গবেষকরা শহরের বাস এবং পাতাল রেলগুলিতে এমন কিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ পেয়েছেন যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

আমরা আসলে এক মহা জীবাণুসমুদ্রে বাস করি। তবে তা আমাদের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা ভাল ব্যাপার। আপনি হয়ত মানব অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্র সম্পর্কে শুনেছেন। আমাদের পরিপাক নালীতে বাস করে অসংখ্য অণুজীব। যারা আমাদের মস্তিষ্ক সহ স্বাস্থ্যকেও এক রহস্যজনক উপায়ে প্রভাবিত করতে পারে।

শহরগুলিতেও নিজস্ব জীবাণুতন্ত্র রয়েছে। এবং সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতিটি শহরেরই রয়েছে স্বতন্ত্র জীবাণুতন্ত্র। একেক শহরের জীবাণুতন্ত্রের গঠনবিন্যাস একেক রকম।

এই গবেষণার ফলাফল গত ২৬শে মে জার্নাল সেল (Cell) -এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় ৬টি মহাদেশের ৬০টি শহরের জীবাণুতন্ত্রের স্বরূপ উঠে এসেছে। শহরগুলিতে বাস করা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং প্রাচীন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া (archaea) সম্পর্কে ধারণা পেতে সাবওয়ে এবং বাস ও গণ পরিবহন সিস্টেম থেকে নেওয়া ৮,৭০০টির বেশি নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।


এলি শেশে
পপুলার সায়েন্স, ২ জুন ২০২১


নিউ ইয়র্কের ওয়েইল কর্নেল মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক এবং এই গবেষণার প্রধান গবেষক ক্রিস ম্যাসন বলেন, “আমরা আগে যা জানতাম তা হল, নিশ্চিতভাবেই প্রতিটি ঘুর্ণায়মান দরজা এবং বেঞ্চে হাজার হাজার প্রজাতির জীবাণু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তবে এই জীবাণুতন্ত্র শহরভেদে কতটা আলাদা এবং বৈচিত্র্যময় হতে পারে তা আমরা বুঝতে পারিনি।”

শহরগুলির টিকিট বুথ, রেলিং, সিট, ঘুর্ণায়মান দরজা, এবং গণ ট্রানজিট ব্যবস্থার অন্যান্য যেসব জায়গায় সবচেয়ে বেশি লোকের ছোঁয়া লাগে সেসব জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল ৩ বছর ধরে বোগোটা, নিউ ইয়র্ক সিটি এবং টোকিও সহ বিশ্বের ৬০টি শহরে এই নমুনা সংগ্রহের কাজ করেন। গবেষকরা একটি শহরের প্রতিটি জায়গায় মূল ৩১টি প্রজাতির জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছেন। এর মধ্যে মানুষের ত্বকে বসবাসকারী কিউটিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনে নামের একটি কমন ব্যাকটিরিয়ার প্রজাতিও রয়েছে। তবে তারা এটাও দেখতে পান যে, ভিন্ন ভিন্ন শহরের জীবাণুতন্ত্রের গঠনবিন্যাসও ভিন্ন ভিন্ন। প্রতিটি শহরেই স্বতন্ত্র জীবাণুতন্ত্র রয়েছে।

মেসন বলেন, এই ভিন্নতার একটি কারণ হতে পারে শহরগুলির তাপমাত্রা, আর্দ্রতার মাত্রা এবং পরিবেশের ভিন্নতা। শহর জুড়ে এমন জিনও খুঁজে পেয়েছেন গবেষরা যা সম্ভাব্য জীবাণুতন্ত্র প্রতিরোধী। এটি বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য উদ্বেগও বটে। গবেষকদের মতে, এ থেকে স্থানীয় লোকেরা কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক খায় তারও একটা হদিস পাওয়া যেতে পারে। ম্যাসন বলেন, সুসংবাদটি হল মাটি বা মানুষের অন্ত্রের নমুনাগুলির তুলনায়, শহরের পরিবেশে জীবাণু প্রতিরোধী জিন কম রয়েছে। এছাড়া গবেষকরা এমন কিছু ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ খুঁজে পেয়েছেন যেগুলি আগে কখনো শ্রেণিবদ্ধ করা হয়নি।

