ডাইনিং টেবিলে ভাত খেতে বসছিলাম। আমি, তূর্ণা, মা আর মামি। বাসায় গেস্ট থাকলে আমি একটু আধটু কথা বলার চেষ্টা করি, গল্প করার চেষ্টা করি। কিন্তু এই সেট আপে গল্প করাটা কঠিন।

বড় মামির ছেলে, যে একসময় আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল, মারা গেছে এক মাস আগে। এক বছর ধরে ক্যান্সারের যন্ত্রণার মধ্যে ছিল ছেলেটা। আমি হাসপাতালে কখনো তাকে দেখতে যাই নাই। ঠিক করছিলাম হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলে যাব দেখতে। সেটা আর হয় নাই। ও মারা যাওয়ার পর থেকে খুব করে চাচ্ছিলাম মামি বাসায় এসে থাকুক কয়েকদিন। আমার বাসায় অনেক মানুষের যাওয়া-আসার মধ্যে আর একটা নতুন জায়গায় থাকলে হয়ত কিছুটা ভালো লাগবে উনার।

কিন্তু আসার পর বুঝলাম মামির চেহারায় একটা পার্মানেন্ট দুঃখের ছাপ বসে গেছে। উনি কথা বলেন না, কিছু জিজ্ঞেস করেন না, কোনো কিছু নিয়ে আগ্রহবোধও করেন না। যা একটু আধটু কথা হয় তাতেও ঘুরে ফিরে তিনি ছেলের গল্প করেন আর সবার মন খারাপ হয়ে যায়।

তো খাবার টেবিলে বসে আমি ভাবতেছিলাম কী নিয়ে কথা বলা যায়। ঠিক সে সময়ই ফোন আসল অফিস থেকে। কোনো একটা রিপোর্ট নিয়ে জানার জন্য ফোন করছিল। আমিও কথা বলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ অন্য পাশ থেকে আমার কলিগ বলে উঠলো, “আরেহ তুমি তো দেখি চাটগাঁইয়া অ্যাকসেন্টে কথা বলতোছো… হা…হা…।”

এই কথাটা আমি আগেও শুনছি। মা’র সামনে, আত্মীয়-স্বজনদের সামনে কিংবা চট্টগ্রামে গেলে আমার কথায় নাকি চাটগাঁইয়া টান চলে আসে। অন্যসময় আসে না। আমি হাসতে হাসতে ফোন রেখে বললাম, “আমার কলিগ বলতেছে আমার কথায় নাকি চিটাইঙ্গা টান চলে আসছে।”

উত্তরে মামি বললো, “তুমি চিটাংয়ে কয়দিন থাকলেই ভাষাটা বলতে পারতা। থাকো নাই তো। আর বলোও তো নাই। সেজন্য আর কি।”

পাশ থেকে মা বললো, “হ্যাঁ হ্যাঁ। এই যে টিটু মানিকগঞ্জ থেকে চিটাং গেছে চাকরি করতে। ও তো এখন ফুল চিটাংয়ের ভাষা পারে। কথাও বলে।”

মামি বললো, “বাইরে থেকে মানুষজন এসে শিখতেছে না? আমার প্রতিবেশী যারা ওরা তো গারো। ওরা চারটা ভাষা পারে। ময়মনসিংহের লোকাল ভাষা পারে, গারোদের মান্দি ভাষা পারে, শুদ্ধ বাংলা পারে, আবার চিটাইঙ্গাও শিখছে। তুমি পারবা এতগুলা বলতে?”

একটু থেমে মামি বললো, “অবশ্য ওদের একটা ব্যাপারও আছে। আমি অনেক চাইছিলাম গারো ভাষাটা শিখতে। কিন্তু ওরা শিখাতে চায় না। তুমি দেখো সব আদিবাসীরা কিন্তু চিটাইঙ্গা, শুদ্ধ বাংলা দুটাই পারে, বুঝে। কিন্তু তুমি কয়টা বাঙালি খুঁজে পাবা যে ওদের ভাষা পারে? একটা হচ্ছে বাঙালিরা শিখতে চায় না সেটা, আরেকটা হচ্ছে ওরাও শিখাতে চায় না। ওরা ওদের ভাষা, কালচার এগুলা নিয়ে খুব সচেতন। মানে তোমাকে শিখাবে না যে আর কি।”

