অর্থনীতিবিদ জে.কে. গ্যালব্রেইথ একবার লিখেছিলেন, “আমাদের সামনে যদি দুটি অপশন খোলা থাকে—কোনো বিষয়ে মত পরিবর্তন করা এবং সেই বিষয়ে মত পরিবর্তনের দরকার নেই তা প্রমাণ করা—তাহলে প্রায় সবাই দ্বিতীয় অপশনটির দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়।”
এ বিষয়ে লিয়েফ তলস্তয়ের মন্তব্য ছিল আরও স্পষ্ট: “আগে থেকে ধারণা না থাকলে, পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা লোকটাকেও সবচেয়ে জটিল বিষয়টা বোঝানো যায়। কিন্তু সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকটাকে সবচেয়ে সহজ বিষয়টাও অনেক সময় বোঝানো যায় না, যদি সে দৃঢ়ভাবে এটা বিশ্বাস করে যে সে এই বিষয়টি জানে ও বোঝে।”
জেমস ক্লিয়ার
এখানে আসলে কী হচ্ছে? কেন সত্য তথ্য সবসময় আমাদের মত বদলায় না? এবং কেন কেউ ভুল বা অসত্য ধারণায় বিশ্বাস করে যেতে থাকে? এই ধরনের আচরণ কি আদৌ আমাদের উপকার করে?
ভুল বিশ্বাসের যুক্তি
বেঁচে থাকার জন্য মানুষের এই পৃথিবী সম্পর্কে একটা মোটামুটি সঠিক ধারণা থাকা জরুরি। যদি কারও মনে থাকা বাস্তবতার মডেল প্রকৃত জগত থেকে অনেকটাই আলাদা হয়, তাহলে প্রতিদিন কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব কঠিন হয়ে যায়।
তবে, মানুষ সবসময় শুধু সত্য ও নির্ভুলতাকে প্রাধান্য দেয় এমন না। তাদের মধ্যে অন্যের সাথে মিলেমিশে চলার গভীর আকাঙ্ক্ষাও দেখা যায়।
আমি অ্যাটমিক হ্যাবিটস বইতে লিখেছিলাম, “মানুষ হল দলবদ্ধ প্রাণী। আমরা অন্যদের সাথে মিশতে চাই, তাদের সাথে বন্ধন তৈরি করতে চাই, এবং আমাদের সমবয়সীদের কাছ থেকে সম্মান ও স্বীকৃতি পেতে চাই। এই ধরনের প্রবণতা মানুষ হিসাবে আমাদের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বিবর্তনের বেশিরভাগ সময় জুড়ে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা দলবদ্ধ হয়ে বাস করতেন। দল থেকে আলাদা হয়ে পড়া কিংবা বহিষ্কৃত হওয়া মানে ছিল মৃত্যুদণ্ড।”
যেকোনো পরিস্থিতির সত্যতা বোঝা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি একটি সমাজের অংশ হয়ে থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় এই দুটি চাহিদা একসঙ্গে ভালভাবে কাজ করে, তবে কখনও কখনও এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
অনেক পরিস্থিতিতে, কোনো নির্দিষ্ট তথ্য বা ধারণার সত্যতা বোঝার চেয়ে সামাজিক সংযোগই দৈনন্দিন জীবনের জন্য বেশি উপকারী হয়ে ওঠে। হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী স্টিভেন পিঙ্কার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “আমরা একজন মানুষকে কাছে টেনে নেব নাকি দূরে সরিয়ে দেব তা অনেকাংশে তার বিশ্বাস কিংবা ধারণার ওপর নির্ভর করে। তাই আমাদের মস্তিষ্ক সেইসব বিশ্বাস বা ধারণাকে আঁকড়ে ধরে যা আমাদেরকে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী কিংবা শিষ্য এনে দেবে। সেই ধারণাটি সত্য কিনা সেটা আর আমাদের মস্তিষ্ক যাচাই করে না।”
শুধুমাত্র সঠিক বলে আমরা কোনো বিষয় বিশ্বাস করি এমনটা সবসময় হয় না। মাঝে মাঝে আমরা পছন্দের মানুষদের গ্রহণযোগ্যতা পেতে অনেক কিছু বিশ্বাস করি।
