ম্যাকাফি অ্যান্টিভাইরাসের সাথে অনেকেরই পরিচয় থাকার কথা। যারা ১০-১৫ বছর আগে কম্পিউটার ব্যবহার করতেন অন্তত তাদের ম্যাকাফি অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার সম্পর্কে জেনে থাকবেন অথবা অনেকেই ব্যবহার করে থাকবেন। কম্পিউটার চালু করলেই সেই সফটওয়্যার নোটিফিকেশন দিত—‘আপডেট ইয়োর অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার’।

কিন্তু সেই ম্যাকাফি সফটওয়্যারের পিছনে কে ছিলেন? কার নামে ছিল সেই সফটওয়্যারটা? যার নামে ছিল সেই ম্যাকাফি সফটওয়্যার, তার নামই জন ম্যাকাফি। ‘স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’ বা ‘গল্পের চেয়েও অদ্ভুত’ যা বোঝায় ভদ্রলোকের জীবন সেরকমই। তার জীবনের শেষটা যেভাবে ঘটল সেটাকে ‘স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন’ বললেও কম বলা হবে।

২৩ জুন ৭৫ বছর বয়সে জন ম্যাকাফি স্পেনের জেলে আত্মহত্যা করেছেন। আর ওইদিনই স্পেনের আদালত রায় দিয়েছে যে কর ফাঁকির অভিযোগে ম্যাকাফিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এই রায় ঘোষণার পরেই ম্যাকাফি আত্মহত্যা করেন।

ম্যাকাফির জীবন ঘটনাবহুল। সেই ঘটনাবহুল জীবনকে পিছন ফিরে দেখা যাক।

জন ম্যাকাফি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ব্রিটেনে। ১৯৮০ এর দশকে ম্যাকাফি বিখ্যাত হয়ে উঠেন ম্যাকাফি অ্যাসোসিয়েটস নামে একটা সফটওয়্যার কোম্পানি তৈরি করে। এক সময় কনজ্যুমার কম্পিউটার বা ব্যক্তিগত কম্পিউটারের জন্য সিকিউরিটি সফটওয়্যার তৈরি করত ম্যাকাফি অ্যাসোসিয়েটস।

১৯৯৪ সালে ম্যাকাফি সেই কোম্পানি থেকে পদত্যাগ করেন। এবং কোম্পানিটিও ম্যাকাফি থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। ম্যাকাফির সাথে কোম্পানির সম্পর্কের এমন অবনতি হয়েছিল যে কোম্পানি তার ব্র্যান্ড নেইম পরিবর্তন করে ফেলে, ম্যাকাফির সাথে নিজেদের সম্পর্কের ইতিহাস মুছে ফেলতে চায়। ২০১০ সালে, ৭.৭ বিলিয়ন ডলারে এই কোম্পানিকে কিনে নেয় ইন্টেল। আর কোম্পানির নাম তখন বদলে যায়— ইন্টেল সিকিউরিটি।

এখন, প্রশ্ন আসতে পারে, কেন ম্যাকাফির সাথে কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি ঘটল? কেন কোম্পানিটি চাইল ম্যাকাফির সাথে তাদের সম্পর্কের ইতিহাস মুছে ফেলতে?

ম্যাকাফি কোম্পানিতে অংশীদারিত্ব বেঁচে দেয়ার পর আরও কয়েকটা ব্যবসা শুরু করেছিলেন, আরো কিছু উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কোনোটাই বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। যেমন, একটা ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং সিস্টেম, একটা ফায়ারওয়াল প্রোভাইডার সহ আরো কিছু।

ঝামেলা শুরু হয় যখন ২০০৮ সালে তিনি মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজের দিকে যাত্রা শুরু করেন। বেলিজে তিনি কুওরামএক্স (QuorumEx) নামে একটা কোম্পানি তৈরি করেন। এই কোম্পানির লক্ষ্য ছিল এক ধরনের হারবাল অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা। ২০১২ এর এপ্রিলে বেলিজের পুলিশ বিভাগের গ্যাং সাপ্রেশন ইউনিট মেথামফেটামাইন ল্যাব আছে এমন সন্দেহে কুওরামএক্সের গবেষণাগার রেইড দেয় এবং ম্যাকাফির পাসপোর্ট এবং লাইসেন্স করা অস্ত্রপাতি জব্দ করে, তার কুকুরকে গুলি করে মেরে ফেলে, এবং লাইসেন্স ছাড়া ড্রাগস তৈরি ও লাইসেন্সবিহীন অস্ত্র রাখার অভিযোগ আনে ম্যাকাফির বিরুদ্ধে। পরে অবশ্য অভিযোগগুলি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, পুলিশ যখন ম্যাকাফিকে ধরতে যায়, তারা যখন পৌঁছায়, ম্যাকাফিকে তারা বিছানায় ষোল বছর বয়সী এক মেয়ের সাথে পায়।

