বইয়ের কভারে লেখা ‘You don’t know her. But She knows you’। অর্থাৎ আপনি তাকে চিনেন না, কিন্তু সে আপনাকে চিনে।

এটা থেকে মনে হয় এমন একজনের কথা বলা হচ্ছে যে আপনাকে আড়াল থেকে বা কোনো এক জায়গা থেকে দেখে, অথচ আপনি তাকে দেখতে পান না। একটা রহস্যের আভাস দেয়। তাকে খুঁজে পেতে হবে, তাকে চিনতে হবে এমন একটা ইচ্ছা তৈরি হয় আপনার ভিতরে।

এই বাক্যটির ঠিক উপরেই বড় করে লেখা বইয়ের নাম—দ্য গার্ল অন দ্যা ট্রেইন। এমনভাবে লেখা, মনে হয় অক্ষরগুলি স্থির নয়, পিছন থেকে খুব স্পিডে সামনের দিকে যাচ্ছে। তার পিছনে  বইয়ের ঠিক মাঝখানে দ্রুতগতির একটা ট্রেনের ছবি দেওয়া। ট্রেনের অল্প একটু অংশ। একটা জানালা। সম্পূর্ণ কালো রঙের কভারের উপরে এইটুকু।

পলা হকিন্সের দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন একটা থ্রিলার উপন্যাস। ফ্যাশনেবল সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। নেগেটিভ অর্থে ফ্যাশনেবল না, বা ফ্যাশনেবল মানে হালকা ধরনের কাহিনি সেই অর্থেও না। এখনকার সময়ে ইংরেজী ভাষায় যে ধরনের থ্রিলার বেশি লেখা হচ্ছে, যে ধরনের কাহিনি ও চরিত্র এই থ্রিলারগুলিতে বেশি দেখা যাচ্ছে, সেই মিলের কারণেই এই উপন্যাসকে ফ্যাশনেবল বলা। আর যেহেতু সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, কাহিনির দিক থেকে অবশ্যই এটা ডার্ক থ্রিলার।

পলা হকিন্স (জন্ম. হারারে, জিম্বাবুয়ে, আগস্ট ২৬, ১৯৭২)

উপন্যাস শুরু হয় ২০১৩ সালের ৫ জুলাই, শুক্রবার। সকালে। তিরিশের আশেপাশে বয়স এমন একজন নারী বলতে শুরু করে এই উপন্যাস। তার নাম রাচেল।

কোনো থ্রিলার নিয়ে বলা বা আলোচনা করার একটা ভালো সমস্যা আছে। এমনভাবে বলতে হয় যেন স্পয়লার না হয়ে যায়, যেন বই পড়ার আগেই কেউ আসল ঘটনা না জানতে পারে।

দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইনের কাহিনি ও চরিত্রদের নিয়ে এমনভাবে বলব যাতে এর থ্রিল নষ্ট না হয়, রহস্য শেষ না হয়।

রাচেল থাকে অ্যাশবারিতে। অ্যাশবারি লন্ডনের বাইরে একটা মফস্বল। সে প্রতিদিন সকালের ট্রেনে লন্ডনে যায়। সন্ধ্যার ট্রেনে আবার অ্যাশবারিতে ফিরে আসে। অ্যাশবারি আর লন্ডন আসা যাওয়ার পথে মাঝখানে পড়ে আরেকটি মফস্বল উইটনি। উইটনির একটা রাস্তার নাম ব্লেইনহেম। ব্লেইনহেম রোডের এক পাশে অনেকগুলি বাড়ি, আরেক পাশে রেল লাইন। রাচেল প্রতিবার ট্রেনের জানাল দিয়ে ব্লেইনহেম রোডের বাড়িগুলির দিকে তাকায়। ১৫ নাম্বার বাড়ির দম্পতিকে ছাদে বসে থাকতে দেখে রাচেল। তাদের সম্পর্কে নিজের কল্পনার একটা জগৎ তৈরি করে সে। মনে মনে সেই বাড়ির স্ত্রীর নাম দেয় জেস আর স্বামীর নাম দেয় জেসন।