কেভিন সিমলার এর মতে, “আমাদের মস্তিষ্ক যখন বুঝতে পারে যে একটি নির্দিষ্ট ধারণা বিশ্বাস করলে সে পুরস্কৃত হবে, তাহলে সে আনন্দের সাথেই সেই ধারণা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে পুরস্কারের ধরন কেমন—বাস্তবিক (ভাল সিদ্ধান্ত থেকে আসা ভাল ফলাফল) নাকি সামাজিক (বন্ধু বা সহপাঠীদের ভাল আচরণ), নাকি দুটোর সংমিশ্রণ—সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয় না।
ভুল বিষয়ে বিশ্বাস করা তথ্যগত দিক থেকে তেমন উপকারী না হলেও সামাজিক দিক থেকে তা কখনও কখনও উপকারী হতে পারে। বিষয়টিকে আমরা এভাবে বলতে পারি “তথ্যগতভাবে ভুল, কিন্তু সামাজিকভাবে সঠিক।” যখন আমাদের এই দুইয়ের মধ্যে একটি বেছে নিতে হয়, তখন মানুষ প্রায়ই সত্যের চেয়ে বন্ধু ও পরিবারের বিশ্বাসের দিকেই ঝুঁকে পড়ে।
এ ধরনের ঘটনা থেকে এটা বোঝা যায় যে কেন আমরা পারিবারিক দাওয়াতে কোনো কথা বলি না কিংবা বাবা-মা আপত্তিকর কিছু বললে চোখ ফিরিয়ে নিই, পাশাপাশি অন্যদের মত পরিবর্তনের একটা ভাল উপায়ও দেখিয়ে দেয়।
ফ্যাক্ট নয়, বন্ধুত্ব আমাদের মত বদলায়
কেউ যখন পরিবার বা সমাজ স্বীকৃত কোনো বিশ্বাস ত্যাগ করে, তখন সে পরিবার বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। পরিবার বা সমাজের সাথে সম্পর্ক হারানোর ঝুঁকি নিয়ে কেউ বিশ্বাস ত্যাগ করতে চায় না। তাই, কারো দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশ্বাস বদলাতে চাইলে তাকে কোথাও যাওয়ার মত জায়গা দিতে হবে। কেউই নিজের চেনা পৃথিবীকে পেছনে ফেলে নিঃসঙ্গতার সাগরে পা দিতে চায় না।
মানুষের মন পরিবর্তনের উপায় হল—তাদের বন্ধু হয়ে ওঠা, তাদের আপনার দলে টেনে আনা, আপনার পরিবেশে তাদের জায়গা করে দেওয়া। তখন তারা সামাজিকভাবে একঘরে হওয়ার আশঙ্কা ছাড়াই নিজেদের বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারে।
যাদের সাথে আমাদের মতের পার্থক্য আছে, তাদের সাথে একবেলা একসাথে খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন ব্রিটিশ দার্শনিক অ্যালাঁ দ্য বোতঁ (Alain de Botton)।
“একদল অপরিচিত মানুষের সাথে যখন আপনি এক টেবিলে খেতে বসবেন, তখন অকারণে তাদের ঘৃণা করা কঠিন হবে। কুসংস্কার ও জাতিগত সংঘাত গড়ে ওঠে অস্পষ্ট ও ভ্রান্ত ধারণার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু একসাথে খাওয়ার সময় যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়—যেমন খাবারের প্লেট একে অপরের দিকে এগিয়ে দেওয়া, কিংবা অপরিচিত কাউকে লবণ এগিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করার মত কাজগুলি আমাদের মধ্যে সহনশীলতা বাড়ায়। অন্যরকম পোশাক পরা কিংবা ভিন্ন উচ্চারণে কথা বললেই কাউকে ঘৃণা করতে হবে, বা তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে হবে—এমন ভুল ধারণা দূর করে। জাতিগত সংঘাত নিরসনে যত বড় রাজনৈতিক সমাধানই প্রস্তাব করা হোক না কেন, সন্দেহপ্রবণ প্রতিবেশি দেশগুলির নেতাদের একসাথে খাবার খেতে বসার মত কার্যকর কৌশল খুব কমই আছে।”
পার্থক্য নয়, বরং দূরত্বই গোষ্ঠীবাদ ও শত্রুতার জন্ম দেয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়লে বোঝাপড়াও বাড়ে। এই কথাগুলো শুনে আব্রাহাম লিংকনের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়: “আমি ওই মানুষটাকে অপছন্দ করি। আমি তাকে আরও ভাল করে চিনে নিতে চাই।”
তথ্য নয়, বন্ধুত্ব আমাদের মত বদলায়।
বিশ্বাসের পরিসর
