অসাধারণ এক প্রাণী পিঁপড়া। অ্যান্টার্কটিকা বাদে পৃথিবীর বাকি ছয়টি মহাদেশেই পিঁপড়ার দেখা পাওয়া যায়। সামাজিক এই প্রাণীর কান নেই। মাটিতে পা দিয়ে শব্দের কম্পন অনুভব করে পিঁপড়া। অনেক প্রজাতির পিঁপড়ার চোখও নেই। তবে পতঙ্গদের মধ্যে অন্যতম দীর্ঘজীবী এই প্রাণীকে দেহের আকারের তুলনায় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পিঁপড়ারা সাধারণত সংঘবদ্ধ হয়ে কলোনিতে বসবাস করে। কোথাও কলোনি স্থাপন করলে তারা সময়ের সাথে সাথে কলোনির আকার বড় করতে থাকে আর নতুন জায়গা দখল করে। তবে কিছু প্রজাতির পিঁপড়া অন্যান্যদের চেয়ে বেশিই আগ্রাসী হয়ে থাকে। তেমনই এক প্রজাতি হলো আর্জেন্টাইন অ্যান্ট, যাদের বৈজ্ঞানিক নাম ‘লিনেপিথেমা হিউমিলে’ (Linepithema Humile)।

অন্যান্য প্রজাতির পিঁপড়াদের তুলনায় আর্জেন্টাইন অ্যান্ট আকারে ক্ষুদ্র এবং দেখতে সাধারণ। তবে এরাই পৃথিবীর ইতিহাসে পিঁপড়াদের তৈরি সবচেয়ে বড় কলোনি গঠন করেছে। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুসারে এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় পিঁপড়ার কলোনি গড়ার রেকর্ড আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের কাছেই। তাদের এই সুপারকলোনি স্পেনের আটলান্টিক উপকূল থেকে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চল পর্যন্ত ৩,৭০০ মাইল জুড়ে বিস্তৃত।


অনুবাদ: ফারহান মাসউদ


এই প্রজাতির পিঁপড়ার কলোনি মোটামুটি ছোট থেকে বেশ বড় আকারের হতে পারে, যেগুলি যেকোনো ধরনের পরিবেশেই পাওয়া যায়। পুরনো গাছের গুঁড়ি থেকে শুরু করে ঝরে পড়া শুকনা পাতার নিচে কিংবা অন্যান্য প্রজাতির পরিত্যক্ত কলোনিতেও তাদের দেখা মেলে। মানুষের বাসাবাড়িতেও এরা নিজেদের কলোনি তৈরি করে। নোংরা পরিবেশে বা ডাস্টবিন থেকে শুরু করে খাবারের ওপর এরা অবাধে চলাচল করে। এতে করে খাবারে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়।

আর্জেন্টাইন অ্যান্টরা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে আছে। এরা স্থানীয় পরিবেশের জন্যে ক্ষতিকর এবং এদের স্বভাবও অনেক আক্রমণাত্মক। এলাকা দখল করার জন্যে তারা বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়া এবং কীটপতঙ্গের সাথে লড়াই করে। আর নতুন এলাকা দখল করতে গিয়ে এদের আগ্রাসী আচরণের কারণে দখল করা এলাকা থেকে অনেক প্রাণী নির্মুল হয়ে যায়।

তবে এলাকা দখল করার জন্যে আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের মতো অন্যান্য প্রজাতির পিঁপড়াও লড়াই করে থাকে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা কোণাতেই পিঁপড়াদের এই লড়াই চলছে। একে অন্যের সাথে লড়াই করতে প্রকৃতি থেকে তারা যা পেয়েছে, সেটাই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। শরীরের শক্তিশালী গঠনকে কেউ বর্ম হিসেবে কাজে লাগায়, কারও দংশন অন্যদের জন্যে প্রাণঘাতী হতে পারে, আবার কারো রয়েছে ধারালো দাঁত বা ম্যান্ডিবল।

তাহলে এলাকা দখলের ক্ষেত্রে আর্জেন্টাইন অ্যান্টরা কীভাবে অন্যান্য প্রজাতির পিঁপড়াদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল?

আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের গল্পটা শুরু দক্ষিণ আমেরিকার পারানা নদীর আশেপাশের প্লাবনভূমিতে। এলাকাটি মূলত বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়ার বাসস্থান, যেখানে অন্তত কয়েক ডজন প্রজাতির পিঁপড়া একে অন্যের সাথে আধিপত্যের জন্যে লড়াই করে থাকে।

এসব প্রজাতির মধ্যে ‘ফায়ার অ্যান্ট’ এবং ‘আর্মি অ্যান্ট’-এর মতো পিঁপড়ার পাশাপাশি ‘আর্জেন্টাইন অ্যান্ট’ও রয়েছে। আশেপাশের অন্যান্য শক্তিশালী প্রজাতির মধ্যে আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের টিকে থাকাটাই অবাক হওয়ার মতো বিষয়। কারণ, এদের দেহের দৈর্ঘ্য মাত্র ২ থেকে ৩ মিলিমিটারের মত হয়ে থাকে। দেহের আকার ছোট হওয়ায় এদের দাঁত বা ম্যান্ডিবলও ছোট।

তবে অন্যান্য পিঁপড়াদের তুলনায় আর্জেন্টাইন অ্যান্টরা একদিক দিয়ে অনেক বেশি এগিয়ে আছে আর সেই দিকটা হলো ‘জনশক্তি’। নিজেদের জনশক্তিকেই তারা শত্রুদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।

বেশিরভাগ প্রজাতির পিঁপড়াদের প্রজননের জন্যে কলোনিতে মাত্র একজন রানী থাকে। কিন্তু আর্জেন্টাইন অ্যান্ট এক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম। প্রতি ১২০ জন কর্মী পিঁপড়ার জন্যে একজন রানী থাকে এদের, যেই রানী প্রতিদিন প্রায় ৬০টি করে ডিম পাড়ে। তাই তাদের কলোনি খুব দ্রুত হারে বড় হতে থাকে আর অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ থেকে শুরু করে কোটি কোটি পিঁপড়ার জন্ম হয়।

ফলে বড় কোনো কলোনি থেকে প্রায়ই রানী এবং শ্রমিক পিঁপড়াদের ছোট ছোট দল বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের নতুন ঠিকানা বা নতুন কলোনি গড়ে তোলে। কিন্তু এই কৌশলের একটি বড় অসুবিধাও রয়েছে। কলোনি যত বড় হতে থাকে, তত বেশি পরিমাণে পিঁপড়ার জন্ম হতে থাকে। এতে করে নতুন জন্মানো পিঁপড়ার দেহে মিউটেশন বা পরিব্যক্তি ঘটে। তাছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠিত কলোনির পিঁপড়ারাও নতুন পরিবেশের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। আগের প্রজন্ম থেকে নতুন প্রজন্মে তাদের ডিএনএ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয় এবং নিজেদের প্রজাতির মধ্যেই বিভিন্ন বৈচিত্র্য তৈরি হতে থাকে।

তাই সময়ের সাথে সাথে যেসব পিঁপড়া নিজেদের কলোনি ছেড়ে নতুন কলোনি গড়ে তোলে, তারা অনেকটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের মতো হয়ে ওঠে এবং নিজেদের আদি কলোনির সাথেই প্রতিযোগিতা শুরু করে। মূলত দক্ষিণ আমেরিকার এই পিঁপড়ার প্রজাতি নিজেদের স্থানীয় পরিবেশে এমন আচরণই করে থাকে। নিজেদের কলোনির মধ্যে তারা সবাই সবাইকে সহযোগিতা করে এবং সুসংগঠিত হয়ে বসবাস করে। কিন্তু নিজেদের প্রজাতিরই অন্যান্য কলোনি অথবা ভিন্ন প্রজাতির কলোনির সাথে তারা মারাত্মক যুদ্ধ করে।

মূলত নিজেদের স্থানীয় পরিবেশে প্রতিপক্ষের সবার শক্তিই মোটামুটি সমান হওয়ার কারণে আর্জেন্টাইন অ্যান্টরা সময়ের সাথে সাথে অনেক আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। তাদের দখলকৃত অঞ্চলের আশেপাশের প্রতি ইঞ্চি জায়গা দখলের জন্যে তারা লড়াই চালিয়ে যায়। কিন্তু অন্যদের সাথে হয়ত তারা পেরে উঠত না, যদি না এই গল্পে মানুষ এসে পড়ত।

‘আর্জেন্টাইন অ্যান্ট’―শত কোটি পিঁপড়ার আগ্রাসী মেগা কলোনি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের প্রথম দিককার একটা সুপারকলোনি প্রতিষ্ঠিত হয়।

