ইফতারের পর মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গেট থেকে বের হওয়ার সময় নিজেরে বেশ সুখী লাগতেছিল! সারাদিন ভীষণ গরম ছিল, এখানে সন্ধ্যারাতের হালকা ঠাণ্ডা বাতাসে খুব আরাম হইতেছে। আর চোখেরও আরাম দিতেছে পানগুছি নদীতে তীরের বাজারের বিভিন্ন রঙের লাইটের ঝলমলানি।

এই দৃশ্য গত দুই সপ্তাহে কমন হয়ে গেলেও, কোন অজানা কারণে মনে হইল এত রূপ আমি এর আগে দেখি নাই। আজকে নদীতে আরো অনেকগুলা জাহাজও আছে নোঙ্গর করা। একটা আছে বিশাল জাহাজ, দানবের মতো। আর অনেকগুলা আছে যেন তার বাচ্চা। ছোট বাচ্চা, মাঝারি বাচ্চা। একটা নদীবন্দরের ভাব আসছে এই এলাকায় আজকে।

অথচ নদীর পার একদম অন্ধকার থাকে কোনো কোনো দিন। এই রাস্তায় কোনো লাইট নেই, কম পাওয়ারের দুইটা লাইট জ্বলে হাসপাতালের সামনে। সব কর্মকাণ্ড ওই পাড়ে। এ পাড়ে খালি আছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আর তারপাশে পল্লী বিদ্যুৎ অফিস।

এরপর আর কী আছে দেখতে যাওয়া হয় নাই। একদিন রাতের বেলা মাভিন আর আমি বের হয়েছিলাম ওইদিকে। একটু হাঁটার পরে ফিরে আসি আমরা। এত অন্ধকার! খুব অস্বস্তি লাগতেছিল। পানগুছি নদী কেমন জানি অস্থির ছিল ওইদিন। নদীর আচরণে মনে হইতেছিল আমাদের কোনো একটা বিপদে ফেলবে। এর আগে আমরা সাগরের পাড়েও অনেক রাতে গেছিলাম, সাগরকে ভরসা করার মত লাগছিল, পানগুছিকে লাগে নাই।

মোরেলগঞ্জ বাজারের পাশের খাল

আজকে এত জাহাজ এসে নদীটাকে বাসাবাড়ি বানিয়ে ফেলছে। আমি এখন পাড়ের দোকানটায় যাবো। মুদি কাম চা-বিড়ি দোকান। ভেতরে টিভি, চেয়ার, টেবিল আছে। করোনার ভয় না থাকলে হয়তো বসতাম ওখানে।

এখন বসি দোকানের বাইরে একটা ভ্যান থাকে, ওখানে। ওটায় জায়গা না থাকলে একটা নারিকেল গাছ শোয়ায় রাখা আছে, ওখানে বসি। নারিকেল গাছ বসার জন্য ভালোই। বিষয়টা আগে খেয়াল করি নাই।

পানগুছির পাড়ে, চা খাওয়ার জন্য এইখানে আসি

এই দোকানে কাচাপাতির চা ভালো বানায়। ওদের চেয়ে বেশি ভালো চা বানায় বাজারের দোকানে, তবে এজন্য নদী পার হতে হবে। অনেক ঝামেলা। এদিকে সব চা’ই স্বাদে নোনা, পানির কারণে। প্রথম প্রথম ভালোই লাগছিল। মনে হয় না বেশি দিন ভালো লাগবে। আজকে পানও খাবো। পানগুলার সাইজ ছোট ছোট, কিউট লাগে। কিউট কি মূলত ছোটত্বের গুণ?

সিগারেট, চা, পান নিয়ে ভ্যানে উঠে বসি। ভাবতেছি আজকে প্রায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেল মোরেলগঞ্জে আছি। ঢাকার বাইরে শেষ কবে এতদিন বাইরে ছিলাম? মনে হয় একদম ছোট থাকতে। মা’র পরীক্ষার সময় সাথে নিয়ে গেছিল। তিন মাস ছিলাম লক্ষীপুরে।

মাভিন, বাসা থেকে দশ মিনিট দূরে এ জায়গাটা

এখানে দুই সপ্তাহ হইল, কঠোর লকডাউন যেহেতু বাড়াবে আরও কয়েক দিন চলবে আমাদের হানিমুন সংসার। এখানে নোনা পানি ছাড়া কোনো সমস্যা হচ্ছে না। রান্নাবান্না ঘরের কাজ-কাম করি। ল্যাপটপে অফিসের কাজ করি, বসের কাজ করি। বৌ-এর সাথে অনেক প্রেম ভালোবাসা করি। অল্প একটু ঝগড়া করি। মিস করার মধ্যে নরমাল পানি মিস করি সবচেয়ে বেশি। বৃষ্টি হলে ভালো হতো। দুই-এক দিন ভাল গোসল করা যাইত।

যারা সারাজীবন এক জায়গায় কাটায় দেয় এদের অনেকের ব্রেনে নাকি একটা প্যাটার্ন থাকে। তারা চাইলেও নতুন জায়গায় সেটেল করতে পারে না। আমি কি এই রকম? নিজের কাছে মনে হয় নাই। নতুন জায়গায় সেটেল বেশি কঠিন কিছু হবে না এখন পর্যন্ত যা মনে হইল।

