যে কাউকে স্মাগলার বলতে গেলে প্রথমেই হয়তো আপনার সিনেমাতে দেখা স্মাগলারদের কথা মনে পড়বে। বাংলা সিনেমাতে যাঁরা দীর্ঘদিন ‘ইয়া’ ‘ইয়া’ বলে পেটাই করতেন, পটকা ফাটিয়ে কিছুক্ষণের জন্য সাধ করে দেখতে বসা সিনেমার পর্দা আন্ধার করে দিতেন। পুলিশের সামনে কয়েকটা ট্রাক নিয়ে দ্রুত গতিতে দৌড়াদৌড়ি করতেন। একটা সুবিধা ছিল ওইসব সিনেমা শুটিংয়ের সময় ওই রাস্তাগুলোতে উল্লেখযোগ্য ট্রাফিক না থাকায় এই দৌড়কর্ম পরিচালকের ইচ্ছামাফিক হতো। এবং অতি অবশ্যই সামনে থাকা ছোটখাট কনস্টেবল কিংবা স্মাগলিংয়ের বিপক্ষের দেশাত্মবোধক নায়কের দুচারটা মিত্রকে ঢিসুম ঢিসুম করে মেরে দিতেন। তবে হ্যাঁ, সিনেমাতেও স্মাগলার কর্তৃক নায়ক নিধন হতে দেখা যায় না। এটা দর্শকরাও বরদাশত করতেন বলে মনে হয় না।

মানস চৌধুরী

বাস্তবে আমি প্রথম স্মাগলার দেখি লুঙ্গি ও শাড়ির। মেসতা বলে একটা তন্তু বা ফাইবার চালু ছিল। কথিত ছিল এটা মেসতা পাটের তন্তু। এসব কথন থেকে প্রকৃত পরিচয় নাও হতে পারে তা সত্য। তবে এই তন্তুজাত শাড়ি ও লুঙ্গিগুলো দেখতে খুবই আকর্ষণীয় লাগত। আমার যদি ঠিক মনে পড়ে থাকে, আমার লুঙ্গি-অভিষেকের পর প্রথম দিকে কয়েকটা মেসতা-লুঙ্গি ছিল। নানাবিধ বর্ণিল রঙ ও ছাপা ছিল এসব লুঙ্গির বৈশিষ্ট্য।

লুঙ্গি এমনিতেই আরামের এক ডিব্বা। তার মধ্যে এই লুঙ্গিগুলো পরার আরামের বর্ণনা দিতে গেলে প্রায় না-পরার অনুভূতি স্মরণ করতে হয়। বস্তুত, তখন আমি ছিলাম মুখ্যত লুঙ্গিবিদ্বেষী এক রুচির দাবিদার যুবকের পথে গজায়মান কিশোর। তাই লুঙ্গি পরবার আরাম বোধ করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুত লোক ছিলাম না। তবে এটা প্রায় না-পরার শামিল অনুভূতি হওয়াতেই হয়তো মনে আছে। খানিকটা অধুনা যাকে লিলেন বলা হয়, সেইরকম একটা তন্তুধর্ম এর। এই লুঙ্গি-শাড়িগুলো তৈরি হতো ভারতে।

ফলে, আপনারা বুঝতেই পারছেন, মেহেরপুর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে থাকা ভারতের এই শাড়ি ও লুঙ্গিগুলো খামোকা কষ্ট করে দিল্লি-কোলকাতা-ঢাকার প্রশাসকদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে মেহেরপুর আসত না। এগুলো উৎসাহী সওদাগরের নাভির আশপাশে দুচারটা গোঁজা অবস্থায় আসত। তার মানে সওদাগরদের এর আগে ভারতের বহরমপুর, কৃষ্ণনগরের বাজারে যেতে হতো এবং অতি অবশ্যই ঢোলা জামাকাপড় পরতে হতো যাতে খান চারেক শাড়ি-লুঙ্গি ভুঁড়ি হিসাবে বেঁধে আনা যায়। কিন্তু এ কথাও অংকের মতো সত্য যে চারখান লুঙ্গির জন্য কোনো সওদাগরের বাংলাদেশের সীমানা ভেদ করে কৃষ্ণনগরের বাজার পর্যন্ত গেলে লুঙ্গিনির্মিত ভুঁড়ি জুটতে পারে, কিন্তু সেই ভুঁড়িতে কিছু খাদ্যপানি দেবার জন্য টাকা উঠবে না। এখানেই আসছে স্মাগলিংয়ের নানাবিধ প্রকরণ বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারস্যাপার।

