খাবার মোড়ানোর জন্য যে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হয় সেটি কম ঘনত্বের পলিথিন দিয়ে তৈরি। এই প্লাস্টিকে প্লাস্টিসাইজার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মত রাসায়নিক পদার্থ থাকে। অনেক সময় ধরে রাখা হলে বা উচ্চ তাপমাত্রায় থাকলে এই প্লাস্টিকের কণা ও রাসায়নিক খাবারে মিশে যেতে পারে।
প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কমানোর উদ্দেশ্যে মানুষ প্লাস্টিক ব্যবহার শুরু করেছিল। বর্তমানে প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি কোণে এর অস্তিত্ব তো খুঁজে পাওয়া যায়ই, এমন সব জায়গায়ও প্লাস্টিকের দেখা মিলছে যেটা আমাদের জন্য ক্ষতিকর, যেমন খাবারে।
আপনি হয়ত ভাবছেন কীভাবে প্লাস্টিক খাবারে ঢুকে পড়ছে। ঘরে ব্যবহার করা প্লাস্টিকগুলির দিকেই একটু লক্ষ্য করুন। খাবার রাখার বক্স ও কন্টেইনার থেকে শুরু করে প্লাস্টিক র্যাপ, এত বেশি ব্যবহৃত হয় যে এগুলির বদলে অন্য কিছু ব্যবহারের কথা ভাবতেও পারি না আমরা। খাবার প্লাস্টিকে মুড়িয়ে রাখলে জীবাণু এবং অক্সিডেশন থেকে হয়ত রক্ষা করা যায়, কিন্তু এর কিছু সমস্যাও আছে।
খাবার মুড়িয়ে রাখার জন্য প্লাস্টিক
থার্মোপ্লাস্টিক ও থার্মোসেট, প্লাস্টিককে এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। থার্মোপ্লাস্টিকে তাপ দিলে সেটি আবার তার আগের আকারে ফিরে যায়। অন্যদিকে, থার্মোসেট একবার গরম করলে সেটি একটি স্থায়ী আকার ধারণ করে। এতে বোঝাই যাচ্ছে খাবারের মোড়ক হিসেবে সবচেয়ে পছন্দনীয় পলিমার হচ্ছে থার্মোপ্লাস্টিক।
আগে খাবার মোড়ানোর জন্য প্রধান পলিমার ছিল পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি (একধরনের থার্মোপ্লাস্টিক)। কিন্তু পরিবেশগত ক্ষতির ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে খাদ্যপণ্য মোড়ানোর জন্য অন্যান্য পলিমারের ব্যবহার শুরু হল।
বর্তমানে, কম ঘনত্বের পলিথিন (LDPE) খাবার মোড়ানোর জন্যে বেশি জনপ্রিয় কারণ এটি ওজনে হালকা এবং ভালভাবে প্রসারিত হয়। বাতাস ও জীবাণুর জন্য বাধা হিসেবে কাজ করে এবং খাবারকে পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।
প্লাস্টিকের মোড়কের সাথে খাবারের মিথষ্ক্রিয়া
প্লাস্টিকের মোড়ক আর খাবারের মাঝে তিন ধরনের যোগাযোগ হয়: Sorption, Migration ও Permeation।
Sorption বলতে বোঝায় খাবারের উপাদানগুলি প্লাস্টিকের মোড়কে প্রবেশ করার প্রক্রিয়া। এর ফলে খাবারের আর্দ্রতা কমে যায়। ফ্যাট (লিপিডও বলা হয়) লিপোফিলিক প্লাস্টিকে শোষিত হতে পারে (একধরনের প্লাস্টিক যেখানে চর্বি দ্রবীভূত হয়)।
Migration বলতে বোঝায় প্লাস্টিকের উপাদানের খাবারে প্রবেশ করাকে। খাবারের তুলনায় পলিমারে অ্যাডিটিভ বা সংযোজক দ্রব্যের (বিশেষ উদ্দেশ্যে অল্প পরিমাণে সংযোজিত পদার্থ, যেমন রঞ্জকদ্রব্য) ঘনত্ব বেশি। যার ফলশ্রুতিতে প্লাস্টিকের কিছু অংশ খাবারে প্রবেশ করে।
