আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে, সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুবই তাৎক্ষণিক ও ক্ষণস্থায়ী একটি মিডিয়া। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও ওয়েবসাইটের চেয়ে ক্ষণস্থায়ী এই যোগাযোগ ব্যবস্থা।

সংবাদপত্র প্রতিদিন প্রকাশিত হয়, দিনশেষে অনেক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয়ে প্রকাশিত সংবাদপত্রটি বাসি পত্রিকা হিসেবে গণ্য হয়। ধরা যাক, একটি সংবাদপত্রে আপনার ছবি ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। পাঠক হিসেবে আমি যদি সেই পাতাটি না ওল্টাই তবে আপনার সাক্ষাৎকার ও ছবি আমার মনে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করার কথা সেটি তৈরি করবে না। কিন্তু ছাপা কাগজে যদি আমি সেই সাক্ষাৎকার ও ছবি দেখি তবে সেটি আমার স্মৃতিতে থেকে যাবে। আর দৈবক্রমে সেটি যদি আমি পড়ি তবে তার প্রভাব আমার মনের মধ্যে তৈরি হবে।

টেলিভিশন কিছুটা ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কাজ করে। হঠাৎ আমি টেলিভিশনের চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে একটি চ্যানেলে দেখলাম আপনি বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে কথা বলছেন। আমি আপনাকে দেখলাম, আমার মনে হলো আপনি একজন ফুটবল বিশেষজ্ঞ এবং এ কারণেই আপনি ফুটবল বিষয়ে বলার জন্য একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আমন্ত্রণ পেয়েছেন। আপনার কথা আমি হয়তো কিছুটা শুনলাম, তারপর চ্যানেল পরিবর্তন করে অন্যত্র চলে গেলাম। কিন্তু একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আপনাকে দেখার স্মৃতি আমার মনের মধ্যে রয়ে গেল।

আবার ধরুন, আপনি একটি ওয়েবসাইটে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। আমি হয়তো ওয়েবসাইটটি পড়ি না। ফলে আপনার এই লেখাটি আমার চোখে পড়বে না। কিন্তু হঠাৎ যদি আমি ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়ি, তবে হয়তো আপনার লেখাটি পড়বো। যদি না পড়ি তবে আপনার ছবি ও লেখা আমি দেখবো। শিরোনাম দেখে ধারণা করবো আপনি কী বিষয়ে লিখেছেন।

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, আমি যদি কোনো পত্রিকা, টেলিভিশন ও ওয়েবসাইটের নিয়মিত পাঠক দর্শক ও গ্রাহক না হই তবে সেগুলো আমার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে‌ না।

কিন্তু সাবস্ক্রাইবার হিসেবে আমার অবস্থান অনেক সময় অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। আমি নির্দিষ্ট পত্রিকা টেলিভিশন ওয়েবসাইটের গ্রাহক না হলেও সেগুলোর প্রভাব আমার ওপর পড়তে পারে।

কেননা, যারা পত্রিকায় লেখেন, টেলিভিশনে মুখ দেখান বা নামি ওয়েবসাইটে লেখা ছাপান তারা মূলত কমন ব্যক্তি। ঘুরেফিরে তাদের নাম সর্বত্রই দেখা যায়। ফলে কোনো না কোনো ভাবে তারা আমাদের চোখে পড়েন। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মত কী সেটি আমাদের জানা হয়ে যায়। এভাবে তারা সমাজের পরিচিত মুখ হিসেবে গণ্য হন। একসময় তারকা খ্যাতিও তাদের তৈরি হয়। আমরা তাদের মত সাবস্ক্রাইব করি বা না করি, তাদের সম্পর্কে জানি বা না জানি, তারা আমাদের সমীহ আদায় করে নিতে পারেন।

ফলে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া কোনো না কোনো ভাবে সক্রিয় থাকে।

তাহলে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কীভাবে কাজ করে?

অনেকেই বলেন সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো কার্যকারিতা নেই। এগুলো মূলত ক্ষণস্থায়ী ও তাৎক্ষণিক বলে এর কনটেন্ট অডিয়েন্সের মনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। আসলে কি ঘটনা সেরকম?