পিঁপড়াদের এই গল্পে মানুষ যা করেছে, তা হল, জাহাজে করে বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্র পরিবহন করা। এমন জাহাজে চড়েই কিছু রানী পিঁপড়া দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ১৮৮২ সালে পর্তুগালের মাদেইরা দ্বীপে এবং ১৮৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অর্লিন্স-এ পাড়ি জমায়। নতুন অঞ্চলে আসা এসব আর্জেন্টাইন অ্যান্ট হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত জগতে নিজেদেরকে আবিষ্কার করে। এতদিন তাদের আশেপাশে থাকত বিভিন্ন ধরনের হিংস্র এবং মারাত্মক প্রজাতির প্রাণী। কিন্তু এখন তাদের চারপাশে শুধু শিকার আর শিকার। নতুন অঞ্চলের কোনো প্রাণীই এসব আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি।

অন্যদিকে, যেহেতু অল্প কিছু রানী পিঁপড়াই দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নতুন এলাকায় এসেছিল, তাই নতুন স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করা পিঁপড়াদের জিনগত বৈচিত্র্যও ছিল খুব কম। তার ওপর, আর্জেন্টাইন অ্যান্টরা প্রতি বছর তাদের কলোনির ৯০% পর্যন্ত রানীদেরকেই হত্যা করে ফেলে। ফলে রানী পিঁপড়াদের মধ্যেও জিনগত বৈচিত্র্য তৈরি হওয়ার সুযোগ কমে আসে। এতে করে দক্ষিণ আমেরিকায় তারা যেভাবে এক কলোনি থেকে একাধিক কলোনি তৈরি করত, এখনও সেভাবে কলোনি তৈরি করলেও নতুন সব কলোনির পিঁপড়ারা আর দূর সম্পর্কের আত্মীয় থাকল না। এ কারণে নতুন নতুন এলাকায় গড়ে ওঠা একাধিক কলোনি পরস্পর বিরোধী নয়, বরং পরস্পরের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করা শুরু করল। একাধিক কলোনির মধ্যে এই সহযোগিতার সম্পর্ককে বলা হয় ‘সুপারকলোনি’। পিঁপড়াদের মধ্যে সুপারকলোনি গড়ে তোলার এই কৌশল খুব একটা দেখা যায় না। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ১৬,০০০ এরও বেশি প্রজাতির পিঁপড়ার মধ্যে মাত্র কয়েকটা প্রজাতিই ‘সুপারকলোনি’ গড়ে তোলার কৌশল কাজে লাগাতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের প্রথম দিককার একটা সুপারকলোনি প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং আকারে ক্ষুদ্র এসব পিঁপড়াদের বিশ্ব জয়ের জন্যে এই সুপারকলোনিই একটা ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানে পৃথিবীর ৬টি মহাদেশে এবং বিভিন্ন দ্বীপে আর্জেন্টাইন পিঁপড়া বসবাস করছে। বিশেষত বিভিন্ন মহাদেশের যেসব অঞ্চলে ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেসব অঞ্চলে এদের বেশি দেখা যায়।

আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত সেই সুপারকলোনি, বিশেষ করে এত বেশি প্রভাব বিস্তার করে যে, সেখান থেকেই এসব পিঁপড়া ক্যালিফোর্নিয়া, ইউরোপ, জাপান, নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সব মিলিয়ে আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের একটি আন্তঃমহাদেশীয় ‘মেগাকলোনি’ গঠিত হয়। এতে করে আর্জেন্টাইন অ্যান্টদেরকেই পৃথিবীর বৃহত্তম সমাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যাদের সংখ্যা মানুষের চেয়েও বেশি।

কিন্তু নতুন অঞ্চল জয় করে আর্জেন্টাইন অ্যান্টরা যেসব এলাকায় কলোনি প্রতিষ্ঠা করেছে, সেসব এলাকার বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর একটি উদাহরণ হলো ক্যালিফোর্নিয়া। নতুন অঞ্চল দখল করার লোভে আক্রমণকারী আর্জেন্টাইন অ্যান্ট সেখানকার স্থানীয় প্রায় ৯০% প্রজাতির পিঁপড়াদের সরিয়ে তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিশেষ করে স্থানীয় পিঁপড়া ‘ক্যালিফোর্নিয়ান কার্পেন্টার অ্যান্ট’-এর বেশ কিছু প্রজাতি আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় এসব প্রজাতির পিঁপড়ার সংখ্যা অনেকটাই কমে এসেছে। যদিও কার্পেন্টার অ্যান্টদের কর্মী পিঁপড়ারা আকারে অনেক বড় হয়, কিন্তু তাদের কলোনিতে পিঁপড়ার সংখ্যা থাকে মাত্র ৩,০০০ থেকে ৬,০০০ এর মধ্যে। ফলে কোটি কোটি আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা কখনোই পেরে ওঠেনি।