তাহলে দেখা যাচ্ছে পেটের আশপাশে ঢোলা পাঞ্জাবির নিচে যারা ভারতীয় শাড়ি ও লুঙ্গি বেঁধে আনতেন তাঁরা কিছুতেই ভারতের বাজার পর্যন্ত যেতেন না। শুধু যে পুরুষেরা আনতেন তা নয়, আনতেন নারীরাও। তাঁরা অবশ্যই পাঞ্জাবি নয়, শাড়ির নিচে লুকিয়ে আনতেন। এই ৪/৫ টি লুঙ্গি-শাড়ি আনয়নকারীরা প্রায়শই দীর্ঘ ৫/৬ কিলোমিটার পথ হাঁটতেন। না, দুইগুণ করতে হবে। কারণ সীমানা পর্যন্তই ওই দূরত্ব; তাহলে যাওয়া আসা মিলে কম বেশি ১০-১২ কিলোমিটার। আর তাঁদেরকে সীমান্ত এলাকায় এই বস্তুগুলো পৌঁছে দিতেন যাঁরা তাঁরা, সাধারণ বুদ্ধিতে ভেবে দেখুন, ভারতীয় নাগরিক। “নিজ” দেশের বাজার থেকে এগুলো কিনে এনে দিচ্ছেন। আমাদের “স্বদেশী” স্মাগলার ১২ কিলোমিটার হণ্টন এবং গোটা চারেক শাড়ি লুঙ্গি সমেত এক রাউন্ড শেষ করছেন। এই এক রাউন্ড এক দিনে শেষ করতেই মোটামুটি জিহ্বা বের হয়ে যাবার জোগাড়।

যদি আমরা ধরে নিই যে দেশাত্মবোধক পুলিশ ও দেশরক্ষাকারী বিজি, যাঁরা তখন ছিলেন বিডিআর, এই কৃত্রিম ভুঁড়িওয়ালা স্মাগলারদের কাউকে কোথাও আটকায়নি, বা চটকায়নি, তাহলেও সপ্তাহে চারটা ট্রিপ বড়জোর তাঁরা দিতে পারতেন। এখন লভ্যাংশের খতিয়ানও দেয়া যায়। এই রচনার পাঠককুলের জন্য তা স্পয়লার হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কথা হচ্ছে ৪০ বছর আগের। অংকটা আসলেই ধ্যাবসাই হবে। এখানে মূল আলোচ্য প্রসঙ্গ হচ্ছে, ওই যে ইয়া-ইয়া করতে থাকা, দাঁতমুখ ভেংচাতে-থাকা, আর মুহূর্মুহূ পটকা ফাটিয়ে ট্রাক নিয়ে দৌড়াতে থাকা সিনেমাটিক স্মাগলারবৃন্দ তাঁরা প্রথম, এমনকি কখনোই, আমার পরিচিত হন নাই। আপনাদেরও যে হন নাই তা আমি হলপ করে বলতে পারি। আপনাদের অনেকের সাথেই আমার জ্ঞানের (কিংবা অভিজ্ঞতার) মৌলিক পার্থক্য এই যে আমি জ্যান্ত স্মাগলার দেখেছি; বারান্দায় বসে তাঁদের সাথে গল্প করেছি। কখনো কখনো মায়ের বানানো চা বা সুজির ভাগও তাঁদের সাথে পেয়েছি। আর এসব স্মাগলার যদি আপনাদেরও অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে, তাতেও আপনারা সমাজপাঠ দিতে বসেননি। মেলা পার্থক্য।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে স্মাগলিংয়ের মূল কথা আসলে চোখে একটা পট্টি বেঁধে পিঠে টাকার পোঁটলা বেঁধে দৌড়ে যাওয়া নয়।