আমরা যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের টাইমলাইন দেখি, তবে তেমন ভ্রম হতেই পারে। ফেসবুকে একের পর এক ভিডিও ছবি গ্রাফিক্স লেখা আসছে। কোনোটা আপনার চোখে না পড়লে সেটি হারিয়ে গেল চিরতরে। ইউটিউবে হাজার হাজার ভিডিও আসছে, হারিয়ে যাচ্ছে। টিকটক টুইটার সবখানেই এই পরিস্থিতি।

কিন্তু আসলেই কি হারিয়ে যাচ্ছে?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শর্ত কী? এখানে প্রথমেই একজন আরেকজনের সাবস্ক্রাইবার হন। টুইটার হয়তো অনেক বড় জগৎ, কিন্তু আপনি যার সাবস্ক্রাইবার হলেন তাদের কনটেন্টই আপনার চোখের সামনে আসবে। ফেসবুকেও তাই।

কিন্তু এই মাধ্যমগুলোতে একটা চালাকি আছে। আপনি যার কনটেন্টের ভোক্তা, তিনি কিন্তু আপনার সমানই। তিনিও আপনার ভোক্তা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনারা দুজনই সমান। চাইলে আপনিও কনটেন্ট তৈরি করতে পারেন। ছবি ভিডিও দিতে পারেন। লেখা পোস্ট করতে পারেন। যার লেখা আপনার ভালো লাগছে তাকে আপনি লাইক কমেন্ট দিতে পারেন। তার ইনবক্সে মেসেজ পাঠাতে পারেন। ফলে, ডিজিটাল ডেমোক্রেসির এই ইউটোপিয়ান যোগাযোগ ব্যবস্থায় আকবর বাদশাহ ও হরিপদ কেরানির মধ্যে খুব বেশি তফাৎ নেই। আসলে তো আছে।

কিন্তু এই মাধ্যমের রূপটাই এরকম। সকলেই সমান এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে অনেকেই হয়তো একজনের গ্রাহক হয়ে পড়েছেন। এর মূল কারণ কী?

ফেসবুকের একটা জরিপে দেখেছিলাম, এখানকার খুব কম মানুষই কনটেন্ট তৈরি করতে পারে। বেশিরভাগ মানুষ কোনো ব্র্যান্ড, ইভেন্ট, হিরো বা স্পেসের সাবস্ক্রাইবার হয়ে সেগুলোকে শেয়ার করতে থাকে। অধিকাংশ মানুষের জন্য এটা নিরাপদ এবং নিজেকে দেখানোর ভালো পদ্ধতি। এ কারণে ব্র্যান্ডগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায়। মূল ধারার মিডিয়ার সঙ্গে ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যমের এখানেই সাজুয্য।

কিন্তু, সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরো একটি ধারা প্রবাহমান। মেইনস্ট্রিমের বাইরে অল্টারনেটিভের সন্ধান একটা বড় প্রবণতা। ফলে লোকে প্রতিনিয়ত নতুন কনটেন্ট ব্রাউজ করতে থাকে, খুঁজতে থাকে। যা বলতে চান তা কেউ বলেছে কিনা সেটা বের করতে থাকে। এই লোকগুলো কনটেন্ট নির্মাতাদের সাবস্ক্রাইবার হয়ে যায়। এভাবে কেউ হয়তো বিখ্যাত ইউটিউবার, কেউ বিখ্যাত ফেসবুকার হয়ে পড়েন। তাদের লাখ লাখ অনুসারী তৈরি হয়।

এই সেলিব্রিটিদের বাইরেও ছোট ছোট গণ্ডিতে অসংখ্য সেলিব্রেটি কাজ করতে থাকে। কেউ হয়তো ফান করতে থাকে, কেউ নিয়মিত ছবি দেয়, কেউ ভিডিও দেয়, কেউ বা সমাজ-সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করতে থাকে। যত যাই বলি এই সংখ্যাটা খুব কম। এখন মনে নেই ফেসবুকের কত পারসেন্ট মানুষ নিজস্ব কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে। তবে সেটা ১০% এর বেশি হবে না। বেশিরভাগ মানুষ কনটেন্ট তৈরি করার একটা আবহের মধ্যে থাকে। তারা অন্যের কনটেন্টকে নিজের কনটেন্ট হিসেবে পুনর্নির্মাণ করে। খুব কম মানুষ এখানে নিজের চিন্তা করে তা প্রকাশ করতে পারে।

