বিভিন্ন কারণেই শীতকাল আমার ভালো লাগে না। প্রথম এবং প্রধান কারণ, শীতকালে আমি দুই তিনবার গোসল করতে পারি না। পানি গরম করা, সেইটা বাথরুমে টাইনা নেওয়া ইত্যাদি ঝামেলা দিনে একবারই যথেষ্ট। ঘরে শিশুরা থাকলে গরম পানি নাড়াচাড়া একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজই।
বাথরুমে গিজার লাগানোর কথা বহুদিন ভাবছি, কিন্তু লাগানো হইয়া ওঠে নাই। দ্বিতীয় কারণ, শীতকালে দিন খুব ছোট হয়, অফিস থাইকা ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যাই হইয়া যায়। বাসায় ফিরা খুব মন খারাপ লাগে। সারাটা দিন চইলাই গেলো—জীবন থাইকা আরেকটা দিন ফুরায়া গেল ধরনের অনুভূতি হয়।
ছোটবেলা শীতকাল ভালো লাগত না কারণ শীতকালে ফাইনাল পরীক্ষা হইত। ক্লাস ফাইভ আর এইটে ফাইনাল দিয়াও শান্তি হয় নাই, বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হইছে। আমি রেজাল্ট খারাপ করতাম না, মোটামুটি ভালোর দিকেই হইত রেজাল্ট, কিন্তু পরীক্ষা ব্যাপারটাই একটা বিরক্তিকর প্রক্রিয়া। এই সময়ে গল্পের বই পড়তে বা টিভি দেখতে দেখলে বড়রা বলত—তোমার না পরীক্ষা!
আমি টিভির পোকা ছিলাম ছোটবেলায়, তাই পরীক্ষার অজুহাতে কোনো কিছু দেখতে না দিলে আমার মেজাজ খারাপ হইয়া যাইত। শীতকালে পরীক্ষা শেষে বেড়াইতে যাইবার কালচার আমাদের বাসায় ছিল না। ছোটকালে ইশকুলের অনেক মেয়েদের কাছে শুনতাম, ওরা ফ্যামিলি সুদ্ধা কক্স’স বাজার বা সিলেট বেড়াইতে যায়। আমরা পরীক্ষা শেষ হইলে নানুর বাড়ি যাইতাম, সেইটাও একই শহরে। আমার নানা অনেক আগেই গ্রামের জমি জিরাত বেইচা শহরে বাড়ি বানানোতে গ্রামের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। আম্মাই গেছেন অনেক ছোটকালে, মুক্তিযুদ্ধের সময়। তারপরে আর যান নাই। যদিও জায়গাটা বেশি দূরে না, শেরপুরের নখলা উপজেলা। ব্রিজ হইয়া যাবার পর যাতায়াত খুব সহজ। তবু যাওয়া হইত না। আব্বার কোনো গ্রামের বাড়ি ছিলই না। দাদার বাড়ি ময়মনসিংহ শহরেই। দাদির বাড়িও পুরোহিতপাড়া, এখন আমরা যেখানে থাকি, তার পাশের এলাকা।
শীতকালে অনেক ফল আর সবজি পাওয়া যায় বইলা অনেকে শীত পছন্দ করেন, কিন্তু আমার সেইটাকে খুব আকর্ষণীয় কোনো কারণ বইলা মনে হয় নাই। শীতকালে কিছু ভাল সবজি অবশ্যই পাওয়া যায়, ব্রকোলি আর ক্যাপসিকাম আমার নিজেরও খুব প্রিয়, কিন্তু শীতের সমস্যাগুলিই অনেক বেশি। শীতকালে কেন জানি খুব বিষণ্ন লাগে আমার। বিশেষত সকালে বাইর হইবার সময় যদি কুয়াশা থাকে, আর কোনো কারণে যদি বৃষ্টি হয় তাইলে তো কথাই নাই।
