“অনেকে বলেন, উদ্ভিজ্জ আমিষ শরীরের সমস্ত পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পারে না। এটা আসলে ভ্রান্ত ধারণা।”
অনেকেই আছেন মাছ-মাংসের বাইরে প্রোটিনের বিকল্প খোঁজেন শাক-সবজি, শস্য জাতীয় খাবার বা বাদামে। যেগুলিকে বলা হয় ভিগান প্রোটিন বা উদ্ভিজ্জ আমিষ। অনেকে নিরামিষভোজী। কেউ কেউ আবার মাছ-মাংস খেতে তেমন পছন্দ করেন না, বরং শাক-সবজিই খেতে ভালোবাসেন।
শরীরকে রোগমুক্ত ও সবল রাখতে প্রোটিনের কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় প্রোটিন রাখাটা আবশ্যক। তবে মাছ মাংস একেবারেই না খেতে চাইলে, শুধু শাক-সবজি দিয়ে কি পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন নিশ্চিত করতে পারবেন?
একটি সুপরিকল্পিত খাদ্য তালিকা তৈরির মাধ্যমে নিরামিষভোজীরাও কিন্তু প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় প্রোটিন নিশ্চিত করতে পারেন। তার সঠিক উপায়ও আছে। প্রাণীজ আমিষের তুলনায় ক্যালোরির পরিমাণ কম থাকে বলে, উদ্ভিজ্জ আমিষ হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট ডায়েট।
অনেকে বলেন, উদ্ভিজ্জ আমিষ শরীরের সমস্ত পুষ্টি চাহিদা মেটাতে পারে না। এটা আসলে ভ্রান্ত ধারণা। উদ্ভিদ থেকে এমন কিছু আমিষজাত খাবার পাওয়া যায় যা আমিষের উৎস হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যেমন সয়াবিন, কিনোয়া। সয়াবিন আর কিনোয়া’কে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলার কারণ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ৯টি এসেনশিয়াল অ্যামিনো এসিড’ই এই খাবার দু’টিতে উপস্থিত।
আরো পড়ুন: আপনার খাবারে কার্বোহাইড্রেট বা কার্বস কেন দরকার
সব ধরনের উদ্ভিজ্জ খাবারে কিন্তু আবার এই ৯ অ্যামিনো এসিডের সবগুলি থাকে না। এজন্যই খাদ্যতালিকায় বিভিন্ন রকম আইটেম রাখতে হবে যেন প্রতিদিনের খাবারে ৯টি এসেনশিয়াল অ্যামিনো এসিডই পাওয়া যায়। তাহলেই কেবল উদ্ভিজ্জ আমিষের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব।
কিন্তু দৈনিক কতটুকু আমিষ দরকার?
হার্ভার্ড হেল্থ পাবলিশিং অনুযায়ী, প্রতিদিন একজন মানুষকে তার ওজন প্রতি ০.৮ গ্রাম করে আমিষ খেতে হবে। প্রথমত আপনার ওজনকে পাউন্ডে রূপান্তর করে নিন।
ওজনকে ০.৩৬ দ্বারা গুণ করলেই বের হয়ে যাবে প্রতিদিন কতখানি আমিষ আপনার খাওয়া দরকার। ধরুন আপনার ওজন ১৫০ পাউন্ড, সেক্ষেত্রে আপনার আমিষ চাহিদা হবে ৫৪ গ্রাম। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে অবস্থিত শিরা সুশি নিউট্রিশান-এর স্বত্বাধিকারী শিরা সুশির মতে প্রতিদিন আপনি যতখানি ক্যালরি গ্রহণ করেন তার ১০-৩৫% আমিষ হওয়া উচিত।
উদ্ভিজ্জ আমিষের ডায়েট এই অনুসারে সাজিয়ে আপনাকে প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় প্রোটিন নিশ্চিত করতে হবে।
মাছ-মাংসের বাইরে যে খাবারগুলি থেকে প্রোটিন পেতে পারেন:
১. টোফু
উদ্ভিজ্জ আমিষের উৎস হিসেবে সয়া প্রডাক্ট সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। তবে এগুলির আমিষ প্রোফাইল কেমন হবে সেটা নির্ভর করে প্রস্তুতপ্রণালীর ওপর। যেমন আধা কাপ শক্ত টোফুতে আমিষ থাকে ১০ গ্রাম। মাংসের পরিবর্তে টোফু খাওয়া যেতে পারে। অনেকেই স্যুপ বা স্যান্ডুইচের সাথে টোফু খান। কিছু কিছু ডিশ, যেমন কুং পাও চিকেন ও সুইট অ্যান্ড সাওয়ার চিকেনে মুরগীর মাংসের বদলে টোফু দেওয়া হয়। আমিষের পাশাপাশি টোফুতে থাকে ক্যালসিয়াম ও আয়রন যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারী।
২. ডাল
কমলা বা সবুজ রঙের ডালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ থাকে। আরো থাকে ফাইবার, আয়রন, পটাসিয়ামসহ অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান। আধা কাপ রান্না করা ডালে আমিষের পরিমাণ প্রায় ৮.৮৪ গ্রাম। আমিষের উৎস হিসেবে লাঞ্চ বা ডিনারে ডাল খুবই ভালো অপশান। ডালে আমিষের পরিমাণ বাড়াতে তরকারি, সালাদ বা ভাতের সঙ্গে খেতে পারেন।
আরো পড়ুন: ছাতা পড়া পাউরুটির ‘পরিষ্কার’ অংশ কেন খাওয়া যাবে না—বিজ্ঞান কী বলে?
