প্যালেস্টাইন থেকে ‘স্লিংশট র্যাট’ অপসারণ করার পর বিতর্ক তৈরি হয়েছে যে অধিকৃত জায়গা থেকে মূল্যবান শিল্প সামগ্রী নিয়ে যাওয়া কি বৈধ?
পশ্চিম তীরের বিভাজন প্রাচীরে ব্যাঙ্কসির আঁকা একটা ইসরাইলবিরোধী স্প্রে প্রিন্ট শিল্পকর্ম হারিয়ে যাওয়ার কিছু দিন পর তেল আবিবের একটি গ্যালারিতে আবার তা দেখা গেছে। আর এতে তৈরি হয়েছে পাবলিক আর্ট নিয়ে নতুন বিতর্ক। একটা অধিকৃত জায়গা থেকে এভাবে মূল্যবান সাংস্কৃতিক সামগ্রী সরিয়ে নিয়ে আসা আসলে কতটুকু বৈধ?
২০০৭ সালে বেথলেহেমে বিভাজন প্রাচীরের কাছে ইসরাইল আর্মির একটি পরিত্যক্ত জায়গায়, কংক্রিটের ব্লকের উপর স্টেনসিল পেইন্টিং ‘স্লিংশট র্যাট’ শিল্পকর্মটি দেখা যায়। এটা ছিল প্যালেস্টাইন শহরে সেই সময়ে তৈরি করা গোপন কয়েকটা শিল্পকর্মের একটা। তবে কিছু দিন পর কোন এক অজানা ব্যক্তি পেইন্টিংটি সরিয়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে গ্রাফিতি করে লিখে রাখে, “RIP Bansky Rat”।
বেথ্যান ম্যাক-কারনান
দা গার্ডিয়ান, ১২ আগস্ট ২০২২
ব্যাঙ্কসি উদ্ভট ও ডিস্টোপিয়ান স্ট্রিট আর্টের জন্য বিখ্যাত। তিনি ২০০৫ সাল থেকে পশ্চিম তীর এবং গাজা স্ট্রিপে কাজ করে যাচ্ছেন। ফিলিস্তিনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তিনি তার অনেক কাজ নিলামেও তুলেছেন।

বেথলেহেম শহরের প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল ব্যাঙ্কসির কিছু শিল্পকর্ম। এর মধ্যে অন্যতম ‘ওয়ালড অফ হোটেল’ বা দেয়ালে ঘেরা হোটেল। ব্যাঙ্কসির ডিজাইন করা এই হোটেলকে বলা হয় “পৃথিবীর সবথেকে বাজে দৃশ্য দেখার হোটেল”। কারণ এই হোটেলের জানালা দিয়ে পশ্চিম তীরের দেয়াল ছাড়া কিছু দেখা যায় না। এই হোটেলটি চালু করা হয় ২০১৭ সালে। অনেক সমালোচকের মতে ব্রিস্টলে জন্ম নেয়া এই শিল্পী ইসরাইল-প্যালেস্টাইন সংকট নিয়ে তাচ্ছিল্য করছেন।
ব্যাঙ্কসির ‘স্লিংশট র্যাট’ শিল্পকর্মটি কিনেছেন ইসরাইলের আর্ট ডিলার কোবি আবেরগাল। তিনি দাবি করেন, শিল্পকর্মটি এই বছরের শুরুতেও প্যালেস্টাইনের লোকেরা নিজেদের ঘরেই রেখে দিয়েছিল।
শিল্পকর্মটি এখন যেখানে প্রদর্শিত হচ্ছে সেই আরবান গ্যালারির একজন পার্টনার বলেন, আবেরগাল তাকে জানিয়েছেন শিল্পকর্মটি তিনি বেথলেহেমে ব্যাঙ্কসির একজন সহযোগীর কাছ থেকে কিনেছেন এবং এটি বিক্রি করার তার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। ছবিটি কিনতে কত টাকা লেগেছিল বা ছবির বিক্রেতা কে ছিলেন এসব তথ্য জানাতে যদিও তিনি অস্বীকৃতি জানান, তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন পুরো লেনদেন বৈধ ও স্বচ্ছ উপায়ে হয়েছে।
আর্ট ডিলার জানান, আসল শিল্পকর্মের উপরে যে স্প্রে করা অ্যাক্রিলিক পেইন্ট তা খুব যত্ন করে তোলা হয় এবং ৪০০ কেজি (৯০০ পাউন্ড) এর কংক্রিটের স্ল্যাবটিকে একটা স্টিলের ফ্রেমের ভেতর আটকে ফেলা হয় যাতে পুরো জিনিসটা সহজে ট্রাকে তোলা যায় এবং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া যায়।
শিল্পকর্মটি নিয়ে যাওয়ার সময় তেল আবিবে অন্তত একটি হলেও মিলিটারি চেকপয়েন্ট পার হতে হয়। ইসরাইলি মিলিটারি এবং কোগ্যাট অর্থাৎ পশ্চিম তীরের বেসামরিক নিরাপত্তা ও প্রশাসনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ইসরাইলি ডিফেন্স মিনিস্ট্রি কর্তৃপক্ষ উভয় পক্ষই জানিয়েছে তারা এ বিষয়ে কিছুই জানত না।