এই ১৫ নাম্বার বাড়ির দুই-একটা বাড়ি পরেই ২৩ নাম্বার বাড়ি। রাচেল এই বাড়ির সামনে আসলেই সাইকোলজিক্যাল সমস্যায় পড়ে। দেখতে না চাইলেও এই বাড়ির দিকে তার চোখ চলে যায়। ডিভোর্স হওয়ার আগে এই বাড়িতে সে তার হাজব্যান্ড টমের সাথে থাকত। টম এখন স্ত্রী আনা ও তাদের ছোট্ট মেয়ে এভিকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকে।

রাচেল অ্যালকোহলিক। মারাত্মক রকমের অ্যালকোহল আসক্ত হওয়ার কারণে রাচেলের অনেক সমস্যা হয়। সে প্রায়ই ভুলে যায়, সে কিছুতে মনোযোগ দিতে পারে না, ফোকাস করতে পারে না। তার চাকরি চলে গেছে, ডিভোর্স হয়ে গেছে। হতাশার কারণে সে দিনে দিনে আরো বেশি অ্যালকোহল আসক্ত হয়ে পড়ে।

এরপর উপন্যাসে মেগানের বর্ণনা শুরু হয়। মেগান বলতে থাকে। সে বলতে শুরু করে ২০১২ এর ২ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার থেকে। মেগান থাকে পনের নাম্বার বাড়িতে, তার স্বামী স্কটের সাথে। এই মেগান আর স্কটকেই রাচেল কল্পনায় নাম দিয়েছিল জেস আর জেসন।

মেগান আর স্কটের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। সুখী পরিবার। মেগান সময় কাটানোর জন্য কিছুদিন টম আর আনার বাড়িতে তাদের মেয়েকে দেখাশোনার কাজ নিয়েছিল। ভালো লাগে নি বলে সেই কাজ ছেড়ে দেয়।

মেগান ইনসমনিয়ায় ভুগতে থাকে। তার আগের কথা মনে হয়। সে সবসময় একটা স্থায়ী দ্বিধার মধ্যে থাকে। মেগানের ডিপ্রেশন আছে, তবে রাচেলের মত তীব্র না। অনেক সূক্ষ্ণ, আপাতভাবে প্রায় বোঝা যায় না এরকম ডিপ্রেশন। স্কটের পরামর্শে মেগান সাইকোলজিক্যাল থেরাপিস্ট কামাল আব্দিকের কাছে যায় কাউন্সেলিং এর জন্য।

কামাল আব্দিকের সাথে মেগানের দেখা হওয়া এই থ্রিলারের একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।

উপন্যাস বর্ণনা করার জন্য রাচেল আর মেগানের সাথে যুক্ত হয় আরেকজন। রাচেলের আগের হাজব্যান্ডের বর্তমান স্ত্রী, আনা। রাচেল আর আনা একই সময়ের কাহিনি সমান্তরালে বলতে থাকে নিজের নিজের জায়গা থেকে, নিজের নিজের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। তাদের টাইমলাইন ২০১৩ থেকে। আর মেগান বলতে থাকে পিছনের সময় থেকে, তার টাইমলাইন ২০১২ থেকে। সবার কাহিনিই আস্তে আস্তে সামনের দিকে যাচ্ছে।

১৩ জুলাই, রাতে রাচেল ব্লেইনহেম রোডে গিয়েছিল, কিন্তু তখন সে ছিল প্রচণ্ড মাতাল। ওই রাতে সে আহত অবস্থায় বাসায় ফিরে। পরের দিন সকালে সে কিছুই মনে করতে পারে না। তার এই ব্ল্যাকআউটের সমস্যা মোটামুটি পুরাতন। প্রচণ্ড অ্যালকোহলিক অবস্থায় তার কোনো স্মৃতি তৈরি হয় না।

১৫ জুলাই, সোমবার রাচেল ইয়াহু নিউজ থেকে জানতে পারে ১৩ জুলাই, শনিবার রাত থেকে মেগান নিখোঁজ। রাচেল যেহেতু সেই রাতে ব্লেইনহেম রোডে ছিল, তার সন্দেহ হয় মেগানের নিখোঁজ হওয়ার সাথে তার হয়ত কোনো সম্পর্ক আছে।

দিন পার হতে থাকে, পুলিশ মেগানের নিখোঁজ হওয়ার রহস্যের সমাধান করতে পারে না। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে মেগানের ফোন, ব্যাংক কার্ড আর ব্যবহার করা হয় নি।

দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন প্রসঙ্গে এখনকার সময়ের আরেকটি জনপ্রিয় থ্রিলারের কথা বলা যায়।  জিলিয়ান ফ্লিনের গন গার্ল। দুইটারই প্রধান চরিত্র নারী। অনেক নারী লেখক এখন নারী চরিত্রদের কেন্দ্রে রেখে  থ্রিলার লিখছেন, এই ফ্যাশনেবল মিলের বাইরের মিলের কথা বলছি। দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইনের রহস্য যেভাবে আগায়, যেভাবে টুইস্ট তৈরি হয় তার সাথে গন গার্লের অনেক মিল আছে। কিন্তু দুই উপন্যাসের কাহিনি ও কাহিনি বর্ণনা করার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা।

যারা জিলিয়ান ফ্লিনের গন গার্ল উপন্যাসটি পড়েছে, বা এই উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হওয়া ছবিটা দেখেছে, তারা দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন পড়লে এই মিলের ব্যাপারটি বুঝতে পারবে। গন গার্লের অ্যামি নিখোঁজ হওয়ার পরে যেমন টুইস্ট দেখা যায়, এই উপন্যাসে মেগানকে নিয়েও ওই ধরনের টুইস্টের আভাস দেখা যায়। আর পুরুষ বা ছেলেদের দেখার ক্ষেত্রেও গন গার্লের সাথে দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইনের মিল আছে। দুটি বইতেই ছেলে বা পুরুষদের অনেকটা একই রকম ভাবে দেখা হয়েছে—ছেলেরা অনেক বেশি প্রয়োজনকেন্দ্রিক, ছেলেরা বিশ্বাস বা কমিটমেন্ট থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে আসতে পারে; আর মেয়েরা কোনো কিছুর সাথে অনেক বেশি আবেগ দিয়ে জড়িত হয়, ফলে অনেক বেশি সাফার করে। এরকম একটা ব্যাপার দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন উপন্যাসটিতে আছে।

তবে গন গার্লের অ্যামি আর দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইনের মেগান এক নয়।

দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন শেষ পর্যন্ত না পড়লে বোঝা যাবে না মেগান আসলে কী ইমোশন ডিজার্ভ করে। আপনি যদি এই উপন্যাস শেষ পর্যন্ত পড়েন, তাহলে মেগানের যা প্রাপ্য তা সে পাবে।

রাচেলের বাড়াবাড়ি রকমের অ্যালকোহল আসক্তির বর্ণনা পরের দিকে কিছুটা বিরক্তিকর মনে হয়। পরের দিকে রাচেলের অ্যালকোহল আসক্তি বোঝানোর জন্য কিছু মুহূর্ত একদম দুর্বল মনে হয়।

পুরো উপন্যাসের মূল কাহিনিতে যে স্থানগুলির একান্ত প্রয়োজন আছে সেই অল্প কয়েকটি জায়গার বাইরে অন্য কোনো জায়গার কোনো বর্ণনা নাই। ফলে উপন্যাসে কোনো ঘটনায় আশেপাশের যে পরিবেশ তৈরি হতে হয়, সেই পরিবেশ এই উপন্যাসে বোঝা যায় না। কোনো স্পেস তৈরি হয় নাই।

গল্পের মূল কয়েকটি চরিত্র—রাচেল, মেগান, টম, স্কট, কামাল, আনা ও ক্যাথি ছাড়া অন্য কোনো চরিত্র আছে এমন মনে হয় না। কয়েকটি ছোট চরিত্র আছে। চরিত্র ছোট হওয়ার কারণে সমস্যা না, সেই চরিত্রগুলি ঠিকমত তৈরি হয় নি।

তবে মূল চরিত্রগুলির ক্ষেত্রে লেখক খুবই সফলভাবে নিউট্রাল থেকেছেন। রাচেল, মেগান আর আনা এই তিনজনের বর্ণনার কারণে সবগুলি চরিত্র এবং ঘটনাকে নিরপেক্ষভাবে দেখা গেছে। কোনো ঘটনা বা কারো সম্পর্কে কারো একার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপন্যাস আগায় নি। যে ঘটনা রাচেল নিজের মত বর্ণনা করেছে, আনার বর্ণনার মাধ্যমে সেটা হয়ত নিউট্রালাইজড হয়েছে। একই কারণে, সবার চিন্তা, সাইকোলজির ডিলেমা, ইচ্ছা, আচরণ এইগুলির পিছনের কারণও বোঝা গেছে। ফলে, এরা সবাই দোষে-গুণে কেউ কারো চেয়ে কম বেশি হয়ে ওঠে নি।

