দেশে দেশে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে নোভেল করোনাভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ অবস্থাকে প্যানডেমিক হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ভাইরাস মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, তাইওয়ান সেখানে কার্যকরভাবে করোনার বিস্তার রোধ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

চীনের উপকূলবর্তী দ্বীপ তাইওয়ানের জনসংখ্যা ২৩ লক্ষ। করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল তাইওয়ান। তাইওয়ানের ৮৫০০০০ এর বেশি নাগরিক চীনে বসবাস ও কাজ করায় বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছিলেন করোনাভাইরাসের মারাত্মক প্রভাব পড়বে তাইওয়ানে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস যেহেতু চাইনিজ নববর্ষের মতো ব্যস্ততম পর্যটনকালীন সময়ে ছড়িয়ে পড়েছিল।

এখন পর্যন্ত [১৩ মার্চ ২০২০] তাইওয়ানে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪৯, মৃত ১ জন [২৫ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত আক্রান্ত ২৩৫, মৃত ২ জন—বি.স.]। চীনের নিকটবর্তী দেশ হিসেবে এবং এই দুই দেশের মধ্যে নাগরিকদের অহরহ যাতায়াত বিবেচনা করলে এই সংখ্যা অবাক করার মত।

জন হপকিন্স এর হিসাব অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার [১২ মার্চ ২০২০] পর্যন্ত চীনে মৃতের সংখ্যা ৩১০০, দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ৭৮০০ এবং মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ৬৬, জাপানে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৩৯ এবং মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ১৬ জন।


স্টেসি চ্যান
এবিসি নিউজ, ১৩ মার্চ ২০২০


স্ট্যানফোর্ড হেলথ পলিসির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তাইওয়ানের এই সাফল্যের পিছনে মূল অবদান রেখেছে ২০০৩ সালে সার্স-এর প্রকোপের সময় গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কৌশলের দ্রুত প্রয়োগ।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পলিসি, আউটকামস অ্যান্ড প্রিভেনশন এর পরিচালক জেসন ওয়াং, জানুয়ারিতে প্রথম যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কথা জানতে পারেন, তখনই ব্যক্তিগত উদ্যোগে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন। শুরুর দিকে তার এই কাজের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল ফেব্রুয়ারিতে তাইপের দ্য নিউ স্কুল ফর লিডারশিপ ইন হেলথকেয়ারে তার কোর্স পড়াতে যাওয়া নিরাপদ হবে কিনা তা জানা।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পলিসি, আউটকামস অ্যান্ড প্রিভেনশন এর পরিচালক জেসন ওয়াং জানুয়ারিতে করোনাভাইরাসের প্রকোপের খবর পাওয়ার পরই নিজে ডাটা কালেকশন শুরু করেছিলেন।

ওয়াং এবিসি নিউজকে বলেন সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলি কার্যকর হচ্ছে কিনা তিনি তা বোঝার চেষ্টা করছিলেন এবং তার সহকর্মী বব ব্রুক এক পর্যায়ে এই বিষয়গুলি জানতে পারেন এবং অন্য দেশ ও জনগণকে সাহায্য করার জন্য এই পদক্ষেপগুলির একটা তালিকা তৈরি করার পরামর্শ দেন।

শুরুর কার্যক্রম
সার্স-এর প্রাদুর্ভাবের পর তাইওয়ান একটা ব্রাঞ্চসহ ন্যাশনাল হেলথ কমান্ড সেন্টার গঠন করে, যেটার কাজ বড় যে কোনো রোগের প্রকোপে সাড়া দেয়া এবং সরাসরি, ট্রান্সপারেন্ট যোগাযোগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আদেশ প্রদানের দায়িত্ব পালন করা।

ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে চীনের উহানে অজানা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়ার সাথে সাথে তাইওয়ান ওই অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ সীমিত করে দিয়েছিল এবং যাত্রীদের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিল। এক সপ্তাহ পরে যাদের মধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা গেছে তাদের দ্রুত কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করেছিল।

কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টার
তাইওয়ান এনএইচসিসি’র অন্তর্ভুক্ত সেন্ট্রাল এপিডেমিক কমান্ড সেন্টার বা কেন্দ্রীয় মহামারী নিয়ন্ত্রণ সংস্থা জানুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যেই চালু করা হয়। এর কাজ ছিল মন্ত্রণালয়গুলির মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করে বিভিন্ন নীতি ও কৌশল প্রয়োগ করা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সিইসিসি খুব কম সময়ের মধ্যে ১২৪টি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছিল। এই কাজটা তারা করে ৫ সপ্তাহের মধ্যে। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে তিন থেকে চারটা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছিল তারা। যার মধ্যে বেশ কিছু কার্যক্রমে কয়েকটা এজেন্সির সম্মিলিত সহযোগিতার প্রয়োজন হয়েছিল।

এই কার্যক্রমগুলির মধ্যে ছিল

  • আকাশ ও জলপথে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা
  • আক্রান্তদের চিহ্নিত করা
  • সম্ভাব্য আক্রান্তদের কোয়ারেন্টিনে রাখা
  • সম্পদের বণ্টন পরিচালনা করা
  • নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং
  • মিথ্যা তথ্য চিহ্নিতকরণ
  • পরিবার ও ব্যবসায়ীদের জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করা

১১ মার্চ, ২০২০ তারিখে তাইওয়ানের রাজধানী তাইপের চিয়াং কাই শেক মেমোরিয়াল হলে পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানের পাশে দিয়ে যাচ্ছেন করোনাভাইরাস এড়াতে মাস্ক পরা পর্যটকরা।

বিগ ডেটা ও প্রযুক্তি
বিগ ডেটা বা উপাত্ত এবং প্রযুক্তির সমন্বয় করে তাইওয়ান সরকার অনেক পদক্ষেপ কার্যকর করেছে।

একদিনের মধ্যে তাইওয়ান সরকার জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা প্রশাসন ও ইমিগ্রেশন এজেন্সির ডেটা বা উপাত্তের সমন্বয় করে আক্রান্তদের ১৪ দিনের ভ্রমণের বিবরণ বা ইতিহাস একত্র করেছিল। এছাড়াও নাগরিকদের হাউজহোল্ড রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম এবং ফরেনার এন্ট্রি কার্ড থেকে সংগৃহীত ডেটার মাধ্যমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের সেলফ কোয়ারেন্টিনে পাঠানো এবং মোবাইলের মাধ্যমে তাদের মনিটর করেছিল তাইওয়ান সরকার। কম ঝুঁকিতে থাকা যাত্রীরা যাতায়াতের আগে একটা কিউ আর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের অনুমতিযুক্ত হেলথ ডিক্লেয়ারেশন ফর্ম পেত।

ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে সরকার সব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ফার্মেসিকে রোগীর ভ্রমণ বৃত্তান্ত চেক করার অনুমতি দেয়।

তাইওয়ানের ডিজিটাল মন্ত্রী অড্রে তাং

তাইওয়ানের ডিজিটাল মন্ত্রী অড্রে তাং আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের সাহায্যে উপাত্তকে কাজে লাগিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করতে ডিজিটাল আপডেট তৈরি করেন এবং ফেস মাস্কের স্থানীয় সাপ্লাই কীভাবে দেওয়া হবে তার মানচিত্র তৈরি করেন। তাইওয়ানের ভাইস প্রেসিডেন্ট চেন চিয়েন জেন এক ফেসবুক পোস্টে তাং-এর এই কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, “তিনি শুধু জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার একজন মূল প্রতীকই নন, তিনি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ব্যবহারে দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন।”

তাইওয়ানের ডিজিটাল মন্ত্রী অড্রে তাং আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের সাহায্যে উপাত্তকে কাজে লাগিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করতে ডিজিটাল আপডেট তৈরি করেন এবং ফেস মাস্কের স্থানীয় সাপ্লাই কীভাবে দেওয়া হবে তার মানচিত্র তৈরি করেন।

দ্রুত ও স্বচ্ছ যোগাযোগ
নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও একজন বিশিষ্ট এপিডেমিওলজিস্টসহ উচ্চপদস্থ সরকারি স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত অনলাইনে ভ্রমণ বিষয়ক বার্তা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক নির্দেশ এবং মাস্কের অতিরিক্ত মজুদে কী কী ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিতেন।