পরে ২০১২ সালে ম্যাকাফি আবার মিডিয়ায় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেন তার এক প্রতিবেশীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। সেই প্রতিবেশীর নাম ছিল গ্রেগরি ফাউল। গ্রেগরি ফাউল ম্যাকাফি’র নিয়ন্ত্রণহীন লাইফস্টাইল, অতিরিক্ত কমবয়সী মেয়েদের নিয়ে মেতে থাকা এবং অনেক বেশি বডিগার্ড রাখার ব্যাপারে বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি স্থানীয় মেয়রের কাছে ম্যাকাফি’র নয়টা বিশালাকার কুকুর বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন। এর দুইদিন পরে, ফাউলে’র হাউজকিপার তাকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে। ফাউলে’র মাথায় গুলির আঘাত ছিল। তখন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সন্দেহভাজন হিসাবে ম্যাকাফিকে চোখে চোখে রাখতে শুরু করে, তদন্ত শুরু করে। ম্যাকাফি সেখান থেকে পালিয়ে যান।

ম্যাকাফি এরপরে গুয়াতেমালায় পালিয়ে ছিলেন এবং পলাতক থাকা অবস্থায় সেখান থেকে মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেন। এরপরে ওই বছরই ডিসেম্বরে তাকে গুয়াতেমালায় গ্রেফতার করা হয়। এরপর ম্যাকাফি গুয়াতেমালায় রাজনৈতিক আশ্রয় চান, কিন্তু তাকে তা দেওয়া হয় না। এরপর তাকে যেন বেলিজে স্থানান্তর না করা হয় সেজন্য ম্যাকাফি গুয়াতেমালার জেলে দুইবার হার্ট অ্যাটাকের অভিনয় করেন। ম্যাকাফির অভিনয় কাজে লাগে। ম্যাকাফিকে বেলিজে না পাঠিয়ে মায়ামিতে পাঠানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রেও ম্যাকাফি একের পর এক শিরোনাম হতে থাকেন। ২০১৫ সালে, ম্যাকাফি নতুন গঠিত সাইবার পার্টির ক্যান্ডিডেন্ট হিসাবে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। বছরের পরবর্তী দিকে, ম্যাকাফি দল বদলিয়ে লিবারেটেরিয়ান পার্টি থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। ২০২০ নির্বাচনেও তিনি লিবারেটেরিয়ান দল থেকে নমিনেশন নিয়ে আবার নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। কিন্তু ২০২০-এ এইবার তিনি নির্বাসনে ছিলেন। কারণ এইবার আইআরএস বা ইন্টারন্যাশনাল রেভিনিউ সার্ভিস ম্যাকাফি, তার স্ত্রী ও তার চার সহযোগীর বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ আনে ও তদন্ত শুরু করে।

২০২০-এর অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নির্দেশে ম্যাকাফি স্পেনে গ্রেফতার হন। টানা ৪ বছর ধরে ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল জমা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে এই পরোয়ানা জারি হয়। টানা ৪ বছর কর না দিলেও এ সময়ে ম্যাকাফি তার কনসাল্টিং কাজ, ক্রিপ্টোকারেন্সি, বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেওয়া এবং তার জীবনীস্বত্ব বিক্রি করা থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন। কিছু সম্পদ গোপন রাখার অভিযোগও আনা হয় তার বিরুদ্ধে, যেমন, বিলাসবহুল ইয়াট, রিয়াল এস্টেট। এইসব সম্পত্তি তিনি অন্যের নামে রেখেছিলেন।

এই বছরের মার্চ মাসে, ম্যাকাফির বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগও আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে ম্যাকাফি এবং তার একজন বিজনেস পার্টনার তাদের বিনিয়োগকারীদের ১৩ মিলিয়ন ডলার পাওনা ফাঁকি দিয়েছেন ক্রিপ্টোকারেন্সির ভুয়া প্রমোটের মাধ্যমে।

স্পেন তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে চাইলে ম্যাকাফি আপত্তি করেন। ম্যাকাফি দাবি করেছিলেন যে তিনি রাজনৈতিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন। রাজনৈতিক কারণে তার বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু ২৩ জুন স্পেনের আদালত রায় দেয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

স্পেনের আদালত ঘোষণা করে, বাদী তার আপিলে যেসব সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ দাবি করেছেন সেই কারণগুলি তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয় না। আদালতের রায়ে আরো বলা হয়, এমন কোনো তথ্য বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি যাতে প্রমাণিত হয় যে জনাব ম্যাকাফি রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

স্পেনের আদালত থেকে ঘোষণা আসার পর, ওইদিনই, ২৩ জুন বার্সেলোনার কাছে স্পেনের জেলে ম্যাকাফিকে তার কারাকক্ষে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। কাতালান জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের বক্তব্য অনুসারে, ম্যাকাফি আত্মহত্যা করেছেন।

ম্যাকাফির জীবন যেরকম ঘটনাবহুল ও অদ্ভুত ছিল, বলতেই হবে ম্যাকাফির মৃত্যু তার জীবনের থেকেও অদ্ভুতভাবেই হলো।