উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আটলান্টিক পার করে দাস বাণিজ্য যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন অনেক সাদা চামড়ার মানুষেরা আতঙ্কিত হয়েছিল। তারা ভয় পেয়েছিল স্বাধীন হয়ে যাওয়া কালো মানুষেরা সমাজে আতঙ্ক তৈরি করবে। এই তথাকথিত ‘নিগ্রো সমস্যা’ কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে এলিটেরা অনেক সময় ব্যয় করেছিল। এই সময়ে যে জনপ্রিয় সমাধান উঠে এসেছিল সেটি ছিল বর্ণ সাদাকরণ বা ‘সাদাকরণ’ আদর্শ।

সাদাকরণ আদর্শের সমর্থকরা বিশ্বাস করত যে যদি ‘সুপিরিয়র’ সাদারা নিচু শ্রেণীর কালোদের সাথে মিশতে অনুপ্রাণিত হয় তাহলে কালোরা সাংস্কৃতিকভাবে, জিনগতভাবে অগ্রসর হবে অথবা কয়েক প্রজন্মের মধ্যে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

কেউ কেউ এও বিশ্বাস করত যে এই প্রক্রিয়া সফল করার জন্য ইউরোপ থেকে ক্রমাগত অভিবাসীদের আগমন প্রয়োজন।

যদিও দুইটি আদর্শই বর্ণবাদ এবং সাদার আধিপত্য থেকে এসেছে, কোনো কোনো দেশ বর্ণের মিশ্রণের চেয়ে পৃথক করাকেই বেছে নেয়। তারা শেষপর্যন্ত বর্ণের মিশ্রণকে নিষিদ্ধ করে। এটি বাইরের দিক থেকে ভিন্ন হলেও দুটিরই পরিণতি একই ছিল। এই দেশগুলি আরো ইউরোপীয় আমদানি করছিল এবং একই সাথে কালোদের নিধন ও তাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছিল।

সাদাকরণ আরোপ করেছিল অনেকগুলি দেশ। তার মধ্য থেকে ৫টি দেশের কথা এবং কী ফলাফল ঘটেছিল অনুবাদে তা এখানে থাকছে। মূল: আঁদ্রে মুর।

ব্রাজিল

ওই সময়ে প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানভিত্তিক দুটি বর্ণবাদী বিশ্বাস থেকে ব্রাজিলে সাদাকরণ আদর্শটি সমর্থন পেয়েছিল। একটি হলো সামাজিক ডারউইনবাদ। এটি ছিল সমাজ অথবা বর্ণের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নির্বাচন বিষয়ে ডারউইনের তত্ত্ব। আরেকটি ছিল আরিয়ানিজম বা আর্যবাদ। এটির বিশ্বাস ছিল সব সংস্কৃতির মধ্যে আর্যবাদ সবার ওপরে। ১৮৮০ সাল থেকে এই দুই ধারণাকে একসাথে করে ব্রাজিলের ক্ষমতাবান এলিটদের একটা অংশ বিশ্বাস করত জাতিকে সাদাকরণ তথা উন্নত করা যাবে, যদি সাদারা কালোদের সাথে মেশে বা বিয়ে করে।

ব্রাজিলকে আরো সাদা করা নিশ্চিত করতে দেশে কালো মানুষের অভিবাসন নিষিদ্ধ করে কয়েকটি আইন পাস হয়। ১৯৪৫ সালে ব্রাজিলের সরকার দেশে ইউরোপীয় অভিবাসীদের আগমনকে সুবিধা দেওয়ার জন্য আদেশ জারি কর: “অভিবাসীদের আগমনের ক্ষেত্রে, জনগণের জাতিগত মিশ্রণ সংরক্ষণ এবং উন্নত করার প্রয়োজনে, তাদের ইউরোপীয় পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য সুবিধাজনক হিসেবে বিবেচিত হবে।”

ব্রাজিলের বর্ণবাদী মিশ্রণের এজেন্ডার কারণে আফ্রিকান উত্তরাধিকারের ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে হালকা বর্ণ বেশি মূল্যায়িত হত। এবং বেশি কালো চামড়ার লোকেরা হালকা চামড়ার সঙ্গী খুঁজত। কারণ ওপরের দিকে ওঠার গতি অর্জনের নিশ্চিত উপায় ছিল সঙ্গীর চেয়ে বেশি সাদা ত্বক।

কিউবা

বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে আফ্রো-কিউবানরা খুব উৎসাহের সাথে স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। তাদের আশা ছিল বর্ণ নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক জাতি গঠিত হবে।