উপন্যাসের বর্ণনা খুব তাড়াতাড়ি এগিয়েছে। কাহিনি হয়ত একেবারে নতুন না, কাছাকাছি ধরনের থ্রিলার কাহিনি তো আছেই। ভাল দিক হলো এই থ্রিলারে কোথাও ক্লিশে ব্যাপারগুলি নাই। বা ক্লিশে ব্যাপারগুলি নিয়ে কোনো জড়তা ছাড়াই উপন্যাস সামনে এগিয়েছে, এই কারণে কোনো ক্লিশে জিনিস চোখে পড়ে নি। গতানুগতিক থ্রিলারে কিছু কিছু মুহূর্তে যেমন আরোপিত ভাবে খুব বেশি থ্রিল তৈরি করা হয়, এখানে সে রকম কিছু নাই। কোনো চাপ দেওয়া হয় নি। বর্ণনা খুব সুন্দর। বিশেষ করে মেগান যেভাবে বর্ণনা করে।

যেমন, মেগান যখন নর্থফোকে ছিল তখনকার কথা বলতেছে এরকম কয়েকটা লাইন এখানে দেই:

“আমি ওকে তার কাছে দিয়ে দৌড়ে বের হয়ে গেলাম। বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আমি সমুদ্রের তীরে চলে গেলাম। আমার মনে নাই তারপর কী হয়েছিল। অনেকক্ষণ পরে সে আমাকে নিতে এসেছিল। তখনো বৃষ্টি হচ্ছে। আমার মনে হয় আমি বালির উপর পড়ে ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম সমুদ্রে ডুবে যাব, কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত সে আমাকে নিতে এসেছিল।”

তবে শেষের দিকের চূড়ান্ত একটা দৃশ্য সিনেমার মত। মনে হয় খুবই টিপিক্যাল কোনো হলিউডি থ্রিলার সিনেমার দৃশ্যের বর্ণনা চলছে।

দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন উপন্যাসের রহস্য বা থ্রিল আসলে আলফ্রেড হিচককের সিনেমার রহস্যের মত। হিচককের সিনেমার কাহিনির মত একটা রহস্য এখনকার সময়ের কনটেক্সটে বলা হয়েছে। সাইকোলজির দিক থেকে চরিত্রগুলিও অনেকটা সেরকম। এই উপন্যাসের অনেক মুহূর্ত হিচককের স্ট্রেন্জার অন দ্য ট্রেইন ও রিয়ার উইন্ডো সিনেমার অনেক মুহূর্তের কাছাকাছি।

২০১৫ সালের বেস্ট সেলিং উপন্যাসগুলির একটা দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন। পলা হকিন্সের প্রথম থ্রিলার উপন্যাস এটা। এর আগে পলা হকিন্স অ্যামি সিলভার নাম নিয়ে চারটি উপন্যাস লিখেছেন।

পলা হকিন্স জন্মগ্রহণ করেছেন রোডেশিয়ার স্যালিসবুরিতে, এখন এইটা জিম্বাবুয়ের হারারে। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৫ বছর তিনি দ্য টাইমস পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি লেখালেখি শুরু করেছেন।

আগে প্রকাশিত জিলিয়ান ফ্লিনের গন গার্ল উপন্যাসের সাথে তুলনা প্রসঙ্গে পলা হকিন্স বলেছেন, অপছন্দ করার মত কঠিন একটা নারী চরিত্র, বিয়ে ভেঙে যাওয়া, একটা নারীর নিখোঁজ হয়ে যাওয়া এইসব কারণে মানুষ এই উপন্যাস দুটিকে সমান্তরালে রাখে। আমি মনে করি না রাচেল আসলে ততটা অপছন্দ করার মত। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে আসতে দিয়েছে। আমাদের অনেকেই এই সীমা অতিক্রম না করলেও সীমানার অনেক কাছে দিয়ে হেঁটেছি।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে রিভারহেড বুকস প্রকাশনী থেকে দ্য গার্ল অন দ্য ট্রেইন প্রথম প্রকাশিত হয়।

শেষে বলব, ৩৩৬ পৃষ্ঠার এই বইটি ইন্টারেস্টিং থ্রিলার, পিওর থ্রিলার।