ইউরোপের লোকেরা কেন বসন্তরে এত মর্যাদা দিয়া থাকে তা বোঝা যায় শীতের তীব্রতা বাড়লে। SAD (Seasonal Affective Disorder) নামে একধরনের মানসিক সমস্যা আছে, শীতপ্রধান দেশের অনেক মানুষ নাকি এই বিশেষ ধরনের ডিপ্রেশনে ভোগেন।
বাঘমারাতে একটা বাসায় আমরা এক বছর ছিলাম। তখন আমাদের ফ্রিজ ছিল না। সেইবারে শীতের কিছু উপকারিতা অনুভব করছিলাম—রান্না করা খাবার সহজে নষ্ট হইত না। শীত চইলা গেলে পরে আমাদের অনেক খাবার নষ্ট হইল, তারপরে আমরা ফ্রিজ কিনলাম। সেই বাঘমারার বাসায় থাকতেই আমার মনে হইছিল, আমাদের যে শীত নিয়া এত উচ্ছ্বাস, এইটা মূলত মধ্যবিত্তদের উচ্ছ্বাস। গরীব মানুষদের জন্য শীত কষ্টকর। অবশ্য বর্ষাও তাদের জন্য খুব সুবিধার সিজন না। কিন্তু বাঘমারা প্রাইমারি ইশকুলের পাশের মাঠে যে কয়েকটা বেড়ার ঘরে মানুষরা থাকত, তাদের নিশ্চয়ই আমাদের মতন লেপ-তোশক নাই, তাদের ঘরের বেড়া আর সিলিঙের মধ্যেও আধা হাত ফাঁকা। তারা তাইলে এই শীতে কেমনে টিক্যা আছে?
একদিন ওই ঘরগুলা দেইখা আর রাস্তার কলের পানিতে সাতসকালে লাইন ধইরা মানুষদেরে গোসল করতে দেইখা আমার গিজারের আফসোস চইলা গেছিল। আমার নানি সারাবছর সকালে ঠাণ্ডা পানি দিয়া গোসল করতেন। পৌষ-মাঘ মাসের শীতেও করতেন। যারা অইভাবে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে তাদের হয়ত অভ্যাস হইয়া যায়। জাহাঙ্গীরনগরে থাকতে আমারও অভ্যাস হইয়া গেছিল। দুপুরে গোসল কইরা রইদে চইলা গেলে আর টেনশন নাই। কিন্তু দুপুর কাইটা বিকাল হইয়া গেলেই আমার গোসল নিয়া টেনশন শুরু হইয়া যাইত।
কম বয়সে অনেক কিছুই করা যায়। আধাপেটা খাইলে বা না খাইলেও গায়ে লাগে না। অনেক জামাকাপড় না থাকলেও, মাত্র এক জোড়া স্যান্ডেল দিয়াও চালায়া দেওয়া যায়। ঠাণ্ডা পানিতে গোসল, মেঝেতে ঘুমানো— এসব কিছুতেই কষ্ট হয় না। কিন্তু বয়স বাড়তে বাড়তে প্রয়োজন অনেক বাড়ে। অনেক কিছুই আর আগের মতন পারা যায় না।
মানুষের যৌবন যে আসলে তার সবচাইতে বড় সম্পদ—শীত আসতে থাকলে আমি সেই কথা বেশি কইরা বুঝি। আগে আমার এত বেশি শীত লাগত না, ইদানিং যেমন লাগে। শীত আসতে থাকলে আমার মন আরো বেশি খারাপ হয় এখন—যদিও ফাইনাল পরীক্ষা নাই সামনে। শীত আসলে স্যাড হইয়া যাই আর মনে মনে নিজেকে বলি, If Winter comes, can Spring be far behind? শীত আসলে বোঝা যায় বসন্তও আসতেছে!
কভারে উম্মে ফারহানা; ছবি. পল জেমস গোমেজ, জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা ২০০৪