যাহোক, ভারতের বাজার থেকে শাড়ি-লুঙ্গি খরিদকারেরা নিছক কোনো বন্ধুবান্ধব নন এঁদের। নিশ্চয়ই সেটা আপনারা বুঝতে পারছেন। তাঁরা আবার ওদিকের স্মাগলার। ফলে সীমান্ত এলাকাতে এঁদের যে বাণিজ্যটা হয় সেটা ঠিক আধুনিক অর্থশাস্ত্রের নিয়মে হয় বলে জানা যায় না। মুদ্রার বদলে দ্রব্যাদি আদানপ্রদান ঘটে। যে সময়ের কথা হচ্ছে, কমবেশি ১৯৭৮ সাল থেকে পরের দশ বছর, তখন পর্যন্ত ভারতীয় স্মাগলাররা নিতেন, জানা মতে, নাইলনের সুতা আর গুঁড়া দুধ। মানে এই দুটো লুঙ্গি-শাড়ির মতোই মেরিটলিস্টের শীর্ষে থাকা বলে ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়। নিশ্চয়ই আরো আরো জিনিস থেকে থাকত। যতই বিস্ময়কর হোক না কেন, এমনকি কখনো কখনো দেশলাই বা ম্যাচবক্সও এই তালিকায় ছিল। এটা অতি অবশ্যই আপনাদের জন্য অত্যন্ত জটিল এক জিজ্ঞাসা যে দ্রব্যাদি নির্ধারণ হতো কীভাবে! আপনাদের মধ্যে যাঁরা অর্থশাস্ত্রের পণ্ডিত তাঁরা এক বাক্যে বলে দেবেন “ইহা চাহিদা দ্বারা নির্ধারিত হয়।” বটেই! কিন্তু আমার মতো সেয়ানা যাঁরা তাঁরা নিশ্চয়ই আরো পেঁচাবেন। আর জানতে চাইবেন কেন ও কীভাবে রাষ্ট্রপ্রান্তের এই জনপদগুলোতে ততোধিক প্রান্তীয় মানুষজনের দৈনন্দিন প্রয়োজনে একটা দুটো পণ্যের আকাঙ্ক্ষা দেখা দিত এবং কেন ও কীভাবে এসব সরু-সরু স্মাগলাররা তা জেনে যেতেন; ইত্যাদি। বলাই বাহুল্য, পণ্ডিতদের কাছে এত তুচ্ছ বিষয়ে প্রশ্ন না করাই মঙ্গল।

তবে অপণ্ডিতদেরও সুবিধার শেষ নাই। তাঁরা চাইলে বাসায় বসে ভেবে-ভেবেও মেলা কিছু বের করে ফেলতে পারেন। এছাড়া, ওই যে, খোদ লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে আরো কিছু বুঝতে পারেন। একেকটা রাষ্ট্রের একটা নির্দিষ্ট সময়কার আইন, কিংবা আমদানি-রপ্তানি নীতি, কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থা এসবের সাথে দ্রব্যের চাহিদার গুরুতর সম্পর্ক আছে। যেমন, বাংলাদেশে ওই সময়ের আইনে তুলাজাতীয় কিছুই দেশে আমদানি করা যেত না। এটা ‘বৈধ’ রাস্তার কথাই হচ্ছে। আজকের ‘অবাধ/মুক্ত’ বাজারে আপনাদের যতই তা নিয়ে হাসি পাক না কেন। ওদিকে ভারতে মেস্তা হোক বা খাস্তা, আসলে তা সস্তা। অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল লোকের জন্য সেসব তাই আকর্ষণীয় ছিল। আবার ভারতের সরকার দুগ্ধোৎপাদকদের প্রতি ভালবাসা জানাতে কোনোরকম দুধামদানি নিষেধ করে রেখেছিল। ফলে বৃহত্তর নদীয়া জেলার প্রান্তে থাকা অসচ্ছল লোকদের বাংলাদেশের বাজারের গুঁড়াদুধের প্রতি টান থাকা আবশ্যিকভাবেই আমুল বা মহারাষ্ট্রের রাজ্যীয় কোম্পানির প্রতি বিদ্বেষ নয়। যাহোক, গুঁড়াদুধের বিষয়টাও আজকের পাঠক খুব বুঝবেন না। ড্যানো, ডিপ্লোমার খদ্দেররা বুঝবেন কম। এটা ছিল প্রায় সারের বস্তার মধ্যে ২০-২৫ কেজি করে রাখা গুঁড়া দুধ যা বাংলাদেশ বৈদেশ থেকে আমদানি করত।

