একটা নতুন সৃষ্টি মানে এই না যে আগের যত আইডিয়া আছে, আগের যত অগ্রগতি আছে সব জলাঞ্জলি দিয়ে আনকোরা নতুন কিছু তৈরি করতে হবে।

২০১০ সালে থমাস থোয়াইটস নামের এক ভদ্রলোক সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি নিজে নিজে একটা টোস্টার মেশিন বানাবেন, একেবারে হাতেকলমে।
 
তিনি একটা দোকানে যান, সেখান থেকে সবচেয়ে সস্তা টোস্টার মেশিনটি কিনে বাড়িতে নিয়ে আসেন। বাড়িতে এসে তিনি টোস্টারটি টুকরা টুকরা করে ভেঙে ফেলেন।
 
থোয়াইটস ভেবেছিলেন টোস্টার মেশিন কী আর এমন আহামরি জটিল যন্ত্র হবে। কিন্ত তিনি যখন টোস্টার মেশিনের প্রত্যেকটা পার্ট আলাদা করলেন, দেখলেন এতে ৪০০-টার মতো পার্ট আছে। একটা টোস্টারের পার্টস তৈরি করতে মোট ১০০ ধরনের ম্যাটেরিয়ালের প্রয়োজন হয়। তবে এগুলির কাচামাল মূলত তিনটা জিনিস দিয়ে তৈরি: প্লাস্টিক, নিকেল আর স্টিল।

জেমস ক্লিয়ার


থোয়াইটস ঠিক করেন তিনি প্রথমে স্টিলের যন্ত্রপাতিগুলি বানাবেন। কিন্ত এর জন্য তার আকরিক লোহা অর্থাৎ কাঁচা লোহার দরকার হবে। তাই থোয়াইটস তার এলাকায় আকরিক লোহা উৎপাদন করে যে কোম্পানি তাদের কাছে ফোন করলেন যে তার কিছু কাঁচা লোহা প্রয়োজন। মজার ব্যাপার হলো, কোম্পানিটি থোয়াইটসের প্রস্তাবে সাড়া দেয়।

টোস্টার প্রজেক্ট
কিন্ত টোস্টার প্রজেক্টে থোয়াইটস শুভযাত্রা বেশিদিন টিকল না। যখন তিনি টোস্টারের প্লাস্টিক অংশগুলি বানাতে চাইলেন তখন বুঝলেন প্লাস্টিক বানানোর জন্য তার দরকার ক্রুড ওয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল)। তাই তিনি এবার বিপিকে (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামকে) ফোন করে তাদের তেলের খনি থেকে কিছু ক্রুড ওয়েল চাইলেন। বিপি লোহার কোম্পানির মতো এত উদার ছিল না। তারা সাথে সাথে মানা করে দিল।

উদ্ভাবনী আইডিয়া তৈরি হয় কীভাবে
থোয়াইটস এবং তার টোস্টার প্রজেক্ট

তখন থোয়াইটস চিন্তা করলেন ফেলে দেয়া প্লাস্টিক গলিয়ে সেটা দিয়ে তার টোস্টারের জন্য প্লাস্টিক কেইস বানানো যাবে। শুনতে এত সহজ মনে হলেও কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। শেষ করার পর দেখা গেল থোয়াইটসের টোস্টার দেখতে একটা গলে যাওয়া কেকের মতো হয়েছে। দেখে মনেই হচ্ছিল না এটা কোনো ইলেকট্রিক যন্ত্র হতে পারে।

থোয়াইটস তার এই টোস্টার প্রজেক্টে যত বার হাত দিয়েছেন, ততবারই একই ঘটনা ঘটেছে। থোয়াইটস শেষমেশ অনুধাবন করতে পারলেন যে টোস্টার নিয়ে এর আগে যারা কাজ করেছেন, তাদের সাহায্য ছাড়া একদম নিজে নিজে এই প্রজেক্টকে সামনে নিয়ে যাওয়া একেবারে অসম্ভব। এই জন্য শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হন নিকেলের জন্য ধাতব মুদ্রা গলিয়ে কাজ করতে। থোয়াইটস স্বীকার করে বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি প্রতিটা বিষয় যদি আপনি নিজে করতে চান, তাহলে এক টোস্টার বানাতে গিয়ে আপনার জীবন পার হয়ে যাবে।”

কোন প্রজেক্ট শূন্য থেকে শুরু করবেন না
একদম শূন্য থেকে শুরু করার চেয়ে মিনিমাম কোনো একটা অবস্থা থেকে শুরু করা অনেক ভালো আইডিয়া। আমরা অনেক সময় ভাবি একদম সাদা কাগজ থেকে শুরু করলে বুঝি মাথায় ভালো আইডিয়া আসে। যখন ব্যবসার লোকসান হয়, তখন আমরা অনেকেই বলি “আসো ব্যাপারটা গোড়া থেকে দেখি।” কিংবা যখন আমরা কোনো অভ্যাস বদলাতে চাই তখন নিজেদেরকে বলি “কালকে থেকে নতুন করে শুরু করব।” কিন্ত একটা সৃষ্টিশীল কাজ এভাবে তৈরি হয় না। একটা নতুন সৃষ্টি মানে এই না যে আগের যত আইডিয়া আছে, আগের যত অগ্রগতি আছে সব জলাঞ্জলি দিয়ে আনকোরা নতুন কিছু তৈরি করতে হবে।