৩. ছোলা
রান্না করা ছোলা আমিষের দারুন উৎস। আধা কাপ ছোলাতে আমিষের পরিমান প্রায় ৭.২৫ গ্রাম। ছোলা ঠাণ্ড-গরম সব ভাবেই খাওয়া যায়। সাধারণ পদ্ধতির বাইরে অনলাইনে ছোলা রান্না করার অনেক ধরন পাবেন। অনেকে ভুনা করেন, কেউ কেউ সালাদে যোগ করেন আবার কেউ কেউ প্যাপরিকা বা চাট মশলা দিয়ে মাখিয়ে খান। অনেকে ওভেনে বেক করেন। স্টু, কারি ইত্যাদির সাথে ছোলা মিশিয়ে পরিবেশন করলে পুষ্টি উপাদান অনেকাংশে বেড়ে যাবে।
৪. বাদাম
বাদাম হলো আমিষ, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও নানারকম পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি খাবার। হার্ট ভালো রাখতে বাদাম খুবই সাহায্য করে। আধা কাপ বাদামে প্রায় ২০.৫ গ্রাম আমিষ থাকে। ইদানিং বাজারে পিনাট বাটার পাওয়া যায় যেটা চিনা বাদাম দিয়ে তৈরি। পিনাট বাটারও আমিষ সমৃদ্ধ খাবার। অনেকে পাউরুটিতে পিনার বাটার লাগিয়ে স্যান্ডউইচ তৈরি করে নেন। প্রোটিন স্ন্যাক হিসেবে এরকম স্যান্ডুইচ বেশ উপাদেয়।
আর প্রতি আধা কাপ কাঠবাদামে থাকে ১৬.৫ গ্রাম আমিষ। এছাড়াও কাঠবাদামে থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই, যা ত্বক ও চোখের জন্য খুবই উপকারী।
৫. নানা রকম বীজ
বীজ হলো আমিষের অসাধারণ আরেকটি উৎস। যারা খাদ্য তালিকায় উদ্ভিজ্জ আমিষ রাখেন তারা অবশ্যই রোজ কিছু না কিছু বীজ খাওয়ার চেষ্টা করবেন। অবশ্য বীজে ক্যালরির পরিমাণ কিছুটা বেশি হওয়ায়, ওজন বেড়ে যেতে পারে।
৬. স্পিরুলিনা
এটা এক ধরনের এলগি যার রঙ নীল বা সবুজ হয়ে থাকে। প্রতি দুই চা চামচ স্পিরুলিনা’তে ৮ গ্রাম আমিষ থাকে। আরো থাকে আয়রন, ভিটামিন বি। তবে স্পিরুলিনা থেকে ভিটামিন বি ১২ বা ম্যাঙ্গানিজ পাবেন না। বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন স্টোর থেকে পাওডার বা সাপ্লিমেন্ট হিসেবে স্পিরুলিনা কিনতে পারবেন। পানিতে মিশিয়ে, জুস বা স্মুদির সাথে মিশিয়ে বা সালাদের ওপর ছড়িয়ে দিয়েও স্পিরুলিনা খেতে পারবেন।
৭. কিনোয়া
কিনোয়া একধরনের শস্য যাতে প্রচুর পরিমাণে আমিষ থাকে। রান্না করা এক কাপ কিনোয়াতে আমিষের পরিমাণ প্রায় ৮ গ্রাম। কিনোয়াতে আমিষ ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফাইবার ও ম্যাঙ্গানিজ আছে। পাস্তা, স্যুপে কিংবা স্ট্যুতে কিনোয়া মেশালে খাবারের পুষ্টি গুণাগুণ অনেক বেড়ে যায়। চাইলে সালাদের ওপরেও ছড়িয়ে দিতে পারেন।
৮. চিয়া সিড
বীজ জাতীয় খাবারে ক্যালরি তুলনামূলক একটু কম থাকে, কিন্তু বেশ ফাইবার সমৃদ্ধ হয়। তাছাড়া ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের মত জরুরী উপাদানও বীজে পাওয়া যায়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে। চিয়া সিডকে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমিষ বলা হয়।
