আমাদের জীবনের অধিকাংশ সময় খরচ হয় অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায়। নবীন ব্যবসায়ীরা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীকে রাজি করাতে গিয়ে আর চাকরিজীবীরা বসকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে কার্যকর পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে প্রচুর সময় নষ্ট করেন।

মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে তথ্য গ্রহণ করে এবং কীভাবে তার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সে ব্যাপারে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। লেখক, সাংবাদিক ও বিনিয়োগকারী বেন পার বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে ৭টি উপায় নির্ধারণ করেছেন। এগুলিকে তিনি বলেন ‘আকর্ষণের ট্রিগার’। এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছেন তার বই ‘ক্যাপটিভোলজি—মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের বিজ্ঞান’-এ। উল্লেখ্য, বেন ম্যাশেবল পত্রিকায় সহ সম্পাদক হিসাবে এবং সি-নেট-এ কমেন্টেটর হিসেবে কাজ করেছেন। ফোর্বস পত্রিকায় অনুর্ধ্ব ত্রিশের সফল ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেন-এর নামও নেয়া হয়েছে।  নিচে সেই ৭টি উপায় বা ‘ট্রিগার’ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

১. অটোমেটিসিটি—‪অনুভূতি সক্রিয় করুন

পার বলেন, কোনো নির্দিষ্ট দৃশ্য, শব্দ , রঙ এবং ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপিত করে এমন জিনিসের প্রতি আমরা অবচেতনভাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনোযোগ দেই। এর কারণ সেগুলি তাদের আশেপাশের জিনিসের চেয়ে আলাদা এবং আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাথে তাদের সম্পর্ক আছে। যেমন ভিড়ের রাস্তায় কালো বা বাদামি রঙের জুতার মাঝখানে কাউকে যদি দেখেন হলুদ জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটছে, তার দিকেই চোখ যায়।

ভোক্তারা কোন ব্র্যান্ড কীভাবে নিবেন তা খানিকটা নির্ভর করে সেই ব্র্যান্ডের কর্পোরেট লোগোর রঙের ওপর। লাল রঙ ঘনিষ্ঠতা এবং আগ্রাসী ভাব বোঝাতে পারে, নীল রঙ বোঝাতে পারে স্বস্তি এবং নির্মলতা, হলুদ রঙ শক্তি ও সজীবতা।

আপনার শরীরের তাপমাত্রা নির্ধারণ করে দিতে পারে আপনি অন্য আরেকজন মানুষকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।

২০০৮ সালের একটি গবেষণায় লরেন্স ই. উইলিয়ামস (লিডস স্কুল অফ বিজনেস, কলোরাডো ইউনিভার্সিটি, বোল্ডার) এবং জন এ. বার্গ (ডিপার্টমেন্ট অব সাইকোলজি, ইয়েল ইউনিভার্সিটি, নিউ হ্যাভেন, কানেকটিকাট) দেখেন যে যাদের হাতে গরম কফির কাপ থাকে তারা সাধারণত অপরিচিত লোককে ভালো স্বভাবের এবং ভদ্রলোক বিবেচনা করেন, কিন্তু যারা ঠাণ্ডা বা আইসড কফির কাপ ধরে রাখেন তারা এই ক্ষেত্রে কিছুটা বিপরীত আচরণ করেন।

তারা গবেষণায় আরো দেখেন যে গরম কোনো বস্তু ধরে রাখলে মানুষ নিজেকে আরো বেশি ভদ্রভাবে উপস্থাপন করে। সুতরাং আপনি যদি কারো সাথে প্রথমবার কোনো মিটিং করতে যান, চেষ্টা করুন গরম কফি খেতে খেতে আলাপ সারতে। আর যদি কোনো কিছুর মীমাংসা চান বা নেগোশিয়েট করতে যাচ্ছেন, তবে আইসড কফি বেছে নিন।

‘কীভাবে বন্ধুদের জয় করবেন এবং লোকজনকে প্রভাবিত করবেন’ বইয়ে ডেল কার্নেগি যা বলেছেন, তা মেনে চলার চেষ্টা করুন: “মনে রাখবেন কোনো ব্যক্তির নাম সেই ব্যক্তির কাছে যে কোনো ভাষায়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মধুরতম শব্দ।”

