৩। ওদিকে ১৯৪৪ সালে গল্পটা ফিরে গেছে হিউগো প্লেন দুর্ঘনার সময়টাতে। সোফিয়া তাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির সাধারণ মানুষেরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, খাবার বলতে যে ছিল শুধুই জংলি মাশরুম আর সবুজ উদ্ভিদ—তার একটা আভাস পাওয়া যায়। এটা স্পষ্টতই জোয়ানার সময়ের সঙ্গে তার বাবার সময়ের বৈপরীত্যকে টেনে আনে। জোয়ানা একটা প্রাচুর্যের মাঝে বাস করছে। এখানে মাংস, চিজ, পাস্তা, অ্যালকোহল যখন যা সব পাওয়া যায়। কাউকে না খেয়ে মরতে হয় না।

টাসকান চাইল্ড-এর পুরোটাই লেখা প্রথম পুরুষে। তবে অনেক ঘটনার বর্ণনা জোয়ানা করেছে। ক্রিটিকরা এই উপন্যাস নিয়ে বলছেন, গল্পের গতিময়তা এত স্বাচ্ছন্দ্যময় যে মনে হবে যেন এখনও ওই জলপাই বনগুলিতে জার্মানরা হামলা করার জন্য ওৎ পেতে আছে।

উপন্যাসের গল্প যতটা ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু নিয়ে তার থেকেও অনেক বেশি হিউগো আর সোফিয়ার মধ্যে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা প্রেম নিয়ে। মনে হবে একটা ইতিহাস যেন প্রেমের সঙ্গে যুগপৎ এগিয়ে যাচ্ছে।

শুরুটা বোয়েন এভাবে করেছেন, ‘’ডিসেম্বর ১৯৪৪, সঙ্গত কারণেই তার প্রায় মরা মরা অবস্থা। হিউগো ল্যাংলি বিষয়টাকে খুব গুরুত্বহীনভাবে নিল।’’ পড়ে মনে হয় এইটা আর বাকি দশটা যুদ্ধের উপন্যাস থেকে ভিন্ন কিছু না। কিন্তু, বোয়েন এখানেই তার চরিত্রগুলিকে যুদ্ধের বাইরেও আরো অনেক বড় একটা জায়গায় নিয়ে গেছেন। তার পাঠকরা ভাবছেন, বোয়েন হয়ত তার জোয়ানা চরিত্রটাকে নিয়েই সামনে আরো আগাবেন। এই ব্যাপারে তার পরিকল্পনা থাকাটা স্বাভাবিক।

জোয়ানা যেভাবে ইতালি ফিরে গিয়ে সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খুব দ্রুতই মানিয়ে নিয়েছে তা এই উপন্যাসের অন্যতম অসাধারণ দিকগুলার একটা। সে এমনভাবে অভ্যস্ত হয়েছে যে তা হওয়ার মধ্যে সেই চেষ্টার ছাপ পর্যন্ত নেই, বরং মনে হয় এটা জোয়ানার জন্য খুব সহজ ছিল, স্বাভাবিক ছিল। সে চাইলে থাকবে, বা যাবে, বা হয়ত এমনভাবেই জীবনের যা যা জানা হয় নি একে একে তা জানবে।

টাসকান চাইল্ড-এর ভারি প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সহজতা বজায় রাখা অবশ্যই বোয়েনের লেখক হিসেবে দক্ষতাকে সামনে নিয়ে আসে। তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন বাচ্চাদের বই দিয়ে। তারপর একসময় রহস্য গল্প লিখতে শুরু করেন। এই সম্পর্কে একটা ইন্টারভিউতে বোয়েন বলেন, আমার যদি রহস্য পড়তে ভাল লাগে তাহলে লিখতে পারব না কেন!

সম্প্রতি আরেকটা ইন্টারভিউতে এই উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিজের চোখে দেখেছেন। তার বাবা আর চাচা দেশের বাইরে যুদ্ধ করছিল। চারিদিকে অভাব, নিষ্ঠুরতা দেখে খুব ভয় পেতেন। অপেক্ষা করতেন কবে এই পরিস্থিতি আবার আগের মত হবে। সেই অভিজ্ঞতাই এই উপন্যাসের প্লট তৈরিতে কাজে এসেছে।

বোয়েনের প্রকৃত নাম জ্যানেট কুইন হারকিন। বড়দের জন্যে রহস্য উপন্যাস লেখা শুরু করেন তিনি ছদ্মনাম রিস বোয়েন দিয়ে। জন্মেছেন ইল্যান্ডের বাথ-এ ১৯৪১ সালে। লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিবিসি’তে যোগ দেন ড্রামা স্টুডিও ম্যানেজার হিসেবে। তারপর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে দুবছরের মত কাজ করেন, সেখানেই তার স্বামী জন কুইন হারকিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর তারা বিয়ে করে সান ফ্রান্সিসকোতে স্থায়ী হন। সেখানকার বিবিসিতে যোগ দিয়ে বোয়েন আবার লেখালেখি শুরু করেন।

রিস বোয়েন, স্বামী জনের সঙ্গে

চেতনা এবং সময়ের বিস্তৃতি আছে এমন লেখা পড়তে ভালোসাবেন বোয়েন। তার লেখাতেও এই প্রভাব চোখে পড়ে। রহস্য উপন্যাস বা বাচ্চাদের বইয়ের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু সিরিজও লিখেছেন। সেগুলি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

এই সিরিজগুলির একটা কনস্টেবল ইভান ইভানসকে নিয়ে। বোয়েনের ভাবনায় তিনি স্নোডোনিয়ায় থাকেন। এই ইভান ইভানস সিরিজে ১৯৯৭ থেকে শুরু করে ২০০৬ পর্যন্ত তিনি বই লিখেছেন ১০টা।

তিনি মলি মারফি সিরিজ লিখতে শুরু করেন এলিস আইল্যান্ডে ঘুরতে গিয়ে। বোকাসোকা মলি মারফি আয়ারল্যান্ড থেকে পালায়। পরবর্তীতে দেখা যায় সে একটা খুনের দায়ে ফেঁসে গেছে। এই  সিরিজে ২০০১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত তিনি বই লিখেছেন ১৭ টা।

লেডি জর্জিয়ানা  বা ‘জর্জি’ সিরিজে ২০০৭ থেকে  ১০১৮ পর্যন্ত লিখেছেন ১২ টা বই। লেডি জর্জিয়া ব্রিটিশ সিংহাসনের ৩৪তম উত্তরাধিকারী। কিন্তু অর্থবিত্ত বলে তার কিছুই নেই। সে নিজের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে।

লেখক হিসেবে বোয়েন শুরু থেকেই সফল। তার প্রথম বই পিটার পেনি’স ড্যান্স (‌১৯৭৬, পিকচার বুক)  এর জন্য অনেকগুলি পুরস্কার পান তিনি।  এই বইটাই মূলত তাকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

১৯৭৬ থেকে ২০১৮, সব মিলিয়ে তিনি ৫৪টির মত বই লিখেছেন। ২০১৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপন্যাস ‘ইন ফারলেই ফিল্ড’ বেশ প্রশংসিত হয়েছে।