প্রতি এক চা চামচ চিয়া সিডে ২-গ্রাম এর মত আমিষ পাওয়া যায়। স্মুদি তৈরি করার পরে তাতে চিয়া সিড মিশিয়ে খেতে পারেন। অনেকে টক দইয়ের সাথেও চিয়া সিড মিশিয়ে খান। আবার চাইলে পানিতে ভিজিয়ে রেখে বাদাম দুধেও চিয়া সিড দেওয়া যেতে পারে। অনেকে চিয়া সিড দিয়ে পুডিং তৈরি করেন। বাজারে, সুপারমার্কেটে এবং অনলাইনে চিয়া সিড এখন সহজলভ্য।
আরো পড়ুন: পটাসিয়াম—কম বা বেশি নয়, দরকার সঠিক পরিমাণ
৯. ভাত ও শিমের বীজ একসঙ্গে
শিমের বীজ ও ভাত আলাদা খেলে সবগুলি অ্যামিনো এসিড পাবেন না। কারণ এগুলির কোনোটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ আমিষ না। কিন্তু ভাতে যে অ্যামিনো এসিডের অভাব আছে, সেটা শিমের বীজে পাবেন আর শিমের বীজে যেটার অভাব সেটা ভাতের মধ্যে পাবেন। তাই ভাত আর শীমের বীজ একসঙ্গে খেলে আমিষ চাহিদা অনেকটাই মেটানো সম্ভব।
১০. আলু
একটি বড় সাইজের বেক করা আলু থেকে প্রায় ৮ গ্রামের মতন আমিষ পাওয়া যায়। এছাড়া আলু পটাসিয়াম ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ একটি সবজি। আলুকে আরো একটু উপাদেয় বানাতে এতে ২ টেবিল চামচ হামাস মেশানো যেতে পারে। হামাস হলো মিডিল ইস্টের একটি জনপ্রিয় খাবার। যেটা ছোলা বা আলুকে ম্যাশ করে বানানো হয়। দুই টেবিল চামচ হামাসে আমিষ থাকে প্রায় ৩ গ্রাম।
১১. আমিষ সমৃদ্ধ শাক-সবজি
রঙিন সবজি ও সবুজ শাকে প্রচুর পরিমাণে আমিষ থাকে। তবে শুধু এক ধরনের সবজি বা শাক খেলে পর্যাপ্ত আমিষের জোগান আপনি পাবেন না। তাই কয়েক পদের সবজি একসাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। যেমন একটি মাঝারি সাইজের ব্রকোলিতে ৪ গ্রাম আমিষ থাকে, ৫টি মাঝারি আকারের মাশরুমে ৩ গ্রাম। একসাথে মিশিয়ে তার ওপর কিছুটা কিনোয়া ছড়িয়ে দিলেই কিন্তু উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ একটি খাবার তৈরি হয়ে যায়।
১২. হোল গ্রেইন বা শস্যজাত খাবার
ভাত, গম, যব, ওটস, কিনোয়া এগুলির সবই শস্যজাত খাবারের উদাহরণ। এই ধরনের খাবার ফাইবার, ভিটামিন, মিনারেল ও প্রোটিন সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। কয়েক রকমের শস্য একসাথে মিশিয়ে খেলে সেটা শাক-সবজির পরিপূরক হিসেবেও কাজ করতে পারে। তাই আমিষের উৎস হিসেবে শস্য খাওয়া ভালো একটি অপশন।
১৩. পিনাট বাটার
দুই টেবিল চামচ পিনাট বাটারে ৭ গ্রাম আমিষ থাকে। এছাড়া হার্টের জন্যও ভালো এমন অনেক উপাদান (যেমন মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ফাইবার) পিনাট বাটারে পাওয়া যায়। খেয়াল রাখবেন পিনাট বাটার যেন খুব বেশি খাওয়া না হয়। কারণ পিনাট বাটারে ক্যালরি বেশি থাকায় দ্রুত ওজন বেড়ে যেতে পারে।