 

২. ফ্রেমিং—‪আপনার বক্তব্যকে আবেদন হিসাবে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপন করুন

উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিইয়েট্রাম স্কেউফেল বেন পারকে তার বইয়ের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাদের কাছে আগে থেকেই যে রেফারেন্স থাকে তা ব্যবহার করে আমরা তথ্য পর্যালোচনা করে থাকি।

ডেভিড ম্যাকনিউ/ গেটি এ’র বিখ্যাত গবেষণায় দেখা গেছে একটি গাড়ি দুর্ঘটনার ভিডিও দেখেছে এমন কিছু দর্শককে সেই দুর্ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ধরন দুর্ঘটনাটি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল।

পার বলেন, আমাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা, জৈবিক ক্রিয়া, সাংস্কৃতিক প্রত্যাশা, আগ্রহ, মতামত এবং কোনো নির্দিষ্ট সময়ে মুডের অবস্থা আমাদের রেফারেন্সের ফ্রেমগুলিকে বা আমরা কী মতামত দিব তাকে প্রভাবিত করে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের পছন্দ তৈরি হয় অথবা কোনো কিছুর প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কোনো পছন্দ বা প্রতিক্রিয়া একদম শূন্য বা ফাঁকা অবস্থা থেকে তৈরি হয় না।

ফ্রেমিং-এর সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রটি এসেছে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এলিজাবেথ লফটাস এবং জন পালমারের করা ১৯৭৪ সালের গবেষণাতে। এই গবেষণায় বিভিন্ন দলে বিভক্ত অংশগ্রহণকারীদের একটি গাড়ি দুর্ঘটনার ভিডিও দেখতে দেওয়া হয়েছিল এবং ধারণা করতে বলা হয়েছিল গাড়ি কত দ্রুত যাচ্ছিল।

প্রতিটি গ্রুপকে একই ভিডিও দেখানো হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন দলকে যে প্রশ্ন করা হয় তাতে একটি ক্রিয়াপদের পরিবর্তন ছিল। যেমন, গাড়িগুলি কত দ্রুত যাচ্ছিল যখন তারা সংঘর্ষ ঘটে/ ধাক্কা খায়/ চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়/ একটি আরেকটির কাছে আসে—ইত্যাদি।

যে দলটি ‘চূর্ণ-বিচূর্ণ’ শব্দটি শুনেছিল, তারা গাড়িগুলির সর্বোচ্চ গতির কথা বলে। এক সপ্তাহ পরে যখন আবার প্রতিটি দলকে জিজ্ঞেস করা হয় ভিডিওটিতে কোনো কাচ ভাঙার দৃশ্য ছিল কিনা, যে গ্রুপটির কাছে শুরুর দিন ‘চূর্ণ-বিচূর্ণ’ ব্যবহার করা হয়েছিল তাদের বেশিরভাগ সদস্যই মনে করতে পারে কাচ ভাঙার দৃশ্য ছিল, কিন্তু আসলে ভিডিওতে কাচ ভাঙার কোনো দৃশ্য ছিলই না।

 

৩. বিঘ্ন – প্রত্যাশা ভেঙে দিন

বেন পারের মতে আমাদের আশা আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশার চেয়ে অন্যরকম কিছু আমাদের মনে বেশি দাগ কাটে। যা যত বেশি আমাদের প্রাত্যাহিকতায় বিঘ্ন ঘটায় তার প্রতি তত বেশি মনোযোগী হয়ে উঠি আমরা। বুদ্ধিজীবীরা এর নাম দিয়েছেন ‘এক্সপেক্টেন্সি ভায়োলেশন থিওরি’।

ধরেন এমন কারো সাথে দেখা হলো কোথাও, সবাই যার মনোযোগ চাইছেন। কোন সুন্দরী মেয়ে হতে পারে, নামকরা কেউ হতে পারে। আপনি তার উপস্থিতি তেমন গ্রাহ্য করলেন না। এই না করা তার স্বাভাবিক প্রত্যাশা ভেঙে দেবে এবং আপনার প্রতি তাকে মনোযোগী করে তুলবে।