ম্যাসন বলেন, “যতবারই আপনি কোথাও বসেন, ততবারই আপনি সম্ভবত এমন কোনো প্রজাতির ওপরে বসেন যা এখনও আবিষ্কার করা হয়নি।”

রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক মারিয়া গ্লোরিয়া ডোমিংয়েজ-বেলো পপুলার সায়েন্সকে পাঠানো ইমেইলে লিখেছেন, “এই গবেষণায়ই প্রথমবারের মতো বিশ্বজুড়ে নির্মিত পরিবেশে থাকা জিনগুলির ব্যাপক সমীক্ষা উপস্থাপন করা হয়েছে।“ তিনি আরো লেখেন যে, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা, কারণ এটি আমাদের বর্তমান পরিবেশ সম্পর্কে নতুন তথ্য তুলে এনেছে। এই পরিবেশ আমাদের পূর্বপুরুষরা যেই পরিবেশে বিবর্তিত হয়েছেন তার থেকে একদমই আলাদা।

নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির সিভিল এবং এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহকারি অধ্যাপক এরিকা হার্টম্যান লিখেছেন, “ঐতিহাসিকভাবে, যখন আমরা জীবাণু, পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেছি, আমরা মূলত রোগজীবাণুগুলির প্রতি মনোনিবেশ করেছি এবং যতটা সম্ভব সারফেসগুলি জীবাণুমুক্ত করার চেষ্টা করেছি।” বিশ্বব্যাপী চলমান কোভিড-১৯ মহামারীতে এই জীবাণুমুক্ত করার কাজটি অনেক বেশি বেশি করা হয়েছে।

তিনি লিখেছেন, “এখন এক কদম পিছনে গিয়ে এবং কেবল রোগজীবাণুগুলি না দেখে সমস্ত জীবাণুগুলিকে বিবেচনায় নিয়ে এবং আসলে কী আছে তা দেখার মধ্য দিয়ে আমরা একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছি। এই দৃষ্টিভঙ্গী আমাদেরকে আমাদের সহবাসী জীবাণুদের ব্যবস্থাপনায় আরও ভাল এবং উপকারী পদ্ধতি অবলম্বনের দিকে নিয়ে যাবে। নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে আমরা এখন সাধারণত আমাদের চারপাশে কোন কোন জীবাণু উপস্থিত রয়েছে এবং কখন কোন জীবাণুটাকে মারার জন্য কোন জীবাণুনাশকটা দরকার তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারব। এতে গণহারে অন্যান্য জীবাণু বা উপকারী জীবাণুগুলিও আর মারা পড়বে না।”

হার্টম্যান আরও বলেন, “আমাদের চারপাশে অসংখ্য জীবাণু রয়েছে এবং তাদের মধ্যে কেবল কিছু সংখ্যক জীবাণু আপনাকে অসুস্থ করতে পারে, তবে বেশিরভাগই ক্ষতিকারক নয় বা এমনকি উপকারীও হতে পারে। জীবাণুদের বিরুদ্ধে নয় বরং তাদের সাথে সংবেদনশীলতার সাথে কাজ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে আমরা নিজেদের জন্য আরও খারাপ কোনো সমস্যা তৈরি না করি। যেমন অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠা সুপারবাগ।”

ম্যাসন বলেন, “শহরে বাস করা অর্ধেকেরও বেশি মানুষকে অন্তর্ভুক্তকারী গণ ট্রানজিট সিস্টেমের মতো নগর পরিষেবাগুলি সম্ভবত আমাদের সকলের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশীদারিভিত্তিক স্পর্শকাতর ইকোসিস্টেম। এবং এই ইকোসিস্টেমটিতে কী বাস করে তা বুঝতে পারলে আমরা কীভাবে আরো স্থিতিস্থাপক, বৈচিত্র্যময় এবং আরও বেশি রোগজীবাণু-প্রতিরোধী নগর জীবাণুতন্ত্র সংরক্ষণ করা যায় তা সহজেই এবং সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারবো।”

অনুবাদ: মাহবুবুল আলম তারেক