এই আলাপটা আমার ইন্টারেস্টিং মনে হইল। আসলেই তো, ওরা ওদের ভাষার পাশাপাশি বাংলা শেখে, ইংরেজি শেখে, লোকাল ল্যাঙ্গুয়েজও শেখে। পাহাড়ে এত মানুষ ঘুরতে যায়, থাকে, চাকরি করে, কিন্তু কাউকেই ওদের ভাষাটা শিখতে দেখলাম না।

আলাপ আরেকটু চলতেই মামি বলল, “শুনো তোমাকে একটা গল্প বলি। একটা নার্স ছিল। মাসেন খিয়ান নাম। উনি মরা মানুষকে বাঁচায়ে ফেলতে পারত। আর জেতা মানুষকে মেরে ফেলতে পারত।”

“শুনো তোমাকে একটা গল্প বলি। একটা নার্স ছিল। মাসেন খিয়ান নাম। উনি মরা মানুষকে বাঁচায়ে ফেলতে পারত। আর জেতা মানুষকে মেরে ফেলতে পারত।”

আমি আর তূর্ণা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। মা’র এসব গল্পে আগ্রহ নাই, আগেই উঠে রান্নাঘরে কাজ করতে চলে গেছে।

আমি কিছু বলার আগেই তূর্ণা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলে উঠল, “মরা মানুষকে জ্যান্ত করে ফেলত?”

মামি বলল, “হ্যাঁ।”

এমন আজগুবি জিনিস শুনে হা হা করে হেসে ফেলার কথা, তাও আমি চুপ থাকলাম। কারণ এই প্রথম মামিকে কথা বলতে দেখতেছি। এবং অনেকক্ষণ ধরে উনি হাসপাতাল, ক্যান্সার, ছেলের মৃত্যু, রিলেটিভদের উপর রাগ-হতাশার বাইরে অন্য কোনো টপিকে কথা বলতেছেন।

আরেকটা বিষয় হল, অলৌকিক জিনিসপাতিতে আমি আজকাল ব্যাপক আগ্রহ পাচ্ছি। কয়েকদিন ধরে আমার মনে হচ্ছে, আমার বাসায় জ্বীন কিংবা ভূত আছে।

আমি যখন বৃষ্টির দিনে বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখি কিংবা গান শুনি তখন উনি জানালার পাশে চেয়ারে বসে থাকেন, বৃষ্টি দেখেন। মাঝে মাঝে তার উপস্থিতি জানান দিতে উনি আমার জিনিসপত্র উল্টাপাল্টা জায়গায় রেখে দেন অথবা লুকায়ে ফেলেন। দেখা যায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার আমি আমার নীল জিন্স খুঁজে পাই না কিংবা বেল্ট খুঁজে পাই না কিংবা যেখানে চিরুনিটা রাখছিলাম সেখান থেকে কে যেন ওটা নিয়ে বাথরুমে রেখে আসছে বা এমন কিছু। এ নিয়ে মায়ের সাথে চিল্লাচিল্লির শেষ নাই। আর বিচিত্র সব জায়গায় জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়া যায়। দেখা যায় নীল জিন্স পাওয়া গেছে সোফার উপর, বেল্ট পড়ে ছিল বারান্দায়।

আমার ধারণা, বাসায় জ্বিন-ভূত আছে এই জিনিস আমার মাথায় ঢুকায়ে দিয়ে গেছে আমার বড় দিদি। ও এসে আমাকে ওর পুরানো বাসার গল্প বলছিল। যেকোনো গল্পই দিদি এত গুছায়ে, এত সুন্দরভাবে বলে যে চোখের সামনে ছবি ভেসে ওঠে।

ওর আগের বাসাটা ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কাছে একটা বিল্ডিংয়ে। ওরা টপ ফ্লোরে থাকত। একেকটা ফ্লোরে চারটা করে ফ্ল্যাট। ওদের ফ্লোরের দুইটা ফ্ল্যাট ছিল ফাঁকা।

ওই বাসাটায় ওঠার পর পরই বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ শোনা যেত। দিন নাই, রাত নাই, রোদ নাই, বৃষ্টি নাই সবসময়ই কেউ না কেউ লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতেছে। অসংখ্যবার ছাদে টর্চ ফেলে চেক করা হইছে। কাউকে দেখা যায় নাই।