এছাড়া আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের আক্রমণের ফলে অন্যান্য বিভিন্ন প্রজাতির পিঁপড়ার সংখ্যা কমে যাওয়ায় ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের স্থানীয় প্রাণী হর্নড লিজার্ড নামের একধরনের টিকটিকির সংখ্যাও কমে এসেছে।

লড়াইয়ে আর্জেন্টাইন অ্যান্ট প্রজাতির কর্মী পিঁপড়ারা আক্রমণ করার সময় তাদের শিকারদের ওপর বিষাক্ত রাসায়নিক লেপে দেয়। এতে শত্রুরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং অন্যান্য আর্জেন্টাইন অ্যান্টরাও আক্রমণের জন্যে তাদেরকে লক্ষ্য হিসাবে চিহ্নিত করে।

‘আর্জেন্টাইন অ্যান্ট’―শত কোটি পিঁপড়ার আগ্রাসী মেগা কলোনি
গ্যাস্টার বেন্ডিং প্রক্রিয়ায় আর্জেন্টাইন অ্যান্ট প্রতিপক্ষের শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক ঢুকিয়ে দেয়।

এই পিঁপড়ারা তাদের প্রতিপক্ষকে আতর্কিত আক্রমণ করে। এ সময় দলে দলে হামলা করে তারা শিকারের বিভিন্ন অঙ্গ ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। লড়াইয়ের সময় আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের মধ্যে যতজনই মারা যাক, নতুন যোদ্ধারা তাদের জায়গা দখল করে নেয়। কারণ সংখ্যায় তারা অনেক। হেরে যাওয়া কলোনির সবাইকে নির্মূল করে কলোনি দখল করে ফেলার পরে আর্জেন্টাইন অ্যান্ট শিকারের ডিম আর বাচ্চাদের খেয়ে ফেলে। একই সাথে তাদের বাসস্থান আর আশেপাশের এলাকাও দখল করে ফেলে।

আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় তারা দখল করা অঞ্চলে থাকা বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় অনেক বেশি পরিমাণে শিকার করে খেতে থাকে। এতে পিঁপড়াদের দখল করা অঞ্চল থেকে কিছু প্রজাতি একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যায়। দখল করা নতুন অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনযাপনের পদ্ধতির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টাই করে না তারা। বরং সেসব উদ্ভিদ বা প্রাণী গ্রাস করে তারা নিজেদের এলাকা আরও বিস্তার করতে থাকে। এমনকি মানুষের সম্পত্তিতেও তারা নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করতে ছাড়ে না। খাবারের জন্যে তারা ময়লার ভাগাড় থেকে শুরু করে পোষাপ্রাণীর খাদ্যে বা রান্নাঘরে খুব সহজেই পৌঁছে যায়।

শুধু মানুষের বাসাবাড়িতেই না, বাগান এবং ফসলি ক্ষেতেও এসব পিঁপড়াদের উপস্থিতির প্রভাব পড়ে। কারণ অন্যান্য শিকারী প্রাণীর কাছ থেকে অ্যাফিড বা জাবপোকা নামের ফসলের একধরনের কীটকে সুরক্ষা দেয় আর্জেন্টাইন অ্যান্ট। জাবপোকা মূলত ফুল, পাতা বা গাছের অন্যান্য রসালো অংশ থেকে রস শুষে নেয় আর ‘হানিডিউ’ নামের একধরনের মিষ্টি নির্যাস উৎপন্ন করে। জাবপোকাদের উৎপন্ন সেসব নির্যাসের নিয়মিত যোগান পেতে বিভিন্ন প্রাণী আর পোকামাকড়ের হাত থেকে তাদের রক্ষা করে এসব পিঁপড়া। মূলত মানুষ যেভাবে গবাদি প্রাণী পালন করে, সেভাবেই জাবপোকা পালন করে পিঁপড়াদের কলোনি। আর যেহেতু দখল করা এলাকায় আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের বড় কোনো প্রতিপক্ষ থাকে না, সেহেতু পিঁপড়াদের সুরক্ষা পেয়ে জাবপোকাও দ্রুতগতিতে বংশবিস্তার করে আর উদ্ভিদের রস শুষে নিতে নিতে সংক্রমিত সেসব উদ্ভিদকে মেরে ফেলে। সুতরাং দখল করা এলাকার ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রে বিশৃঙ্খলা আনার পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রেও অনেক বড় ধরনের এক কীট হলো আর্জেন্টাইন অ্যান্ট।