বছর কয়েক আগে বেন কাসনোকার বলা একটা কথা আমি এখনও ভুলতে পারিনি: যারা আমাদের সঙ্গে ৯৮ শতাংশ বিষয়ে একমত, তারাই আমাদের মত বদলানোর সবচেয়ে সম্ভাব্য উৎস।
যদি আমাদের পরিচিত, পছন্দের ও বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যক্তি চরমপন্থী ধারণা পোষণ করে, তাহলে আমরা সেটিকে বেশি গুরুত্ব, ওজন বা বিবেচনা দিয়ে দেখতে পারি। কারণ, জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ইতোমধ্যেই তার সঙ্গে একমত। তখন আমাদের মনে হয়, তাহলে হয়ত এই একটি বিষয়েও আমার মত বদলানো উচিত। কিন্তু কেউ যদি সবদিক থেকে আমাদের চেয়ে আলাদা হয় এবং একই ধরনের চরমপন্থী ধারণার অনুসারী হয়, তাহলে তাকে পাগল বলে উড়িয়ে দেওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।
এই পার্থক্যটাকে চোখে দেখার একটি উপায় হল, বিশ্বাসগুলোকে একটি পরিসরের (spectrum) ওপর ম্যাপ করা। যদি আপনি এই পরিসরকে ১০টি ধাপে ভাগ করেন এবং দেখেন আপনি ৭ম স্তরে অবস্থান করছেন, তাহলে প্রথম স্তরে থাকা কাউকে বোঝানোর খুব একটা মানে হয় না। ব্যবধানটা খুব বড়। আপনি যদি ৭-এ থাকেন, তাহলে আপনার সময় বরং স্তর ৬ এবং ৮-এর মানুষদের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতে ব্যবহার করাই ভাল। তাদের সাথে সময় কাটিয়ে ধীরে ধীরে তাদের আপনার দিকে টেনে আনুন।
সবচেয়ে তীব্র তর্ক হয় প্রায়ই পরিসরের দুই প্রান্তে থাকা মানুষদের মধ্যে, কিন্তু সবচেয়ে ঘন ঘন শেখা হয় কাছের মানুষদের থেকে। আপনি কারও যত কাছাকাছি থাকবেন, তার ধারণা ও বিশ্বাসের বেশিরভাগই আপনার মধ্যে চলে আসবে। তার যেসব ধারণা কিংবা বিশ্বাস এখনও আপনার মধ্যে আসেনি, সেগুলিও ধীরে ধীরে আপনার চিন্তাভাবনায় ঢুকে পড়বে। কোনো ধারণা যখন আপনার নাগালের অনেক বাইরে থাকবে, সেই ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করার সম্ভাবনাও বেশি হবে।
মানুষের মত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে লাফ দেওয়া খুবই কঠিন। লাফিয়ে এই পুরো পরিসরটা আপনি পাড়ি দিতে পারবেন না। আপনাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে।
যেসব ধারণা আপনার বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেক আলাদা, তা আপনার কাছে হুমকিস্বরূপ মনে হবে। আর কোনো হুমকিস্বরূপ ধারণা নিয়ে চিন্তা করার সবচেয়ে ভাল জায়গা হল একধরনের নিরাপদ পরিবেশ। এই কারণেই প্রায় সময় বিশ্বাস বদলানোর জন্য কথোপকথন বা বিতর্কের তুলনায় বই বেশি কার্যকর মাধ্যম হয়ে ওঠে।
কথোপকথনে মানুষকে তার অবস্থান ও মর্যাদা ভেবে চলতে হয়। তারা নিজের সম্মান বজায় রাখতে চায় এবং অন্য কারও সামনে বোকা হতে চায় না। যখন কোনো অস্বস্তিকর তথ্যের মুখোমুখি হয়, তখন তারা সাধারণত তাদের বর্তমান অবস্থানে আরও দৃঢ় হয়ে পড়ে, এবং খোলাখুলিভাবে নিজের ভুল স্বীকার করতে চায় না।
বই এই টানাপড়েনের সমাধান করে। বইয়ের মাধ্যমে একজনের মনের ভেতরে কথোপকথনটা ঘটে, আর তাতে অন্যরা তাকে জাজ করছে কিনা সেই ভয় থাকে না। যখন অন্যের সমালোচনার ভয় থাকে না, তখন মন খুলে চিন্তা করা অনেক সহজ হয়।
যুক্তি বা তর্ক অনেকটা কারো ব্যক্তিসত্তার ওপর সরাসরি আক্রমণের মত। কিন্তু বই পড়ার বিষয়টা অনেকটা কারো মস্তিষ্কে চুপি চুপি একটি ধারণার বীজ রোপণ করার মত—যেটা সে নিজের গতিতে, নিজের নিয়মে বড় হতে দেয়। কেউ যখন আগে থেকে গেঁথে থাকা কোনো বিশ্বাস কাটিয়ে উঠতে থাকে, তখন তার মাথার ভেতরেই যথেষ্ট লড়াই চলতে থাকে। তার সঙ্গে আপনাকেও লড়াই করতে হবে এমনটা না ভাবাই ভাল।
