দখল করার একটা সাধারণ নিয়ম আছে। আপনার খেয়ে ফেলতে হবে। একদম ক্লুলেস। কোনো শনাক্তযোগ্য চিহ্ন রাখা যাবে না। অপরাধ জগতে যার নাম পারফেক্ট ক্রাইম। কিংবা শনাক্তযোগ্য আলামত প্রায় শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে, যাকে বলে সারক্যামস্ট্যানশিয়াল ইভিডেন্স। আপনার আম্মা মেহমানের জন্য বিশেষ কতগুলো মেঠাই বানিয়ে রেখেছেন। আপনি তার মধ্যে গুটিকয় সাবাড় করতে চান এবং অবশ্যই আম্মার লাঠিপেটা খেতে চান না, এমনকি অভিযুক্তও হতে চান না। তাহলে কী করবেন? প্রথমেই চুপিচাপি খেয়ে ফেলবেন এবং যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে। ভালমতো মুখ মুছবেন। আর ছোটভাই বা ছোটবোন কাউকে সাক্ষী রাখবেন না। এবং অতি অবশ্যই পরে এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের কালে লাগাতার বলতে থাকবেন যে আপনি খান নাই। আপনি বিলাই, বাদুড়, বানর এমনকি পাশের বাসার বদরুলের নাম পর্যন্ত সম্ভাব্য মিঠাইখেকো হিসাবে উচ্চারণ করবেন। কিছুতেই কবুল করবেন না। মোটামুটি এই নিয়মে চলবে, যদি না আপনার মুখে মিঠাইয়ের অবশিষ্টাংশ লেগে থাকে।

খাদ্যদ্রব্য দখলের মতো ঠিক একই নিয়মে জমির দখল সম্ভব না। প্রধান কারণ জমি গিলে মুখ মুছে ফেলা যায় না। জমির দখল মুখ্যত খুঁটিগাড়া পদ্ধতিতে চলে। আপনার কোম্পানির নামের সাইনবোর্ড কিংবা আপনার বাপের নামের সাইনবোর্ড খুঁটিগেড়ে রাতের মধ্যেই বসাতে হবে। দিনের আলো এসব কাজের জন্য সহায়ক বলে বিবেচিত হয়ে আসে নাই। এই খুঁটিগাড়া পদ্ধতিতে দুচারটা লাশও গাড়া লাগতে পারে।

আপনার কোম্পানির নাম ধরা যাক পদ্মা, কিংবা ভৈরব কিংবা তিস্তা। আচ্ছামতো খুঁটি গেড়ে দিন এই নামে। কিংবা আপনার কোম্পানির নাম হাসুমতি, পাইনকুকুর, হিমাচল যাই হোক না কেন, খুঁটি গাড়তে থাকুন। কিংবা দরকার মতো লাশও গাড়তে থাকুন। এটার কলাটরেল ড্যামেজ বেশি। তো সেটা তো মিঠাইয়ের তুলনায় মাটিরও দাম বেশি। ড্যামেজ সাপেক্ষে দামের ওঠানামাও বলতে পারেন।

খেয়ে-ফেলা বা খুঁটি-গেড়ে ফেলা যে পদ্ধতিতেই ফোক দখল করেন না কেন, চলবে। তবে দ্রব্যভেদে আপনাদের অবশ্যই পদ্ধতিও ভিন্ন করতে হবে। কলের গান বা রেকর্ড কোম্পানিগুলো আসার পরে খুঁটি-গাড়ার বিষয়টা মোটামুটি একটা রাস্তা পেল। এখানে খুঁটি-গাড়াটি চাকতির গায়ে খোদাই করার মধ্যে দেখতে হবে। সেখানে গীতিকার থাকবেন, সুরকার থাকবেন, আর অবশ্যই থাকবেন গায়ক-গায়িকা যাঁর ব্রান্ডভ্যালুতে বেশি চলতে থাকবে এই চাকতিগুলো।