‘আর্জেন্টাইন অ্যান্ট’―শত কোটি পিঁপড়ার আগ্রাসী মেগা কলোনি
একটি হার্ভেস্টার অ্যান্টকে আক্রমণ করেছে কয়েকটি আর্জেন্টাইন অ্যান্ট

কিন্তু অপ্রতিরোধ্য এসব আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের আগ্রাসন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সুপারকলোনি’র বেশ কিছু অংশ আলাদা হয়ে গিয়ে এখন নিজেদের সাম্রাজ্য গঠন করেছে। ফলে সাংঘাতিক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে তাদের মধ্যে। যেমন, বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের স্যান ডিয়েগো কাউন্টিতে অবস্থিত একটি সুপারকলোনির সাথে আর্জেন্টাইন অ্যান্টদেরই বিশাল আরেকটি কলোনির যুদ্ধ চলছে। লেক হজেস-এর আশেপাশের বেশ কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলতে থাকা এই লড়াইয়ে প্রতিবছরই প্রায় ৩০ মিলিয়ন বা ৩ কোটি পিঁপড়া মারা যায়।

আরো পড়ুন: পিঁপড়ারা যে কারণে মানুষের চেয়ে ভাল ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে

এভাবে অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টাইন অ্যান্টরা। অনেকসময় নিজেদের প্রজাতি ছাড়াও সেই পারানা নদীর আশেপাশে থাকা পুরনো প্রতিবেশিরাও প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। তেমনই এক প্রতিপক্ষ হলো ‘রেড ইমপোর্টেড ফায়ার অ্যান্ট’, যারা আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের মতোই ১৯৩০ এর দশকে ঘটনাক্রমে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আলাবামা রাজ্যের উপকূলে এসে পড়েছে।

হিংস্র এই রেড ফায়ার অ্যান্টরা আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের সাথে টেক্কা দিতে সক্ষম। আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের মতো ফায়ার অ্যান্টদের মাধ্যমেও সারাবিশ্বে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফায়ার অ্যান্টদের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের লোকসান হয়। তাছাড়া রেড ফায়ার অ্যান্টরা সুপারকলোনিও গঠন করতে পারে। অর্থাৎ, দক্ষিণ আমেরিকায় নিজেদের আদি বাসস্থানের পুরনো যুদ্ধই এখন বিদেশের মাটিতে হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে থাকা এই দুটি প্রজাতির পিঁপড়ার সুপারকলোনির মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষ হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে যে, আর্জেন্টাইন অ্যান্টরাই অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষ। ফায়ার অ্যান্টদের কর্মী পিঁপড়ারা একেকটা আর্জেন্টাইন অ্যান্টের তুলনায় দ্বিগুণ বড় আর তাদের শরীরে থাকা হুলের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের শরীরে বিষ ঢেলে দিতে পারে। অসংখ্য যুদ্ধে হেরে যাওয়ার ফলে বিজয়ী রেড ইমপোর্টেড ফায়ার অ্যান্টরা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা থেকেই আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের সুপারকলোনি নির্মূল করে ফেলেছে।

আরো পড়ুন: তিমির বিষ্ঠার আশ্চর্য ক্ষমতা 

এই পরাজয়ের মাধ্যমে আর্জেন্টাইন অ্যান্টদের একটি অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে গেছে, কিন্তু তারা লড়াই চালিয়ে যাবে। একাধিক সুপারকলোনির মধ্যে যোগাযোগ আর সমন্বয় আনার মাধ্যমে তৈরি নেটওয়ার্কই তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আর শুধুমাত্র ছোট্ট একটা পরাজয়ের কারণে তারা এত বড় সাফল্য বিসর্জন দেবে না। ভবিষ্যতে সম্ভাব্য যেকোনো শত্রুর বিরুদ্ধেই তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আর পিঁপড়াদের এই যুদ্ধে অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে থাকবে, যতক্ষণ না পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর পরিকল্পনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

সূত্র. Kurzgesagt – In a Nutshell,