এক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা করতে সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রের মানুষ এগিয়ে এসেছে। দেশের সব শপিং মল, দোকান, রেস্টুরেন্ট ও অফিসে আগতদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রদান ও বিল্ডিংয়ে প্রবেশের আগে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়াও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাফলভাবে নিউজ মিডিয়া ও চাইনিজ সাইবার অ্যাটাকের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো নিয়ন্ত্রণ করেছে।

মিনিস্ট্রি অফ ন্যাশনাল ডিফেন্স এর প্রকাশিত একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তাইওয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সের একটি বিমান অবতরণের পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রোটেকটিভ সুট পরে বোর্ডিং ল্যাডার জীবাণুমুক্ত করছে।

সম্পদ বন্টন
ওয়াং জানান, আমদানি বন্ধ করে সরকার নিজেরা উৎপাদন শুরু করেছিল। উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে তারা বিশেষ তহবিলের ব্যবস্থা ও সেনা মোতায়েন করেছিল।

জানুয়ারির শেষ দিকে তাইওয়ানের কাছে ৪৪ মিলিয়ন সার্জিক্যাল মাস্ক, ১.৯ মিলিয়ন এন৯৫ মাস্ক মজুদ ছিল। প্রস্তুত ছিল ১১০০ নেগেটিভ প্রেশার আইসোলেশন রুম। তাইওয়ানের মত এশিয়ান দেশগুলিতে সবসময়ই নিরাপত্তার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই জরুরি অবস্থায় মাস্কের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। যা মেটাতে সরকার উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছিল। মঙ্গলবারে প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন ঘোষণা দেন যে তারা এখন দিনে ১০ মিলিয়ন মাস্ক তৈরি করতে সক্ষম।

শিক্ষা
ইতালি, ইরান, ফ্রান্স, স্পেন এবং যুক্তরাষ্ট্র হাজার হাজার আক্রান্ত রোগী এবং ক্রমবর্ধমান মৃত্যুহার নিয়ে করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারেরা দেরিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমালোচিত হচ্ছেন। শেয়ারবাজারে ধস, স্কুল কলেজ বন্ধ, বড় বড় অনুষ্ঠান বাতিল এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের টেস্টিং সিস্টেমের ব্যর্থতা মেনে নেয়া—এসব কিছুর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ খারাপের দিকে যাওয়া এই প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।

তাইওয়ানের চেয়ে ১৩ গুণ বড় যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশগুলি এই একই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা জানতে চাইলে ওয়াং বলেন—অবশ্যই পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের সামর্থ্য ও ক্ষমতা অনেক বেশি। বড় বড় টেক কোম্পানিগুলি, গভর্নর, ফেডারেল এজেন্সিগুলি মিলে যদি একসাথে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, তাহলেই এটা সম্ভব।

তাইওয়ান ২০০৩ সালের সার্স প্রাদুর্ভাবের সময়ে করা ভুলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়েছে। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জরুরি অবস্থা নিয়ন্ত্রণের কৌশলকে এবার তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। সেকারণেই অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা দ্রুততার সাথে এই সংকট মোকাবেলায় বিভিন্ন কার্যকর নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভাইরাসের বিস্তার রোধ ও মৃত্যুহার কমাতে পেরেছে।

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই-এর মতে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাদের একতা ও সহনশীলতা। সরকার, জনগণ ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার সমন্বয়ের কারণেই উৎপাদন ব্যবস্থা বৃদ্ধি করা গেছে এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। ব্রুক-এর মতে তাইওয়ানের টু-পার্টি সিস্টেম যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র‍্যাট ও রিপাবলিকানদের মতোই বিভক্ত। কিন্তু তারা এই সংকটের সামনে আমলাতন্ত্রকে বিকল করে একত্রে কাজ করেছে এবং এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। এটাই পুরো পৃথিবীর জন্য শিক্ষা।

অনুবাদ. জোহানা আফরিন নিশো