সমুদ্রে স্রোত প্রবাহের অনেক গভীরে অন্য যেকোনো শক্তির চেয়ে আলাদা এক ধরনের শক্তির উৎস আছে। এই শক্তি সংগ্রহ করার জন্য জাপানি প্রকৌশলীরা যেন সত্যিকারের একটি দানব তৈরি করেছেন। দানব আকারের প্রকাণ্ড এই টার্বাইন সমুদ্রের সবচেয়ে শক্তিশালী স্রোত নিমেষেই মোকাবেলা করতে পারে। এটি সমুদ্রের স্রোতের প্রবাহ থেকেই সীমাহীন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম।

‘ইশিকাওয়াজিমা-হারিমা হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামের প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ‘আইএইচআই কর্পোরেশন’ নামে পরিচিত। তারা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। তাদের ডিজাইন পরীক্ষা করে দেখার জন্য ২০১৭ সালে ‘নিউ অ্যানার্জি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ (NEDO)-এর অংশীদার হয়েছে।


মাইক ম্যাক্রে
সায়েন্স অ্যালার্ট, ১০ জুন ২০২২


এ বছরের (২০২২) ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পটি জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের পানিতে সাড়ে তিন বছরের একটি সফল ফিল্ড টেস্ট শেষ করেছে। যার মাধ্যমে এটি অতিক্রম করেছে বড় একটি মাইলফলক।

আরো পড়ুন: ভার্টিকাল ফার্মিং: যে ১৩ উদ্ভাবন বদলে দেবে কৃষির ভবিষ্যৎ

৩৩০ টনের এই প্রোটোটাইপটিকে জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘কাইরিয়ু’। শব্দটির অনুবাদ হয় অনেকটা ‘সমুদ্র বিদ্যুৎ প্রবাহ’ এর মতো। এর কাঠামো একটি ২০ মিটার (৬৬ ফুট) লম্বা ফিউজলাজ (মূল অবয়ব) দিয়ে গঠিত। দুই পাশে একই আকারের দুটি সিলিন্ডার অবস্থিত। এর প্রতিটিতেই ১১ মিটার দীর্ঘ একটি টার্বাইন ব্লেড সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা আছে।

যখন ডিভাইসটিকে নোঙ্গর করে পাওয়ার ক্যাবলের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে সংযুক্ত করা হয়, এটি গভীর-জলের স্রোত প্রবাহের চাপ থেকে শক্তি উৎপন্ন করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর অবস্থান খুঁজে নিয়ে সেই শক্তি একটি গ্রিডে পৌঁছে দিতে পারে।

জাপান এমন একটি দেশ, যা প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আবার ২০১১ সালের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া পারমাণবিক শক্তির প্রতি জনসাধারণের স্পর্শকাতর মনোভাবের কারণে বর্তমানে জাপান নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। এ কাজে তারা ব্যবহার করছে নিজ দেশের প্রযুক্তিগত দক্ষতা৷

'সীমাহীন' বিদ্যুশক্তি উৎপাদনে সমুদ্রে বিশাল আকারের টার্বাইন বসাচ্ছে জাপান
কাইরিয়ু-র যন্ত্রাংশ

দুর্ভাগ্যবশত, পাহাড়বেষ্টিত জাপানি দ্বীপগুলিতে ঘন বনজঙ্গল আছে। সেখানে উইন্ড টার্বাইন বা সৌর প্যানেল ব্যবহার করার সুযোগ সামান্যই। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে জাপানের অবস্থান অপেক্ষাকৃত বেশি দূরের হওয়ার কারণে জ্বালানি বাণিজ্যের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার সুযোগও তাদের কম।

তবে জাপানের একটি জিনিসই আছে, তা হলো বিস্তৃত উপকূলীয় এলাকা। দেশটির পূর্ব দিকে সাগর উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় বলয়ের অধীনে ঘুরছে। যেখানে এ বলয় জাপানের সাথে মিলিত হয়, সেটি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী একটি প্রবাহ। একে কুরোশিও স্রোতপ্রবাহ বলা হয়।