কিন্তু ১৮৯৮ থেকে ১৯০২ পর্যন্ত এবং ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ কিউবাতে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছিল এবং তারা একটি বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন দেয় এবং রক্ষা করে।

এই শাসকগোষ্ঠী জাতি ‘সাদাকরণ’ বা ‘ব্ল্যানকুয়েমিয়েনতো’ নীতি অনুসরণ করে। ক্ষমতাবান এলিটরা আন্তঃবর্ণ বিবাহকে উৎসাহিত করে এবং কিউবান সরকার ইউরোপীয়দের এনে অভিবাসী আইন তৈরি করতে এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে।

রাষ্ট্রকে সাদা করার জন্য এবং জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্র থেকে কালোদের বাদ দেয়ার জন্য বেশিরভাগ ইউরোপীয়কেই আনা হয় স্পেন থেকে। ‘অ-শেতাঙ্গ’দের অভিবাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

ইউরোপিয়ান ডিএনএতে এত ব্যাপক বিনিয়োগের পরেও অনেক অভিবাসীই কিউবাতে থাকে নি। তারা শুধু চিনি চাষের উদ্দেশ্যেই এসেছিল এবং মৌসুম শেষে তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যায়।

যদিও ১৯০২ থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে ৭ লক্ষ ৮০ হাজার স্প্যানিয়ার্ড কিউবাতে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে শুধু ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে গিয়েছিল।

১৯২০ এর দশকের শেষে ‘সাদাকরণ’ জাতীয় নীতি হিসেবে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়। এটি আফ্রো-কিউবানদের জনসংখ্যার পরিবর্তন ঘটিয়ে এবং তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ করে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতি করেছিল।

জ্যামাইকা

১৮৩৪ সালের ১ আগস্ট জ্যামাইকাতে দাস প্রথা বিলুপ্তির পরে অনেক খামার-মালিক আসন্ন শ্রমিক সংকটের কথা চিন্তা করে ভয় পেয়েছিল। আর আপাতভাবে দ্বীপটিতে নতুন মুক্তি পাওয়া অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আফ্রিকানরা টাকার বিনিময়ে কাজের জন্য উপযুক্ত ছিল না।

এর ফলে, আগের দাস-মালিকেরা এই সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজছিলেন। একটি সমাধান ছিল লর্ড সীফোর্ডের দ্বারা ইউরোপীয় বন্দোবস্তের প্রতিষ্ঠা। তিনি তখন সেইন্ট জেমসের যাজকপল্লীর ওয়েস্টমোরল্যান্ডে অবস্থিত মন্টপেলিয়া স্টেট এবং শেটলউড পেনের মালিক ছিলেন। চাকরি, জমি এবং বাড়ি দেয়ার প্রতিজ্ঞা করে এক হাজারেরও বেশি জার্মানকে তখন জ্যামাইকাতে নিয়ে আসা হয়েছিল।

জ্যামাইকাতে সাদাদের অভিবাসন কখনোই খুব বেশি পরিমাণে হয় নি। কারণ, কালোদের সাথে মিশে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার ফলে এর জনসংখ্যার অধিকাংশই কমে গিয়েছিল। ট্রিলেউনির জার্মান টাউন এবং সীফোর্ড টাউনে জার্মান জিনের প্রভাবে অনেক জ্যামাইকানের মধ্যে ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন নীল চোখ, সোনালি চুল, চামড়ায় বাদামি দাগ এবং সাদা চামড়া।

দক্ষিণ আফ্রিকা

দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদাদের আধিপত্য বজায় রাখতে জাতিবিদ্বেষী নিয়ম তৈরি করা হয়েছিল, এবং সাদা শাসন আমলে যে সাহায্যকারী অভিবাসন আইন আরোপ করা হয়েছিল তাতেও একই আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছিল। জাতিবিদ্বেষী নিয়ম শুরু হওয়ার আগে তার প্রাথমিক কাজ বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল।

১৮২০ সালে কর্তৃপক্ষ ৫০০০ মধ্যবিত্ত ব্রিটিশ অভিবাসীকে গ্রেট ব্রিটেন ত্যাগ করে জুলু এবং বোয়ারদের সহিংসতার কারণে বিতর্কিত হওয়া জমিতে বসবাস করতে প্ররোচিত করে। তাদেরকে আসলে ঝামেলাবিহীন একটি জায়গা দেয়ার কথা ছিল কিন্তু ৩ বছরের মধ্যে বাসিন্দাদের অর্ধেক শহরে চলে আসে। কারণ ছিল ব্রিটেনে তাদের যেরকম চাকরি ছিল, এখানে একই ধরনের চাকরি পাওয়া।

