• যখন কেউ তাদের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেয়, তখন আপনি কখনও কখনও সেটিকে আপনার নিজের অভিজ্ঞতা বানিয়ে নেন।
• অনেক মানুষ স্বীকার করেছে যে তারা অন্যের অভিজ্ঞতাকে ধার করে নিজের অভিজ্ঞতা হিসাবে দাবি করেছে।
• সুন্দর পোশাক পরার মত, হয়ত ধার করা একটি স্মৃতি আমাদের নিজেদের সম্পর্কে অনুভূতি বদলে দিতে পারে।
টিন-এইজে থাকতে আমি মাঝে মাঝে চার্চ লিডারদের কাছে আধ্যাত্মিক পরামর্শ চাইতে যেতাম। এতে অন্তত রবিবার বিকালের চার্চ স্পন্সরড মিটিংগুলি যে আমার চরিত্র গঠনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে, বাবা-মাকে সেটা নিশ্চিত করা হত। সেই মিটিংগুলি আমাদের উত্তম-স্বভাবের নবীন যাজক বিলের কারণে আনন্দদায়ক হয়ে উঠত। তিনি আমাদের সাথে মজা করতেন, বন্ধু হিসেবে আমাদের সাথে মিশতেন। আমরা বিলের সাথে বালকসুলভ নির্বোধ সব কাণ্ড করে ফেলতাম, তিনি অধিকাংশ সময়ই সেগুলি ভালভাবে নিতেন। তবে একবার আমাদের দুষ্টামি বিপজ্জনক দিকে মোড় নেয়, আর সেইদিনের ঘটনার সবথেকে মজার কিছু অংশ আমি মিস করে যাই। যার জন্য আমার দুঃখের শেষ ছিল না।
অ্যালান এস. ব্রাউন
সাইকোলজি টুডে, এপ্রিল ১০, ২০২৪
বিল ছিল ধূমপায়ী। তাকে ধূমপান ছাড়ানোর জন্য আমরা বন্ধুরা ভিন্ন ধরনের একটা পরিকল্পনা সাজালাম। তার সিগারেট চুরি করে আমরা এর অর্ধেক তামাক সরিয়ে নিলাম এবং খুব সাবধানে মাঝখানে একটা ম্যাচের কাঠি রাখলাম। তারপর ওপরের অংশটাতে পুনরায় তামাক ভরে পরিপাটিভাবে সিগারেট তার স্পোর্টস কোটের পকেটে রেখে দিলাম। আমার দুর্ভাগ্য, সেই দুপুরেই আমাকে জরুরি প্রয়োজনে বাড়ি ফিরে যেতে হয়েছিল। পরের দিন সকালে স্কুলে গিয়ে আমাদের শয়তানির হাস্যকর পরিণতির কথা জানতে পারলাম।
ওইদিন বড়রা যখন সুন্দর আবহাওয়া উপভোগ করতে বাইরে বের হয়েছিল, এক পর্যায়ে বিল সিগারেট ধরায়। দুই তিন টানের পর তার নাকের সামনেই সিগারেটের আগুন ঝলসে ওঠে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্মরণীয় একটি আতঙ্ক নাচ নাচতে বাধ্য হয়। আহত না হলেও বিল স্বাভাবিকভাবেই বেশ রেগে যায়। সে তৎক্ষণাৎ গ্রুপের সবাইকে কঠোর ভর্ৎসনা করে এবং জোর দিয়ে বলে অপরাধীদের সামনে আসতে। কেউ না আসাতে সে চাপা ক্রোধে বিরক্ত হয়ে ওঠে, ঘোষণা করে যে আমাদের গ্রুপের আত্মিক ভিত্তি গড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে।
ধার করা স্মৃতি নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা
এই গল্পের সকল বিবরণ আমি অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনি। এমন মজার অভিজ্ঞতা মিস করায় আমার খুবই আফসোস হয়। এই অনুচিত কিন্তু অমূল্য ঘটনাটির নির্বাহী পরিকল্পনা কমিটির সদস্য তো আমিই ছিলাম!