বিয়ের আগে মাভিনের পোস্টিং-এর কথা যখন শুনেছিলাম তখনই ভাবতাম বিয়ের পর সপ্তাহের শেষে ওর কাছে চলে আসব। আসার সময় বাজার নিয়ে আসব, নিজে রান্না করব। দুই-তিন দিন পিকনিক করে আবার ঢাকা ফিরে যাব। বিয়ের পর টানা সংসার জীবনে ঢুকে যাওয়ার চেয়ে এইটা অনেক দিক দিয়ে বেটার মনে হইছিল। আমাদের দুইজনার একে অন্যকে সহ্য করার অভ্যাসটা যাতে আস্তে আস্তে হোক, একটু কম প্রেসার পড়ুক সাংসারিক হওয়ার।

তবে এমন জায়গায় যে আসা হবে সেটা ভাবি নাই। এর আগে দক্ষিণাঞ্চল ঘোরা হয় নাই। মানে খুলনা, বরিশাল বিভাগে একবার আসছি সুন্দরবন দেখতে, আরেকবার বরিশাল গেছিলাম কলেজে থাকতে গৌরিপুরে রিলিফ দিতে। কোনো ঘুরাঘুরি হয় নাই। দক্ষিণবঙ্গের বিখ্যাত জিনিস খালও দেখা হয় নাই একটাও। এখন মোরেলগঞ্জে খাল দেখতেছি বেশ আনন্দে।

হাসপাতাল কমপ্লেক্স থেকে বের হওয়ার রাস্তা

আমি আগে জানতাম না খাল আমার এত ভালো লাগে। এখানে একটা বড় খাল আছে, যেটা মোরেলগঞ্জ বাজারকে দুইভাগ করে দিছে। ঐটা সবচেয়ে কম সুন্দর, যদিও বেশি কাজের। আর নদী থেকে অনেক খাল ঢুকছে গ্রামের ভেতর। এরা যে কী সুন্দর করে গ্রামের মধ্য দিয়া চলে যায়! যেন ঘরের সামনে দিয়ে একটা হাইওয়ে তৈরি হওয়ার মত। অথচ গাড়ির কেওয়াজ নাই, ধোঁয়া নাই। খালি পানির স্রোত, ছোটখাট নৌকা আছে। যে সব খালের পাড়ে গোলপাতা আছে সেগুলা সবচেয়ে ভাল্লাগে। একেকটা মিনি সুন্দরবন। আরও কিছু গাছ আছে এদিকে যেগুলা সুন্দরবনেও দেখছিলাম। সুন্দরবন প্রথমবার যতটা ভাল লাগছিল, সেকেন্ডবার তার বেশি লাগছে। আমার মনে হয় থার্ডবার আরও বেশি লাগবে। ভাল জিনিসগুলা মনে হয় এরকম। যত দিন যায় তত ভাল লাগা বাড়ে।

সামনে দেখি নদীর পাড়ে কিছু লোক হই-হল্লা করতেছে। মাভিনকে বলতেছিলাম এই দিকের লোকেরা যে অন্যদের চেয়ে লাউড হয় এর কারণ কী?

ও কী জানি উত্তর দিছিল ভুলে গেছি। প্রশ্নটা আসলে ওরে করছিলাম নিজের উত্তর শুনানোর জন্য। লাউড লোকজন অবশ্য আমার বেশি একটা খারাপ লাগে না। এরা শান্ত মানুষজনের চেয়ে বেশি ইন্টারেস্টিং কাজ-কারবার করে। আর এদের মন পড়তে পারাও তুলনামূলক সোজা। আমার সামনের লোকদের চিল্লাপাল্লার কারণ মাছধরা। লোকজন মনে বেট ধরছিল মাছ ধরা নিয়া। বড় চিংড়ী ধরা পড়ছে বলাবলি করতেছে।

এদিকে ভালই মাছ মারে লোকজন। একদিন ভ্যানে করে আসতেছিলাম বাসস্ট্যান্ড থেকে। ভ্যানআলার পরিচিত এক ছেলে লাফ দিয়ে ভ্যানে উঠে বসল, যদিও ভ্যান রিজার্ভ করে নিছিলাম আমি। তার হাতে জাল, বাজারে গেছিল রিপেয়ার করাইতে। আজকে রাতে মাছ ধরবে। কারণ তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বাসায় আসছে। ত একবেলা মাংস দিয়া ভাত খাইছে, এখন রাতের বেলা তাজা মাছ খাইতে চায়। আমারে সে দেখাইল কোনদিকের খালে আজকে মাছ ধরবে। তার মাছ ধরার এক্সাইটমেন্ট এখনই প্রকাশ পাইতেছিল চোখেমুখে।

পানগুছির উপরে কালবৈশাখীর মেঘ

একদিন রাত একটার দিকে আমরাও দেখছি—শুনশান নীরব নদীর তীর, এরই মধ্যে দুইজন লোক টর্চ আর জাল হাতে। তারা নদীপাড়ে জাল মারতেছে, আর আগাইতেছে। তারা বলল, এসময় পাড়ে প্রচুর চিংড়ী থাকে নাকি। আমি আর মাভিন তাদের সাথে সাথে গেলাম একটু। আমাদের ইচ্ছা কোনো একবার জেলেদের নৌকায় চড়ে রাত্রিবেলা তাদের মাছধরা যদি দেখতে যাইতে পারতাম। অবশ্য নৌকাগুলা এত ছোট। আর পানগুছি এত বিশাল! আমার ভয় করে। সাঁতার কি এই জীবনে শিখা হবে না আমার?

মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট; ৭ মে ২০২১
কভারে আমিন আল রাজী—ঢাকা ইউনিভার্সিটি—ছবি. তাহসিন জুলফিকার মম, ২০১৩