প্রত্যাশা ভাঙার বিষয়টা অবশ্য ইতিবাচক নেতিবাচক দুইভাবেই কাজ করতে পারে। বেন পারের মতে বস, কলিগ বা ক্লায়েন্টদের সাথে ইতিবাচকভাবে এরকম অপ্রত্যাশিত ব্যবহার বেশ কাজে দিতে পারে। পশ্চিমা কর্পোরেটগুলিতে একটা কথা বেশ শোনা যায় ‘আন্ডার প্রমিজ অ্যান্ড ওভার ডেলিভার’। মানে হলো যখন কিছু করার কথা দিবেন তখন যা আপনি করতে পারেন তার চেয়ে কম করে বলবেন, করার সময় বেশি করে করলে প্রত্যাশার বেশি দিতে পারা যায় এবং তাতে অপর পক্ষের আস্থা অর্জন সম্ভব হয়। যে কোনো বিষয়েই সবাই যা করবে বা ভাববে তার বাইরের কিছু করলে অন্যদের মনোযোগ পাওয়া যায়।

হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ পোস্টে পার বলেন, কারো প্রত্যাশা ভেঙে দেওয়ার জন্য অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করুন, কোনো কঠিন ডেডলাইনের মধ্যে কাজ সমাধান করুন, অথবা কফির জন্য আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে একসাথে হাঁটার আমন্ত্রণ জানান, এতে আপনার বস বা কলিগ বা ক্লায়েন্টদের কাছে থেকে কাজ বা সুবিধা আদায় করে নিতে পারবেন।

 

৪. পুরস্কার—‪ইচ্ছা তৈরি করুন

পার বলেন তার গবেষণায় তিনি জেনেছেন যে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের ড. কেন্ট ব্যারিজের মতে মস্তিষ্কে ডোপামাইনের প্রবাহ আসলে খুশির তুলনায় বেশি ইচ্ছা বা উদ্দীপনা তৈরি করে থাকে।

ব্যারিজ একটি গবেষণায় দেখেছেন যে ডোপামাইন সরিয়ে নেওয়ার পরেও ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরদের চিনির পানি দেওয়ায় তারা খুশি অনুভব করতে পেরেছিল, কিন্তু তারা পুরস্কার অর্জনের ইচ্ছা এবং উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলে, ফলে তাদের অনেকেই মারা যায়।

এর অর্থ হলো আপনার কারো মনোযোগ সম্পূর্ণভাবে পেতে হলে আপনার উচিৎ তাকে পুরস্কার এবং প্রণোদনা দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করা।

উদাহরণ হিসেবে পার বলেন, একজন ম্যানেজার তার সবচেয়ে মেধাবী কর্মচারীদের পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে তাদের কাজের স্পৃহা ধরে রাখতে পারেন। পুরস্কারের পাশাপাশি তাদের প্রনোদনা ও নতুন নতুন চ্যালেন্জও দিতে পারেন।

 

৫. সুনাম—‪বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করুন

পার বলেন, বিশ্বাসযোগ্য উৎস হতে আসা জিনিসে আমরা প্রচুর মনোযোগ দেই এবং সেগুলিকে বাধ্যতামূলকভাবেই গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখি।

আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির রবার্ট সিয়ালিডিনি বলেন, মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো সরাসরি বাধ্যতামূলক জায়গা থেকে এলে সে জিনিসের কর্তৃত্ব কোনো রকম প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেওয়া।

২০০৯ সালে এমোরি ইউনিভার্সিটির গ্রেগ বার্নসের করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যখন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা উপদেশ দেন তখন উপদেশ গ্রহণকারীর মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অংশটুকু বন্ধ হয়ে যায়, তারা পরামর্শকেই ফ্যাক্ট বা বাস্তবতা বলে ধরে নেয়।