আফসোস লাঘব করার জন্য, আমি গল্পের “ফ্যাক্টে” (প্রকৃত ঘটনায়) সামান্য পরিবর্তন করি। আমিও এই অভিজ্ঞতার অংশ ছিলাম এমন ভান করতে থাকি। আসলে, গল্পটি এতই চমৎকার যে, এর অংশ না হওয়ার কোনো অর্থই হয় না। তাই অন্যের স্মৃতিটি ধার করে তার মধ্যে নিজেকে যুক্ত করে নিলাম।
এইভাবে সত্য বিকৃত করার কারণে একটা অপরাধবোধ আমার মধ্যে জেগে ওঠে। পরের কয়েক বছরে, আমি মাঝে মধ্যে চিন্তা করতাম, এটা কি অন্যেরাও করে—মানে এমন একটা অভিজ্ঞতার অংশ হওয়ার ভান করে, যা তারা অন্যের মুখ থেকে শুনেছে? আমার স্বস্তির জন্য, ডিউক ইউনিভার্সিটির কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট বেথ মার্শ কয়েক দশক পর এই সম্ভাবনাটি নিশ্চিত করেন। অবশেষে, আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম যে আমার নৈতিকতা সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিকতার বাইরে ছিল না।
স্মৃতি ধার করা সম্পর্কিত ডেটা পর্যালোচনা
এর ওপর অনেক কিছু আমি মার্শের এই বিষয়ে করা প্রাথমিক জরিপ থেকে জানতে পারি। তিনি আবিষ্কার করেন, কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন অন্যদের কাছ থেকে মজার গল্প শোনে, এর মধ্যে অনেক গল্পকেই তারা নিজের অভিজ্ঞতা হিসাবে অন্যদের কাছে বর্ণনা করে। ফালতু কোনো দুষ্টামির কাহিনি, বা বসন্তকালীন সাপ্তাহিক ছুটির দিনের কোনো উত্তেজনাপূর্ণ পার্টির ঘটনা, বাজে পরিস্থিতিতে শেষ হওয়া কোনো ডেট অথবা তারকাদের সাথে আকস্মিক দেখা হওয়ার মত অন্যের গল্পগুলিকে তারা নিজের গল্প হিসাবে রূপান্তর করে নেয়।
যখন শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তারা কখনও অন্য কারও অভিজ্ঞতার অংশ বা পুরোটা ধার করে নিজেদের অভিজ্ঞতা হিসাবে বলেছে কিনা, তখন অর্ধেকেরও বেশি (৫৭ শতাংশ) বলেছিল যে তারা তা করেছে। তারপর, মার্শ এবং আমি এই জরিপটি আরও বড় নমুনার ওপর সাউদার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটিতে (এসএমইউ) সম্প্রসারিত করি এবং একই ধরনের ফলাফল পাই। আবারও, বেশিরভাগ (৫৮ শতাংশ) মানুষ অন্যের গল্পের একটি অংশ বা পুরোটা ধার করে নিজেদের গল্প হিসাবে উপস্থাপন করেছে (ব্রাউন এট আল., ২০১৫)। তাছাড়া, এটা কোনো বিচ্ছিন্ন বা বিরল ঘটনা না। প্রায় সব স্মৃতি ধার করা ব্যক্তিরাই একাধিকবার এরকম করেছেন।
গল্প চুরির সত্যতা যাচাই করার জন্য আমরা আরেকটি পদ্ধতিরও আশ্রয় নেই। প্রশ্নটিকে একটু ঘুরিয়ে ভিন্নভাবে করা হয়েছিল। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তারা কখনও কোনো গল্প চুরির শিকার হয়েছে কিনা। অর্থাৎ, কখনও তারা তাদের অভিজ্ঞতাকে কেউ নিজের বলে দাবি করেছে কিনা। আশ্চর্যজনকভাবে, অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী দেখেছে যে তাদের কোনো বন্ধু বা সহপাঠিই ঠিক এমনটা করেছে। বলা অপ্রয়োজনীয় যে, এরকম ঘটনা বেশ কিছু অপ্রীতিকর সামাজিক পরিস্থিতিরও সৃষ্টি করে থাকে।
অন্যের স্মৃতি ধার করার কারণ
আপনি হয়ত মনে করতে পারেন মানুষ নিজেকে ‘কুল’ প্রমাণ করার জন্য অন্যের গল্প ধার করে, কিন্তু এমন ভাবলে ভুল হবে। আসলে অসাধারণ কোনো অভিজ্ঞতার অংশ হওয়া আকর্ষণীয় কিছু লাভ করার—যেমন দুর্লভ ও তুলনাহীন কোনো আসবাবপত্রের মালিকানা পাওয়া বা ট্যাটু করানোর—মত কোনো অনুভূতির সমান। সম্ভবত অন্যের থেকে নেওয়া এসব গল্পের, আমাদেরকে বদলে দেওয়ার শক্তি আছে, ঠিক যেমন কারো জিপলাইন (তারে ঝুলে স্লাইড করার একধরনের রাইড) অভিজ্ঞতা নিজের সম্পর্কে তার অনুভূতিকে বদলে দিতে পারে।
আরো পড়ুন: বর্তমান-এর ফিল্টার দিয়ে ভবিষ্যৎ অনুমানের সমস্যা