এক পর্যায়ে গোটা ছাদে সিসি ক্যামেরাও বসানো হয়। প্রতিবার পায়ের আওয়াজ পাওয়া মাত্রই মনিটর চেক করা হত। কিন্তু কখনোই কাউকে দেখা যায় নাই। একসময় হাঁটাহাটির সঙ্গে মসলা বাটার আওয়াজ যুক্ত হইল। দিন-রাত কেউ ছাদে মসলা বাটতেছে এমন। তার উপর ছায়ার মত কিছু একটা দেখা আর লোকজনের ‘জ্বীন তত্ত্ব’ নিয়ে বলাবলি তো আছেই।

এতকিছুর পরেও দিদি তেমন ঘাবড়ে যায় নাই, তেমন পাত্তাও দেয় নাই। কিন্তু আমার ভাগ্নে নিঝুম আমেরিকা চলে যাওয়ার পর এই ভূতেদের কর্মকাণ্ডে ওরা অতিষ্ট হয়ে গেল।

অত্যাচারে থাকতে না পেরে উপরের তলায় দুইমাত্র বাসিন্দাও কয়েকদিনের মধ্যে বাসা ছেড়ে দিল। পুরো ফ্লোরে রয়ে গেল শুধু দিদিরাই।

প্রতিবেশীরা বাসা ছেড়ে দেওয়ার পর বাড়িওয়ালার টনক নড়লো। উনি মিলাদ পড়ালেন। সেদিন মিলাদ শেষে হুজুর বললেন, “এই বিল্ডিংয়ে একটা ছেলে থাকত। ও মিউজিক বাজাত। উনি মিউজিকটা খুব পছন্দ করতেন। এখন ছেলেটা নাই। সেজন্য উনি রেগে আছেন।”

এটা শুনেই দিদি হতবাক হয়ে গেল। কারণ নিঝুম যে সারারাত গান-বাজনা করে, গান শোনে আরও বিভিন্ন অ্যাকটিভিটি করে সেটা ওই হুজুরের জানার কথা না। নিঝুমকে ফোন করে এই কথাটা জানানোর পর ও বলল, “এটা তো আমি আগে থেকেই জানি। আমার রুমের যে রকিং চেয়ারটা, সেটা হঠাৎ হঠাৎ নিজে নিজেই দুলত। এইজন্যই তো আমি ওটা বের করে দিছি রুম থেকে।”

এই কনভারসেশনের পর পরই ওরা বাসা ছেড়ে দেয়। বাসা ছাড়ার পর লোকমুখে বিভিন্ন ধরনের তত্ত্ব শোনা যায়। কেউ বলে ওই বিল্ডিংয়ের এক কাজের মেয়েকে খুন করে লাশ ছাদে ফেলে রাখা হইছিল। রাতে মেয়েটার আত্মা হাঁটাহাঁটি করে। কেউ বলে, “উনি তো অনেক দিন ধরেই আছেন। ভালো জ্বীন। উনি নামায পড়েন। কখনো কারো ক্ষতি করেন না। এই এলাকার সব দারোয়ান, দোকানদার দেখছে উনাকে। চেনে সবাই।”

জ্বীন-ভূত রিলেটেড বেশিরভাগ তত্ত্বেই কোনো না কোনো মৃত মানুষের সূত্র থাকে। কিন্তু কথা হইল, মানুষ মরে যাওয়ার পর যদি ভূত হয়ও তাহলে ভূত খারাপ কিছু হতে যাবে কেন? বরং এটা তো খুশির বিষয় যে মরে গিয়ে কেউ শেষ হয়ে যায় নাই। সে আছে আশেপাশে। বৃষ্টির দিনে জানালার পাশে বসে পা নাড়াচ্ছে। আমি আইসক্রিম খেতে গেলে স্কুপটা সরায়ে অন্য কোথাও রেখে দিচ্ছে। আমি বাসায় একা থাকলে, একা একা অফিস করলে আমার আশপাশে থেকে আমার কাজ দেখতেছে, আমার সাথে বসে নেটফ্লিক্স দেখতেছে। কোনো মানুষ যদি শুধু খারাপ কিংবা শুধু ভাল না হয় তাহলে ভূত কেমনে শুধু খারাপ বা শুধু ভাল হইতে পারে?

তো আমি আরও একটা জ্বীন, ভূত, অলৌকিক কিছু শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। কিন্তু মামি যে গল্পটা বলল সেটা আরও ইন্টারেস্টিং। মাসেন খিয়ান নামে এক নার্স। তিনি অনেকগুলি ভাষায় কথা বলতে পারেন। চট্টগ্রামের লোকাল ভাষা, গারো ভাষা, চাকমা ভাষা, ইংরেজি, প্রমিত বাংলা এবং ঊর্দু। উনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন সেটা জানি না। কিন্তু উনি মৃত মানুষকে জীবিত করে ফেলতে পারতেন।

কীভাবে?