১৯৫৪ সালে হেগ কনভেনশন গভর্নিং কালচারাল প্রোপার্টিতে বলা আছে যে, দখলকারী শক্তি অবশ্যই তার দখলকৃত জায়গা থেকে সাংস্কৃতিক সম্পদ সরিয়ে নেওয়া থেকে বিরত থাকবে। এ চুক্তিতে ইসরাইলও স্বাক্ষর করেছিল।
প্যালেস্টাইনের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জেরিস কামসি বলেন, “এটা হচ্ছে ফিলিস্তিনের জনগণের সম্পত্তি চুরি করা।” তিনি আরও বলেন, “এগুলি ছিল বেথলেহেমের জন্য, ফিলিস্তিনের জন্য, এখানে আসা দর্শনার্থীদের জন্য, একজন আন্তর্জাতিক শিল্পীর আঁকা ছবি। তাই এটিকে সরিয়ে নেয়া, বদলে ফেলা এবং চুরি করা অবশ্যই অবৈধ কাজ।”
২০ বছর আগে ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিকে পশ্চিম তীর এবং গাজা এলাকায় ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনিদের গণজাগরণ শুরু হয়। এই আন্দোলন দ্বিতীয় ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। এসময়েই ইসরাইল পশ্চিম তীরের এই বিতর্কিত বিভাজন প্রাচীরের কাজ শুরু করে।

ইসরাইলের অজুহাত ছিল প্যালেস্টাইনের সন্ত্রাসী আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে এই প্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রভাব, আইনি লড়াই এবং আন্তর্জাতিক চাপে এর নির্মাণ কাজ এক সময় বন্ধ করতে হয়। এই প্রাচীরটি ইসরাইলের অভ্যন্তরে বা যুদ্ধবিরতি সীমানার মধ্যে নির্মাণ করা হয়নি, বরং এর ৬৫ শতাংশ পড়েছে ফিলিস্তিনের সীমানার ভেতরে।
কিছু ইসরাইলি অবৈধ স্থাপনা রক্ষা করতে গিয়ে প্রাচীরটি প্যালেস্টাইনের ভেতর প্রায় ২২ কিলোমিটার (১৩ মাইল) ভিতর পর্যন্ত চলে গেছে। এই প্রাচীরের কারণে অনেক কমিউনিটি ভাগ হয়ে গেছে। এমন কি অনেক কৃষককে ইসরাইলের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হচ্ছে নিজের জমিতে চাষ করতে যাওয়ার জন্য।

বেথলেহেমের মতো অধিক ঘনবসতির জায়গায়, ৮ মিটার উঁচু কংক্রিট দেয়ালের উপর কাঁটাতার দিয়ে বিভাজন তৈরি করা হয়। তবে গ্রাম এলাকাতে বিভাজনের জন্য কেবল দুইটি সমান্তরাল কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়।
এর আগে পশ্চিম তীর থেকে দুইবার ব্যাঙ্কসির শিল্পকর্ম সরানো হয়েছিল: ওয়েট ডগ এবং স্টপ অ্যান্ড সার্চ নামের এই দুইটি শিল্পকর্মই বেথলেহেমে আঁকা হয়েছিল। পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি গ্যালারি শিল্পকর্ম দুটি কিনে নেয় এবং ২০১১ সালে তা প্রদর্শন করে।
ব্যাঙ্কসির স্লিংশট র্যাট যে ফিরে এলো, সে বিষয়ে মতামত জানতে চেয়ে তার মুখপাত্রকে অনুরোধ করা হইয়েছিল। তিনি এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাননি।
ব্যাঙ্কসির আসল নাম এখনো অজানা এবং তার সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায় না।
অনুবাদ: আমিন আল রাজী