‘আইএসআই’ অনুমান করছে, এই শক্তিকে যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে প্রায় ২০৫ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। তাদের দাবি, এই সংখ্যাটি দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাছাকাছি।

টার্বাইন
যেভাবে কাজ করবে কাইরিয়ু

তবে সাগরের নিচে স্রোতের তুমুল গতির ফলে বিপুল সম্ভাবনাময় এই শক্তির উৎস ব্যবহার করা বেশ কঠিন। সবচেয়ে দ্রুত প্রবাহিত স্রোত মূলত থাকে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি। এটি এমন জায়গা, যেখানে টাইফুন সহজেই পাওয়ার স্টেশনগুলিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।

আর কাইরিয়ুকে স্রোতের প্রায় ৫০ মিটার নিচে কাজ করার উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছিল। যেহেতু এটি পৃষ্ঠের দিকে ভাসছে, এর ফলে তৈরি হওয়া টান টার্বাইনে প্রয়োজনীয় টর্ক (ঘূর্ণন অথবা পাক সৃষ্টিতে সক্ষম শক্তিবিশেষ) সরবরাহ করে। ডিভাইসটিকে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল রেখে প্রতিটি ব্লেড বিপরীত দিকেও ঘোরে।

দুই থেকে চার নট (প্রতি সেকেন্ডে প্রায় এক থেকে দুই মিটার) প্রবাহের মাধ্যমে কাইরিয়ু মোট ১০০ কিলোওয়াট শক্তি তৈরি করতে পারে বলে দেখা গেছে।

আরো পড়ুন: গলবে না বা নষ্ট হবে না এমন বরফ উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা

উপকূলে রাখা একটি সাধারণ উইন্ড টার্বাইন থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় ৩.৬ মেগাওয়াট। এর সাথে কাইরিয়ুয়ের তুলনা করলে ফলাফল বেশ অল্প মনে হতে পারে। কিন্তু শীঘ্রই কাইরিয়ু এর ২০ মিটারের এই টার্বাইন ব্যবহার করার মাধ্যমে ২ মেগাওয়াট পর্যন্ত শক্তি উৎপাদন করতে পারবে জাপান।

যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে, তাহলে দেখা যাবে আগামি দশকেই এ পদ্ধতিতে পাওয়ার জেনারেটরের একটি ফার্ম  গ্রিডে গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। তবে কাইরিয়ু আসলেই তার উৎপাদন মাত্রা বাড়াতে পারবে কিনা, তা দেখার বাকি আছে এখনো।

তুলনামূলকভাবে এই নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কম। প্রচুর রিজার্ভ থাকায় এই শক্তির উৎসের প্রতি বিপুল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও খোলা সমুদ্রের জোয়ার, তরঙ্গ ও স্রোত থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা খুব একটা সফল হয় না। এধরনের প্রকল্পগুলি সফল করার জন্য প্রকৌশলের পেছনে অনেক খরচ, পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা, গ্রিডের সাথে উপকূলীয় অঞ্চলের নৈকট্য ইত্যাদি সব ধরনের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে।

যদি আইএইচআই কর্পোরেশন এসব বাধা কাটিয়ে উঠতে পারে, যেহেতু তাদের কাছে কাইযুর মতো বিশালাকার যন্ত্র থাকবে, সমুদ্রের শক্তি দিয়েই জাপানের শক্তি চাহিদার ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ সরবরাহ করার সম্ভাবনা আছে।

বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং সামুদ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে আরো ভাল বোঝাপড়ার মাধ্যমে সমুদ্রের এই বিশাল শক্তি সরবরাহকে কাজে লাগানোর পথে যেসব বাধা আর সমস্যা রয়েছে, তা কেটে যেতে বাধ্য।

অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