ভয় দেখায়ে।

উনি লাশদের ভয় দেখাতেন।

আমি সারাজীবন শুনে আসছি। লাশেরা মানুষকে ভয় দেখায়। উনি উল্টা। কোনো একদিন উনি দেখছেন হাসপাতালে এক রোগীকে মৃত ঘোষণা করা হইছে। চারদিকে কান্নার হিড়িক, মরদেহ হাসপাতাল থেকে বের করে সৎকারের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। ঠিক অ্যাম্বুলেন্সে তোলার মুহূর্তে লাশটা জেগে উঠল। আরেকটু হইলেই হয়ত উনাকে দাফনের কাপড় টাপড় পরায়ে ফেলা হইত।

এরপর থেকে মাসেন খিয়ান লাশদের ভয় দেখান। মুখ দিয়ে এমন এমন সব শব্দ করেন তাতে যেকোনো মানুষেরই বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে যাবে। এই টোটকা কাজেও দিছে। একবার এক মৃত লাশ তার উদ্ভুতুড়ে শব্দ শুনে হুড়মুড় করে জেগে গেছে। ব্যস! এই ঘটনার পর তাকে আর থামায় কে? উনি সময়-অসময় মর্গে ঘুরে ঘুরে নানা রকম সাউন্ড করতেন। নাইট ডিউটিতে সারারাত অদ্ভুত সব শব্দ করে রোগীদের ভয় দেখাতেন।

কী ধরনের শব্দ?

সাপের ছোবল দেওয়ার আওয়াজ, বাচ্চার কান্নার আওয়াজ, প্রেতাত্মার হাসির আওয়াজ ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভিন্ন সুরে নানান কৌশলে এসব শব্দ করতেন তিনি। ঠিক শব্দ না। একধরনের গানের মত বিষয়। খুবই গোছানো সাউন্ড। এই ব্যাপারে তার বিশেষ মেধা ছিল। জরুরি বিভাগের শয্যাশায়ী রোগীরা তার কারণে বিছানা ছেড়ে, হাসপাতাল ছেড়ে রাত-বিরাতে পালাত। উনি তাতে খুশি হতেন। কারণ যে রোগীর হাঁটার মতো অবস্থা নাই সেই রোগীকে উনি দৌড় দেয়াতে পারতেন।

মাসেন খিয়ানের কারণে হাসপাতালের বাকিসব স্টাফরাও বিপদে পড়ে গেলেন। যে রাতে তিনি ডিউটিতে থাকেন সে রাতে অন্য ডাক্তার, নার্স, দারোয়ান কেউই হাসপাতালে আসতে চাইতেন না। শেষে তাকে চাকরিচ্যুত করা হইল। এরপর তিনি বাচ্চাদের স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।

সুচিস্মিতা তিথির আরো লেখা: মুনিরুল ইসলাম মুনির

একাত্তরে যুদ্ধের সময়ও মাসেন খিয়ান হাসপাতালে কাজ করতেন। তখন নাকি পাকিস্তানপন্থী লোকজন হাসপাতালে গ্যাঞ্জাম করতে আসলে উনি এমন সব শব্দ করতেন যে ওরাও “বাপ” “বাপ” বলে পালাত।

মাসেন খিয়ানের গল্প শুনে আমার মনে হইল তার সঙ্গে দেখা করে বিষয়টা শিখে নেওয়া দরকার। আমার বাসায় যে ভূতটা ঘুর ঘুর করে, আমাকে ভয় দেখানোর জন্য ড্রেসিং টেবিলে আঙুলের ছাপ রেখে যায় ওকে পাল্টা ভয় দেখানোর উপায় একমাত্র মাসেন খিয়ানই আমাকে শিখায়ে দিতে পারেন।

অথবা উদ্ভট মিউজিকের কারণে বন্ধুত্বও হয়ে যেতে পারে।

এলিফেন্ট রোড, ঢাকা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২

লেখক পরিচিতি
জন্ম ১৯৯৭ সালের ১৩ জুন। ২০১৪ সালে এসএসসি ও ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। পাশাপাশি ‘দ্য ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় কাজ করেন। ২০১৪ সাল থেকে লেখালিখি, অনুবাদ ও সম্পাদনার কাজ করছেন।