সব মিলে মেলা রকম প্যাঁচ কষেই কেবল এটা আপনাদের বুঝতে হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে স্মাগলিংয়ের মূল কথা আসলে চোখে একটা পট্টি বেঁধে পিঠে টাকার পোঁটলা বেঁধে দৌড়ে যাওয়া নয়। তেমনি পটকা ফাটিয়ে দুনিয়া আন্ধার করে ট্রাক নিয়ে পলায়া যাওয়াও নয়। স্মাগলিং নিত্যদিনের একটি নিরীহ ঘটনা মাত্র হতে পারে। স্মাগলিং হচ্ছে তাই যা রাষ্ট্রীয় (লিখিত) আইনে মানা করা আছে। এইখানেই মেলা সব জটিল আলাপ আসতে যাবে যা আসলে একদিনে এবং একপিসে আপনাদের সামনে খোলাসা করা অসম্ভব ব্যাপার। এখানে রাষ্ট্রীয় আইন আর লিখিত আইনের চক্করই কেবল সবটা চক্কর নয়। চক্কর আছে কোনটাতে চোখ খুলে রাখা হয়, কোনটাতে রাষ্ট্র খানিক চোখবুঁজে আলসেমি-নিদ্রা দেয়, কোনটাতে পট্টিটা শেষমেশ রাষ্ট্রের চোখেই বাঁধা হয়, কোন পণ্যের চাহিদা কোথায় (প্লিজ অর্থশাস্ত্রবিশারদবৃন্দ, আপনাদের এলাকা), কোন পণ্যের মূল্যমান কী, কোনটা কোথা থেকে আনা হয়, কোনটা কী দামে আনা হয়—বলে শেষ করা যাবে না।

ওই যে সরু সরু স্মাগলারবৃন্দ! ওঁদের সাথে কি কখনো পুলিশের দেখা ঘটেনি? আলবৎ ঘটেছে। পুলিশ কি তাঁদের সাথে চা-সুজি নিয়ে খোশগল্পে বসেছিলেন? সম্ভাবনাই নাই। সীমান্তে কি তাঁদের কখনো বিডিআর কখনো বিএসএফ মুলাকাত ঘটেনি? এর উত্তর জিজ্ঞাসা করেও পাবার দরকার নাই। ঠ্যাঙানি কি জোটেনি?! আহা! কী বলেন! তবে এসব কিন্তু ৮০০-১০০০ টাকার বাণিজ্যের হিসাব চলছে। আবার নানাবিধ মায়ামমতার গল্পও আছে। “ওই খাইতে গেলাম, আধঘণ্টা পরে আসুম, পরে য্যান আর না দেখি এই রাস্তায়”—এরকম ভাষ্যে বাংলায় বা হিন্দিতে বিডিআর বা বিএসএফ বলে একটু ফোঁকর করে দিয়েছেন, সেরকম গল্পও দুচারটা আছে। কিন্তু মায়ামমতায় ঢুকলে আমরা আলোচ্য বিষয় থেকে ফস্কে যেতে পারি। বরং, আরো জরুরি হবে সমান্তরাল কয়েকটা বিষয়কে মাথায় রাখা—কালোবাজারি, বেআইনি ইত্যাদি আর চোরাচালানি বা স্মাগলিংয়ের সম্বন্ধও তো সহজ কিছু নয়! কিন্তু একপিস নিবন্ধে আমরা তা নিষ্পত্তি করতে পারব না। আজ আমাদের ছুটি।

আদাবর, ঢাকা, ২০ নভেম্বর ২০২১