কেন ভুল ধারণা টিকে থাকে
ভুল বা খারাপ ধারণাগুলি টিকে থাকার একটি কারণ হল মানুষ এগুলি নিয়ে কথা বলতেই থাকে।
নীরবতা হল কোনো ধারণার জন্য মৃত্যুর সমান। কোনো ধারণা যদি কখনও উচ্চারিত না হয় বা লিখে না রাখা হয়, তাহলে যে মানুষটা সেটা ভেবেছিলেন, তার মৃত্যুর সঙ্গেই মারা যায়। একটি ধারণা যখন বার বার বলা হয়, কেবল তখনই তা মনে রাখা যায়। সেই ধারণাটি কেবল তখনই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, যখন তা বার বার বলা হয়।
আমি আগেই বলেছি, মানুষ ধারণাগুলি বার বার বলে যেতে থাকে, যাতে বোঝাতে পারে তারা একই সামাজিক গোষ্ঠী বা দলের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এখানে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা বেশিরভাগ মানুষই বোঝে না:
মানুষ খারাপ ধারণাগুলি নিয়ে যখন অভিযোগ করে, তখনও সেটি বার বার বলা হয়। আপনি কোনো ধারণা সমালোচনা করার আগে, সেই ধারণাটির কথা বিস্তারিত উল্লেখ করতে হয়। আপনি এমন সব ধারণা বার বার বলতে বাধ্য হন, যেগুলি আপনি চাইছেন মানুষ ভুলে যাক—কিন্তু মানুষ তো ভুলতেই পারে না, কারণ আপনি সেগুলি নিয়ে কথা বলেই চলেছেন। আপনি একটি খারাপ ধারণা যত বেশি বার পুনরাবৃত্তি করবেন, সেটি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার আশঙ্কাও ততই বাড়বে।
এই ঘটনাটিকে আমরা ক্লিয়ারের ‘পুনরাবৃত্তির নীতি’ বলতে পারি। একটি নির্দিষ্ট ধারণাকে—সেটা সত্যি হোক বা মিথ্যা—গত এক বছরে যতবার পুনরাবৃত্তি করা হয়, তার সাথে সমানুপাতিক হারে সেই ধারণায় বিশ্বাস করা মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
কোনো খারাপ ধারণাকে হয়ত আপনি বার বার আক্রমণ করছেন, ধ্বংস করতে চাইছেন, কিন্তু মাঝে মাঝে আপনার এই আক্রমণই সেই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। টুইটারের এক কর্মী লিখেছেন, “কারো কথায় আপনার রাগ হল। আপনি রিটুইট বা কোট টুইট করে নিজের রাগ প্রকাশ করলেন। এতে কিন্তু আপনি তাদের সাহায্য করছেন, তাদের বাজে কথা আরও ছড়িয়ে দিচ্ছেন। যেসব ধারণাকে আপনি ঘৃণা করেন, তাদের জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি হল নীরবতা। তাদের সেই শাস্তি দিতে হলে আত্মনিয়ন্ত্রণ দরকার।”
ভাল ধারণাগুলিকে আরও ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে সময় ব্যয় করাই বেশি ফলপ্রসূ, খারাপ ধারণাগুলি ভেঙে ফেলার পেছনে নয়। খারাপ ধারণা কেন খারাপ—তা ব্যাখ্যা করে সময় নষ্ট করবেন না। এতে আপনি কেবল অজ্ঞানতা ও বোকামির আগুনেই ঘি ঢালছেন।
একটি খারাপ ধারণার সবচেয়ে ভাল পরিণতি হল সেটি যেন ভুলে যাওয়া হয়। একটি ভাল ধারণার সবচেয়ে ভাল পরিণতি হল সেটিকে ছড়িয়ে দেওয়া। এটা আমাকে টাইলার কাউইনের সেই উক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়, “অন্যরা কেন ভুল, তা নিয়ে যতটা সম্ভব কম সময় ব্যয় করুন।”
ভাল ধারণাগুলিকে খাওয়ান, আর খারাপ ধারণাগুলিকে না খাইয়ে মেরে ফেলুন।
ইনটেলেকচুয়াল সোলজার
আপনি হয়ত ভাবছেন, “জেমস, তুমি কি সত্যিই সিরিয়াস? আমি কি এই বোকাদের সত্যিই এভাবে ছেড়ে দেব?”