গীতিকার কিংবা সুরকারকে মানুষে কম চেনেন, কম ভালবাসেন বা কম দাম দেন এরকম কথা বলে একটা ক্যাচাল লাগানো আমার মূল উদ্দেশ্য নয়। কিংবা এটাও আমার বক্তব্য নয় যে কেবল দখলকৃত বা চোরাই মালই রেকর্ড কোম্পানিগুলো গোড়ার দিকে খাইয়েছে। উল্টো বরং, পল্লী অঞ্চলের মালামালই, যদি বলতেই হয়, রেকর্ড কোম্পানিগুলো শুরুর দিকে কম প্যাকেটে ভরেছে। তারা বরং উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের তিন সাড়ে তিন মিনিটের গানের সৃষ্টিকর্তাদের তৈরি করেছে। উপরন্তু, পল্লী অঞ্চল থেকে গান বা বাদ্য নিলেই তাকে চোরাই বলব এতটা রাগী লোকও আমি নই। আমার বক্তব্য ছিল যদি সাড়ে তিন কোটি বাংলাভাষী শচীন দেব বর্মণকে নামে চিনে থাকেন, তো কোটি দেড়েক মীরা দেব বর্মণকেও চেনেন। তাছাড়া ফোক বা লোকের রাজ্য হিসাবে কেবল গানে সীমিত থাকাও খুব অবিচার হয়ে যাবে আমার তরফে। মাথায় গান ভুড়ুক-ভুড়ুক করে ঘুরছে হয়তো গত কয়েক মাসের ব্যবধানে অন্তত দুইবার গানের দখলদারিত্ব নিয়ে টানাটানি লক্ষ্য করা গেছে বলে। পয়লা ‘সর্বতো মঙ্গল রাধে’ নিয়ে, কয়েক মাস আগে। তারপর হলো অতিসম্প্রতি ‘আইলারে নয়া জামাই/দামান’ গানখানি নিয়ে। সেসব নিয়ে নাহয় আরেকদিন বিচার করা যাবে। তাছাড়া আমি বিচার করে দিলেই আপনারা সবাই হাসিমুখে মেনে নেবেন এমন সোজা মামলা তো আর নয়।

তারপরও আমাকে যদি সত্যিই ফোক-লোক দখল নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, আমি বলব যে খেয়ে-ফেলা আর খুঁটি-গাড়া উভয় পদ্ধতির একটা জবরদস্ত মিশেলেই/ব্লেন্ডিংয়েই বরং ফোকদখল সবচেয়ে সুবিধাজনক ও মসৃণ হয়। ‘আরামসে’ যাকে বলে।

অবশ্যই আমি কেবল গানবাদ্য নিয়ে বলছি না, তামাম ফোকরাজ্য নিয়েই বলছি। এটা একটা অত্যন্ত জটিল প্রণালী। নেতিকরণের নেতি বলে কবে কোন শাস্ত্রীয় বইতে কী যেন পড়েছিলাম। সেটা তখন বুঝতে ঘাড় গরম হয়ে গেছিল। কিন্তু ফোকের দখল বুঝতে থাকলে এত্ত সহজ লাগবে যে আপনাদের হাসি পেয়ে যাবে, যদিও প্রক্রিয়াটা কঠিন। প্রথমেই আপনি, ভাল হয় আপনারা দলবেঁধে, শিল্পীদেরকে মজুরে পর্যবসন ঘটাবেন। তাঁদের কান-নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করে দেবেন পেট চালানোর চাপে। সকাল-বিকাল যেন তাঁরা টের পান যে কত ধানে কত চাল, কত চালে কত ভাত! কেমনে পুরা শইলের বিষ বাইর কইরে পেট চালাতে হয়। এমনকি ঘুমের মধ্যেও মজুর জীবনের চাপে যেন ঠিকমতো ঘুমও না আসে (তাঁদের, অবশ্যই আপনার কথা হচ্ছে না)। তারপর যখন সেই প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হয়ে যাবে, তখন আপনারা সঠিক মুহূর্ত বুঝে শিল্প-শিল্প, ‘আমাদের লোকশিল্প’ বলে জিকির তুলবেন। তুলবেন মানে একটা লাগাতার জিকির অব্যাহত রাখবার মতো মানসিক প্রস্তুতিও সঙ্গে রাখবেন। আপনাদের নিশ্চয়ই ধারণা আছে যে আচমকা আওয়াজে মানুষ চমকে যায়। কেবল ধারাবাহিক আওয়াজেই ঐতিহ্য তৈরি হয়। ফোক অতিশয় ঐতিহ্য!

এই জিকির বা আওয়াজখানি যত মর্মস্পর্শী শোনাবে ততই সুবিধা হবে আপনার দখলপ্রক্রিয়াতে। কেবল নিজেদের কানেই আপনাদের মর্মস্পর্শী শোনালে চলবে না। আপনাদের হতে হবে এমন প্রস্তুত যাতে ‘জাতীয় কানে’ এই মধুর ধ্বনি শোনায়। ন্যাশনাল কান! এমনকি আন্তর্জাতিক কান পর্যন্ত যদি নিতে পারেন তাহলে মারহাবা। ইন্টারন্যাশনাল কানমণ্ডলী! তখন ওই যে সাবেক শিল্পীবৃন্দ, মানে বর্তমান মজুরবৃন্দ আপনার কারখানাতে এসে কেবল কাজই করবেন না, উপরন্তু সারাক্ষণ ‘জাতির সম্মান’ রক্ষা করার আনন্দের চোটে (বা চাপে) তাঁদের কান্না চাপবে।