প্রকৃতি থেকেই আমরা উদাহরণ দেখতে পারি
অনেক জীববিজ্ঞানী মনে করেন, সরীসৃপদের গায়ের আঁশ বিবর্তিত হয়ে পাখির পালক হয়েছে। এই আঁশগুলি যেগুলি শরীরের উষ্ণতা ধরে রাখতে কাজে দিত, সেগুলি খসে গিয়ে ক্রমান্বয়ে ছোট ছোট পালকে রূপান্তরিত হয়। পরে ধীরে ধীরে সেই ছোট পালক এক সময় বড় পালকে বিবর্তিত হয় যা ব্যবহার করে পাখিরা উড়তে সক্ষম হয়।

একদিন সকালে উঠে প্রাণিজগতের মনো হল, চলো এমন একটা প্রাণী বানাই যেটা উড়তে পারবে—প্রাণিজগৎ এভাবে কাজ করে না। প্রাণিজগতে উড়তে পারা পাখির আবির্ভাব ছিল বিবর্তনের একটা লম্বা প্রক্রিয়া। আগের যে আইডিয়া ছিল তার সম্প্রসারণ এবং পুনরাবৃত্তির ফলে সরীসৃপ বিবর্তিত হয়ে পাখিতে রূপান্তর হয়েছে।

মানুষের দিকে তাকানো যাক, আমরা কীভাবে আকাশে উড়লাম? আমাদের আকাশযাত্রার গল্পটাও তো অনেকটা এমন। উড়োজাহাজের আবিষ্কারক হিসেবে অরভিল আর উইলবার রাইট ভাইদের কথা আমরা জানি। কিন্ত অটো লিলিয়েনথাল, সামুয়েল ল্যাংলি এবং অকটেভ চানুটের মতো মহারথীদের অবদানের কথা আমরা জানি না। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় এই সব মানুষের কাজের ওপর ভিত্তি করেই মানব ইতিহাসের প্রথম ফ্লাইং মেশিন বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

সবচেয়ে চমক দেয়া উদ্ভাবনী কাজটা আসলে আগে থেকে কাজ করা আইডিয়াগুলির একটা নতুন কম্বিনেশন ছাড়া আর কিছু না। উদ্ভাবকেরা নতুন কিছু তৈরি করেন না, তারা কেবল একটার সাথে আরেকটা যুক্ত করেন। তাই কোনো সিস্টেমের উন্নতি করার জন্য পুরাটা ভেঙে নতুন করে করার চেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে আগের যে সিস্টেম ছিল সেটার কেবল ১% হলেও উন্নতি করা।

নতুন শুরু করার চেয়ে পুরানাটাই বার বার করতে থাকুন
টোস্টার প্রজেক্টের উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় আমাদের আধুনিক জীবন এখন কতটা জটিল। আমরা টোস্টার কিনার সময় কি এত কিছু ভাবি যে কীভাবে এই টোস্টারটা আমাদের হাতে এসে পৌঁছালো। এর লোহার পার্টস তৈরি করতে কোন খনির লোহা ব্যবহার করা হয়েছে বা কোন খনির তেল থেকে এর প্লাস্টিক ম্যাটেরিয়াল বানানো এগুলি আমাদের না ভাবলেও চলে।

এভাবে আধুনিক জমানায় প্রতিটি জিনিস যে একে অপরের সাথে কত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত তা আমরা ধরতে পারি না। তাই জরুরি হচ্ছে এই অতি জটিল আধুনিক সমাজে কোন শক্তি আমাদের পক্ষে কাজ করছে আর কোনটা আমাদের বিপক্ষে কাজ করছে তা বুঝতে পারা। টোস্টার প্রজেক্টের কথা ভাবুন না কেন। এখানে আমরা কেবল শেষ প্রোডাক্ট নিয়েই মাথা ঘামাই। জানতেও পারি না কীভাবে এই অবস্থায় এলো।

আরো পড়ুন: জেমস ক্লিয়ার এর “ভুল করা বিষয়ে ৫টি শিক্ষা”

তাই যখনই একটা জটিল কাজ সমাধানের চেষ্টা করবেন, তখনই আপনার উচিত এ বিষয়ে আগে যা যা কাজ হয়েছে সেখানে থেকে শুরু করা। একটা কথা মনে রাখবেন, কোনো আইডিয়া যদি এখনও কাজ করে থাকে তার মানে হচ্ছে অনেক বাধা অনেক প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়েও আইডিয়াটা এখনও টিকে আছে। পুরনো আইডিয়া হচ্ছে লুকানো অস্ত্রের মতো কেননা তারা এখনো দুনিয়ার মারপ্যাঁচে ধরা খেয়ে যায় নাই।

তাই অনুকরণ করুন, নতুন তৈরি করার চেয়ে।

অনুবাদ: আমিন আল রাজী