তাই কাউকে কনভিন্স করতে প্রথমে প্রয়োজন আপনার কথা বিবেচনা করার আগেই যেন সে মেনে নেয়। এই কারণেই বিনিয়োগকারীরা এখন কিকস্টার্টারের মত সাইটগুলিতে বিনিয়োগ করছে, কারণ এগুলি নিজেদের কনসেপ্ট প্রমাণ করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকির দুশ্চিন্তা কমিয়ে আনছে।

 

৬. রহস্য—‪কিছু জিনিস অসম্পূর্ণ রাখুন

মাঝে মাঝে এমন হয় না যে একটা বই মাঝপথে ফেলে কিছুতেই ঘুমাতে যাওয়া যাচ্ছে না? কিংবা লস্ট বা গেম অব থ্রোনস-এর মত টিভি সিরিয়াল একের পর এক এপিসোড দেখে দেখেও মন ভরছে না?

আমাদের মস্তিষ্ক অসমাপ্ত গল্প বা কাজ মনে রাখে। এর একটা বৈজ্ঞানিক নামও আছে—এক রাশিয়ান মনোবিজ্ঞানীর নামে, তিনিই প্রথম এর উদ্ঘাটন করেছিলেন—’জাইগারনিক’ ইফেক্ট। আমরা অনিশ্চয়তাও অপছন্দ করি আর সব রকম ভাবে চেষ্টা করি অনিশ্চয়তা কমানোর। এই বিষয়টাও মনোযোগ আকর্ষণে কাজে লাগানো যায়।

কারো পাত্তা পাওয়ার জন্য কিছুটা রহস্য রেখে দিন নিজের কাছে। সবটুকু বলে দিয়েন না, কিছুটা বাকি রাখেন।

অফিসের কাজেও এই ব্যবস্থা কাজে আসতে পারে। জন লেভির মতে কোনো জরুরি মিটিং-ও ৪৫ মিনিটের চেয়ে বেশি লম্বা হওয়া ঠিক না। মিটিং-এর শেষে কিছু অনিশ্চয়তা বা কিছু বিষয় অমীমাংসিত রেখে দেয়া উচিৎ পরের মিটিংয়ে আলোচনার জন্য।

এইভাবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আগ্রহ বজায় রাখা যাবে।

 

৭. স্বীকৃতি—‪আপনার শ্রোতাদের আত্মপরিচয়ে অবদান রাখুন

বেন পারের সাথে এক আলাপে মিডিয়া নৃবিজ্ঞানী ড. টমাস ডি জেঙ্গোটিটা বলেছিলেন তিনি স্বীকৃতিতে বিশ্বাস করেন।

পার বলেন, মনোযোগ আকর্ষণের সবচেয়ে সেরা উপায় হলো, আপনার শ্রোতাদের মধ্যে একটি কম্যুনিটির অনুভূতি তৈরি করা। কারণ মানুষের সহজাত প্রবণতা হলো সে তার পরিচয়ের স্বীকৃতি চায়, সে নিজের স্বীকৃতি চায়।

সমস্ত ম্যামাল বা স্তন্যপায়ী প্রাণীই চায় মনোযোগ, কেবল মানুষ চায় স্বীকৃতি। সে চায় কোনো একটা সমাজ বা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হতে যা তার প্রতি যত্নশীল থাকবে।

আপনি কারো মনোযোগ চাইলে তার প্রতি যত্নশীল হন, তাকে বুঝতে চেষ্টা করেন এবং তার কাজের স্বীকৃতি দেন, দেখবেন আপনিও তার কাছ থেকে এসব ফেরত পাচ্ছেন।

একারণেই গুগল এবং সেলসফোর্সের মত কোম্পানিগুলি কর্মচারীদের এমন ভাতা প্রদান করে, কারণ এর ফলে তাদের মেশিনের অংশ নয়, আলাদাভাবে ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এতে বেশি মেধাবীরা এবং দুর্দান্ত প্রতিযোগীরা আকর্ষিত হয়।

এই তথ্য-প্রযুক্তির যুগে মনোযোগ বা আকর্ষণের বিজ্ঞান বুঝতে পারাটা সাফল্যের পূর্বশর্ত। যারা এই সাতটি ট্রিগার সফলভাবে ব্যবহার করতে পারেন অন্যের মনোযোগ আকর্ষণে তারা সফল হতে পারেন।