তাহলে লক্ষ্য করলেন যে, আমরা আজ বুঝতে পারছি যে ফোকদখলের একটা বড় সংগ্রাম হলো ফোকওয়ালাদের কান্নার ব্যাকরণ বদলে দিতে হবে। যে কান্না ছিল মজুরের শ্রমনির্যাস-পরিশ্রান্তি ও বঞ্চনাহেতু, তাকে আপনারা বদলে দেবেন বা দিচ্ছেন দেশাত্মবোধে। দিকে দিকে কাঁথাশিল্পী, কাঠমিস্ত্রী, মৃৎকার, কামার-কুমার, তাঁতী, নৌকাবানিয়ে, পিঠাপুলি বানিয়ে, মিঠাইমেকার ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে থাকবেন এই ভেবে “আহা আমি দেশের মুখ উজ্জ্বল করছি; আমি একজন লোকশিল্পী, তামাম দুনিয়া আজ আমাগের পানে চেয়ে।” এই যে ফিলিংটা অনুভূতিটা তাঁদের মধ্যে ভরে দিতে পারলেন সেটা কিন্তু দখলের অন্যতম স্তম্ভই কেবল নয়; বরং দীর্ঘকাল দখল করে ছ্যাবড়া বানিয়ে ফেলার মূলমন্ত্র। তাহলে আগে ফোকশিল্পীকে মজুরে পর্যবসন, তারপর মজুরের গলায় তুলে দেয়া আপনার পা একটুও ঢিলা হতে না দিয়ে আবার শিল্প-শিল্প মর্মস্পর্শী আর্তনাদ। “হাই ফোকস! গট ইট?”

তবে বড় দখলদারদের জীবনী থেকেও শিক্ষা নিতে পারেন। আমাদের মা-বাবাও ছোটবেলায় (আমাদের) বড় মানুষদের জীবনীগ্রন্থ পড়াতেন খুব। কেন পড়াতেন? যাতে আমরা শিখতে পারি তাঁদের জীবনী থেকে। তখন বিল গেইটস বলুন কিংবা বাংলাদেশের লোকফোকখেকোদের জীবনী তেমন পাওয়া যেত না। ফলে আমাদের শেখার প্রতিবন্ধকতাও কম ছিল না। এখন অনেক কিছুই সুলভ। যেমন বাংলাদেশের অন্যতম, হয়তো বৃহত্তম, লোকশৈলী-দখলদার (এখানে পৃষ্ঠপোষক বলতে হবে যদি প্রতিষ্ঠানের নাম ধরে বলতে চান)-এর সংস্থাজীবনী হাতেনাতে পাবেন। ওঁরা তো শুরুতে মোড়কেও বাণী দিতেন। বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায়: “আর আমাদের সংস্থাটি ৩০ হাজার কারুশিল্পীকে দিয়েছে এমন এক জীবন…” ইত্যাদি। এত বছর আগে পড়েছি, ঠিকমতো মনেও পড়ে না ছাই! কিন্তু এখনো কাছাকাছি জিনিস পাওয়া যাবে, হয়তো মোড়কে নয়, হয়তো অন্য কোনো বহুমূ্ল্য গবেষকের বিজ্ঞাপনধর্মী গবেষণাতে। হয়তো আমাদের এখন ৬০ কিংবা ৮০ হাজার ‘কারুশিল্পী’র হিসাব দেখতে হবে, কিংবা হয়তো ২ লাখ ২৫ হাজার।

এখানে ‘কারুশিল্পী’ বলার ভিতর যে স্নেহরস চু্ঁইয়ে পড়ছে সেটার স্বাদও আপনাদের পেতে পারতে হবে। এই স্নেহ সম্ভব তখনই যখন সত্যিই ‘কারুশিল্পী’ আর নেই কোথাও, এক্সক্লুসিভলি মজুরে পর্যবসিত, নিপতিত, অভিশপ্ত। যখন সকাল থেকে ৬ ঘণ্টা পাঞ্জাবির বোতামের চারপাশে সুঁই দিয়ে ৪ ঘণ্টা সুতার কাজ করার পর ‘কারুশিল্পী’টি ২০টাকা ‘মজুরি’ পান।

যদি স্বাধীন-সার্বভৌম শিল্পীরা দিকে-দিকে জনপদে ঘুরেফিরে বেড়াতে থাকেন, কিছুতেই আপনারা দখল করতে পারবেন না। তার নাম ফোক দেন আর লোক দেন। খেতে হলে তাঁদের আপনার গোড়ালির নিচের গতরবিক্রির শ্রমিক বানাবেন আগে। তারপর ১৭টা তাঁত বসিয়ে আপনি হয়ে পড়ুন ‘লোকশিল্পের একজন সমঝদার’। আন্টারপ্রিনার! এমনকি ডিজাইনার! যা ইচ্ছা! করোনাকালে এটা এখন আরো সহজ হয়েছে আপনাদের জন্য।

আদাবর, ২ জুন ২০২১
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. মিশু আহসান, ২০১৫