আমি পরিষ্কার করে বলি—আমি এটা বলছি না যে ভুল ধরিয়ে দেওয়া বা খারাপ কোনো ধারণার সমালোচনা কখনোই কাজে লাগে না। কিন্তু আপনাকেই নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে, “লক্ষ্যটা আসলে কী?”
আপনি কেন খারাপ ধারণাগুলির সমালোচনা করতে চান? হয়ত আপনি ভাবছেন, এইসব ভুল ধারণা কম মানুষ বিশ্বাস করলে পৃথিবীটা আরও ভাল হত। অর্থাৎ, আপনি মনে করেন, কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদি মানুষের মত বদলাত, তাহলে পৃথিবী আরও সুন্দর হত।
যদি সত্যিই মানুষের মন বদলানো আপনার লক্ষ্য হয়, তাহলে আমি মনে করি না যে শুধু সমালোচনা করাটাই সবচেয়ে ভাল কৌশল।
বেশিরভাগ মানুষ তর্ক করে জেতার জন্য, শেখার জন্য না। যেমন জুলিয়া গ্যালেফ দারুণভাবে বলেছেন: মানুষ অনেক সময় সৈনিকের মত আচরণ করে, স্কাউটদের মত নয়। সৈনিকরা থাকে বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের মোডে—যারা তাদের থেকে আলাদা, তাদের পরাজিত করতে চায়। জয়ই তাদের মূল চালিকা শক্তি। আর স্কাউটরা মানসিক অভিযাত্রী—তারা ধীরে ধীরে অন্যদের সঙ্গে মিলে একটি মানসিক মানচিত্র আঁকে। তাদের চালিকাশক্তি হল কৌতূহল।
আপনি যদি চান মানুষ আপনার বিশ্বাস গ্রহণ করুক, তাহলে আপনাকে সৈনিক না, বরং স্কাউটের মত আচরণ করতে হবে। এই পদ্ধতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে টিয়াগো ফোর্তের করা একটি অসাধারণ প্রশ্ন: “কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আপনি কি হারতেও প্রস্তুত?”
প্রথমে সদয় হোন, পরে সঠিক হবেন
জাপানের জনপ্রিয় লেখক হরুকি মুরাকামি একবার লিখেছিলেন, “মনে রেখো—তর্ক করে জেতা মানে হল যার সঙ্গে তুমি তর্ক করছো, তার বাস্তবতাকে ভেঙে ফেলা। নিজের বাস্তবতাকে হারানো কষ্টকর, তাই তুমি যদি ঠিকও হও, তবুও সদয় থেকো।”
আমরা যখন কোনো বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি, তখন সহজেই ভুলে যাই যে আমাদের আসল লক্ষ্য হচ্ছে—অন্য পক্ষের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা, সহযোগিতা করা, বন্ধুত্ব গড়ে তোলা, এবং তাকে আমাদের দলের অংশ করে নেওয়া। তর্কে জয়ের নেশায় আমরা সংযোগের কথা ভুলে যাই। মানুষকে সহযোগী ভাবার বদলে তাদের শত্রু ভাবতে শুরু করি।
“Kind” শব্দটির উৎপত্তি “kin” শব্দ থেকে। আপনি যখন কারো সাথে সদয়ভাবে আচরণ করেন, তখন আপনি তাকে পরিবারের একজন সদস্যের (kin) মতই দেখছেন। আমার মনে হয়, কারও মত বদলানোর জন্য এটা একটা দারুণ পদ্ধতি—বন্ধুত্ব গড়ে তুলুন। একসাথে খাবার খান। বই উপহার দিন।
প্রথমে সদয় হোন, নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার তাড়া পরে নিন।
অনুবাদ: সাম্প্রতিক ডেস্ক