সেটা হয়তো হাজারে একজন হতে পারে।

কিন্তু যারা কনটেন্ট তৈরি করতে পারে না তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, এখানে সম্পূর্ণ কনটেন্ট কেউই তৈরি করে না। ধরুন, কেউ একজন সরকারের সমালোচনা করে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করলেন। সেটি একদিনে ২০ লাখ মানুষ দেখে ফেলল। ২০ লাখ মানুষের ভিউ কিন্তু ওই কনটেন্টেরই অংশ। সেখানে ১০০০ কমেন্ট ওই কনটেন্টের শক্তি। যেহেতু ২০ লাখ লোক দেখেছে এবং ১০০০ মানুষ কমেন্ট করেছে সেহেতু ওই ভিডিওটি গুরুত্বপূর্ণ।

ফেসবুকে ঘটনাটি আরও রহস্যময়ভাবে ঘটে। এখানে হয়তো কেউ একটা ছবি দিল, সেই ছবিটা থেকে কেউ একটা মিম বানালো, মিম দেখে কেউ স্ট্যাটাস দিল, স্ট্যাটাস দেখে আরও ১০ জন স্ট্যাটাস দিল। এইসব দেখে একজন বিষয়টি নিয়ে লাইভ করতে ক্যামেরা অন করলো, সেই লাইভ ভিডিও দশ হাজার মানুষ দেখলো—এভাবে একটি বিষয় টক অফ ফেসবুকে পরিণত হলো। এখানে কালেক্টিভড এফোর্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি বিষয়ের ভাগিদার অনেকেই। ফলে এটাকে ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। এটা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় কোনো গুজব ছড়িয়ে পড়লে। দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব প্রথম কে শুরু করেছিল তা কোনোভাবেই বোঝা যায় না। বিষয়টি সবসময় অনুমান নির্ভর হয়ে থাকে।

কোনো ভালো বিষয়ও এখানে একইভাবে ছড়িয়ে যেতে থাকে। ফলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, কিছু মানুষ একই রকম কবিতা লিখছেন, কিছু মানুষ একই রকম চিন্তা করছেন, কিছু মানুষ একই প্যাটার্নে ভাবছেন। ওই মানুষগুলো পরস্পরকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে চলেছেন। এমন হতেই পারে একজন মানুষ ভাবছেন তিনি সবাইকে প্রভাবিত করছেন অথচ আসল ঘটনা হলো অন্য আরেকজন তাদের সবাইকে প্রভাবিত করছে। একজন মানুষ হয়তো ভাবছেন তিনি এই চিন্তার উৎস, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি আসলে এই চিন্তার সাবস্ক্রাইবার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এরকম একটি জটিল প্রক্রিয়ায় কাজ করে। সব সময়ই মানুষকে স্টার হিসেবে উপস্থাপন করে। উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের অহংকে তৃপ্ত করে। ফলে ভোক্তা যদি উৎপাদকের মতো আচরণ করে তবে কিছুই করার থাকে না। কেউ হয়তো কবি নন, কিন্তু তিনি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কবির মতো আচরণ করতে পারেন তবে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাবেন। কিছু মানুষ থাকে “কবি” সম্বোধন করবেই। এটা একটা ফাঁদ।

মজার ব্যাপার হলো, সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা যাদের দেখি তারা আসলে প্রত্যেকেই আমাদের নায়ক। এটা মোটেও ক্ষণস্থায়ী বা তাৎক্ষণিক মাধ্যম নয়। প্রতিমুহূর্তে আমরা যাদের সাবস্ক্রাইবার তাদের আপডেট আমরা পেতে থাকি। তাদের প্রতিটি বিষয় আমাদের চোখের সামনে ভাসে। যে কারণে আমরা তাদের সাবস্ক্রাইব করি তার বাইরের অনেক বিষয়ও আমাদের মাথার ভেতর ঢুকে পড়ে। তারা আমাদের আওতার মধ্যে থাকে। বছরের পর বছর জুড়ে আমাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে থাকে। এক সময় তাদের মত আমাদের মতে পরিণত হয়। আমরা ভাবতে থাকি আমরাও তারা তারাও আমরা।

একটি জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুরো জিনিসটা কাজ করতে থাকে।

এই বিষয়টি আমরা যদি ভাবি, তবে দেখবো পত্রিকা টেলিভিশন ওয়েবসাইট সমস্ত কিছুর চেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া। কিছুই মূলত এখান থেকে হারায় না। হারায় বলে যে ধারণা আমরা পোষণ করি তা মূলত পুরোনো মাধ্যমের প্রতি আমাদের পক্ষপাত বা নস্টালজিয়া।

২৮ নভেম্বর ২০২২