১৮৭০ সাল থেকে সোনা এবং হীরার সন্ধান পাওয়া যাওয়ার পরে অনেক বেশি হারে দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসন শুরু হয়। সোনার সন্ধান পাওয়া যাওয়া ট্রান্সভালে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা বহুগুণে বেড়ে যায়।

১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ইউরোপীয়রা যখন খাদ্য ও বাসস্থানের সংকটে পড়েছিল, তাদের বেকারত্ব প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছিল। তখন সরকার তাড়াতাড়ি রাষ্ট্রের সহায়তায় ইউরোপ থেকে অভিবাসন চালু করে। এই আইন চালু করার সময় প্রধানমন্ত্রী স্মাটের বক্তব্যের মধ্যে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি এবং শিল্পের বিস্তার ঘটানো এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় পশ্চিমা সভ্যতা বজায় রাখা নিশ্চিত করার কথা।

বর্ণবিদ্বেষী শাসন ব্যবস্থার অভিবাসন আইন চালু হওয়ার পরে ইউরোপীয়রা, মূলত ব্রিটেন থেকে আগের চেয়ে ৩ গুণ বেশি সংখ্যক হারে চলে আসে। এরমধ্যে স্থানীয় আফ্রিকানরা খুন হচ্ছিল, নিজেদের জায়গা থেকে তাদের জোর করে সরিয়ে দেয়া হচ্ছিল, এবং সাদাদের জন্য নির্ধারিত এলাকায় ৭২ ঘণ্টার বেশি যারা থাকত তাদেরকে নতুন অভিবাসন আইনে গ্রেফতার করা হত।

এই সময়ে ইউরোপীয়রা দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাদা মানুষের দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের অভিবাসীরা সম্মানিত শ্বেতাঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হত। এইসব দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য এইসব দেশের নাগরিকদেরকেও সাদা চামড়াম মানুষের সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়া হত।

অস্ট্রেলিয়া

সাদা অস্ট্রেলিয়া নীতির পোস্টার
‘সাদা অস্ট্রেলিয়া নীতি’ অনুযায়ী ৫০ বছর অস্ট্রেলিয়ায় অশ্বেতাঙ্গদের অভিবাসন নিষিদ্ধ ছিল এবং ইউরোপীয় জাতিবৈশিষ্ট্যের অভিবাসীদেরকে টাকা এবং চাকরি দেওয়া হত।

অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় অধিবাসীরা প্রায় ২০০ বছর ধরে বিভিন্ন ভাবে এবং বিভিন্ন কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ইউরোপীয় বাসিন্দারা তাদের জায়গা নিয়ে নিয়েছিল, পরে তাদেরকে জোর করে সাদাদের সমাজে বিলীন করে দেওয়া হয়।

১৯১৫ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত আদিবাসীদের প্রধান রক্ষাকারী আও নেভিল বলেন, দক্ষিণ আমেরিকায় ‘সাদাকরণ’ প্রক্রিয়া দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আদিবাসীদের মধ্য থেকে ‘কালোত্ব’ দূর করার জন্য বর্ণমিশ্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কর্তৃপক্ষকে অনুসরণ করে তারা বায়োলজিক্যাল বিলুপ্তিকরণের বদলে ধীর প্রক্রিয়ায় সাংস্কৃতিক বিলুপ্তিকরণ শুরু করে।

১৮৬৯ সাল থেকে ১৯৭০ এর দশকে অবস্থা ভালো না হওয়া পর্যন্ত, ১২ বছরের নিচে হাজার হাজার আদিবাসী শিশুকে তাদের পরিবার থেকে সরিয়ে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ে নিয়ে আসা হত।

‘সাদাকরণের’ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের প্রথম কাজ ছিল অভিবাসন বিধিনিষেধ আইন পাশ। ‘সাদা অস্ট্রেলিয়া নীতি’ অনুযায়ী ৫০ বছর অস্ট্রেলিয়ায় অশ্বেতাঙ্গদের অভিবাসন নিষিদ্ধ ছিল এবং ইউরোপীয় জাতিবৈশিষ্ট্যের অভিবাসীদেরকে টাকা এবং চাকরি দেওয়া হত।

১৭৮৮ সালে ইউরোপীয় দখল শুরু হওয়ার সময়ে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৫০ হাজার। ১৯৩৩ সালে এই জনসংখ্যা তাদের সবচেয়ে নিচের অবস্থানে চলে আসে।

এখন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটিতে ২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ বাস করে, কিন্তু আদিবাসীদের সংখ্যা ২.৪ শতাংশেরও কম, মাত্র ৫ লাখ ৬৩ হাজার।