আরেকটি বিশেষ কারণে মানুষ অন্যের স্মৃতি ধার করে। কথোপকথন এবং সামাজিক যোগাযোগ আরও সহজ করার জন্য। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, যখন কোনো একটি বিষয়ে একটি দলগত আলোচনা জমে ওঠে, তখন যদি আপনি আলোচনায় এমন একটি গল্প বলেন যেটা অন্য কারো সাথে ঘটেছে, তাহলে আলোচনা কৃত্রিম হয়ে যেতে পারে। তবে আলোচনায় প্রাসঙ্গিক ওই অভিজ্ঞতাটিকে নিজের হিসাবে প্রকাশ করলে আলোচনা আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে।
স্মৃতি ধার করার এই ঘটনা শুধু কলেজ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এমন নয়। পরে আমরা একটি কমিউনিটির ওপর পরিচালিত জরিপের নমুনা পর্যালোচনা করি। এই কমিউনিটির মানুষের গড় বয়স ৪০। তাদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ স্বীকার করেছে, তারা মাঝে মাঝে অন্যের স্মৃতি ধার করেছে এবং নিজেদের জীবনের ঘটনা অন্য কাউকে চুরি করতে দেখেছে (ব্রাউন, ২০২০)। যদিও এক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা শিক্ষার্থীদের থেকে বেশ কম হারেই ঘটেছে, তারপরও এটা আমাদেরকে বেশ অবাকই করেছে।
স্মৃতি ধার করার সমস্যা
গবেষণার সুখবরটি হল, আপনি যদি অন্যের অভিজ্ঞতা ধার করে থাকেন, আপনি স্বাভাবিক মানুষ। আপনার মত আরও অনেকেই আছেন। তবে, এর খারাপ দিকও রয়েছে। আপনি যদি বার বার অন্যের গল্প নিজের বলে প্রচার করতে থাকেন, তাহলে একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করতে পারেন যে ঘটনাটি সত্যিই আপনার সাথে ঘটেছে।
আমাদের জরিপে অংশগ্রহণকারীদের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি লোক বলেছে, তাদের মাঝে মাঝে এমন অনুভূতি হয়েছে। তারা তখন নিশ্চিত ছিল না অভিজ্ঞতাটি আসলেই তাদের সাথে নাকি অন্য কারো সাথে ঘটেছিল।
এই অস্পষ্টতার জন্য বেশিরভাগ মানুষেরই অন্যদের সাথে ঝগড়াও বেঁধেছে। গবেষক শিন, কেম্প এবং রুবিন (২০০১) যমজ ভাই-বোনদের ওপরে গবেষণা করে একই ফলাফল পেয়েছেন। তাদের গবেষণায় অংশগ্রহণকারী অর্ধেকেরও বেশি যমজ ভাইবোনেরা জানিয়েছে যে তাদের এই ধরনের বিবাদপূর্ণ স্মৃতি আছে, যেখানে উভয়েই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে অভিজ্ঞতাটি তার সাথেই ঘটেছে, তাদের ভাই বা বোনের সাথে না।
স্মৃতি টানাটানির সমাধান
আপনি যদি নিজের বা অন্যের স্মৃতি নিয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন, আমি প্রস্তাব করব সেই অভিজ্ঞতাটি একসাথে শেয়ার করার মত সৃজনশীল উপায় খুঁজে বের করুন। ওই ঘটনার মালিকানা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব, সেটাই হয়ত আলাদা একটি মজার গল্প হিসাবে চালানো যায়।
খুব সম্ভবত, আপনিও ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে কোনো বিশেষ স্মৃতি নিয়ে ঝগড়া করেছেন, তাদের সাথেই আপনার অভিজ্ঞতা মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু মনে রাখুন, এই সম্পর্কগুলিই গুরুত্বপূর্ণ এবং টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন।
লেখার শেষপ্রান্তে একটি উপদেশ দিচ্ছি। আর যাই করেন সিগারেটের মধ্যে ম্যাচের কাঠি রাখার অপকর্মটি কখনও করার চেষ্টা করবেন না। যদিও আমার নিজের নয় এমন স্মৃতিগুলিও আমি নিজের বলে রেখে দিয়েছি, তবে বিলের সাথে আমার সম্পর্ক একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। এই ঘটনার কিছুদিন পরে বিল চার্চ ছেড়ে চলে যায়, এখন সে রিকন্ডিশন গাড়ি বিক্রি করে।
(অ্যালান এস. ব্রাউন, সাউদার্ন মেথডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি ‘দ্য দেজা ভু এক্সপেরিয়েন্স’ নামের একটি বইয়ের সহ-লেখক।)
অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