Permeation হল দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। এতে প্লাস্টিক প্যাংকেজিং এর মাধ্যমে খাবার ও প্লাস্টিকের মাঝে গ্যাস ও তরলের আদান-প্রদান ঘটে। এটি খাবারকে শুকিয়ে ফেলতে পারে এবং খাবারে জীবাণু প্রবেশে সাহায্য করতে পারে।
প্লাস্টিক মোড়কের ঝুঁকি
প্লাস্টিক বিভিন্ন অনুঘটক বা ক্যাটালিস্ট ও সংযোজক দ্রব্যের পলিমারাইজেশন বিক্রিয়ার ফলাফল। প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত এই ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থগুলিই খাবারের সাথে লেগে থাকে।
আরো ব্যাখ্যা করলে, পলিমারাইজেশন প্রায়ই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তখন প্লাস্টিক পলিমারের ক্ষুদ্র অংশগুলি, যাদের নাম মনোমার ও অলিগোমার, খাবারে প্রবেশ করে।
প্লাস্টিকের নমনীয়তা বাড়াতে প্লাস্টিসাইজার ব্যবহার করা হয়। যার আণবিক ওজন ৩০০ বা তার বেশি। এগুলি পলিমারের ফাঁকা জায়গাগুলি দখল করে থাকে।
বর্তমানে DEHA, Di-(2-Ethylhexyl) প্লাস্টিক র্যাপে ব্যবহৃত প্রধান প্লাসটিসাইজার। গবেষণায় দেখা গেছে, ডিইএইচএ খাবারের সাথে যত বেশি সময় লেগে থাকে এবং যত উচ্চ তাপমাত্রায় থাকে, তত বেশি খাবারে মিশে যায়।
পলিথিন এক ধরনের পালঅলিফিন, এটি একটি অপরিপৃক্ত হাইড্রোকার্বন। এই প্লাস্টিকটি হচ্ছে লিপোফিলাইক, এবং এটি খাবারের পৃষ্ঠ থেকে চর্বি শোষণ করে। এই প্রক্রিয়া (সোর্পশন) খাবারের গন্ধ এবং গঠন বদলে দিতে পারে।
যদি প্লাস্টিকের আবরণটি অনুভেদ্য হয়ে থাকে তাহলে সেই খাবারে অক্সিজেনও প্রবেশ করতে পারবে। অক্সিজেন চর্বিযুক্ত খাবারে র্যান্সিডাইটির (র্যান্সিড) সৃষ্টি করতে পারে। র্যান্সিড খাবারে চর্বি বিক্রিয়া অসম্পূর্ণ করে। যার ফলে খাবারে ভিন্ন স্বাদ এবং দর্গন্ধ তৈরি হতে পারে। এমনকি এটি খাবারে ক্ষতিকারক উপজাতকও তৈরি করতে পারে।
প্লাস্টিকের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি মোড়ক করা খাবারে বিভিন্ন অক্সিডেটিভ প্রতিক্রিয়াকে রোধ করে। অ্যারিলামাইন এবং ফেনোলের মতো রাসায়নিক পদার্থ সাধারণত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তবে, এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি তাপমাত্রা এবং চর্বির পরিমাণ বেশি থাকলে পলিমার থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। যার ফলে প্যাকেজযুক্ত খাবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়।
সামপ্রতিক বছরগুলিতে, খাদ্যের প্যাকেজিংয়ের জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিকে সুরক্ষামূলক বায়োফিল্ম এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়োফিল্ম এর মাধ্যমে খাবার ও প্লাসটিক এর সংস্পর্শে বাধা তৈরি করা হয়। তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে এই ফিল্মগুলিরও কিছু উপাদান অস্থিতিশীল এবং কিছু উপাদান খাবারেও ছড়িয়ে পড়ে।
প্লাস্টিকের মোড়ক নিরাপদ ভাবে কীভাবে ব্যবহার করবেন?
খাবারের শেল্ফ লাইফ বৃদ্ধি এবং খাবার অপচয় কমানোর ক্ষেত্রে প্লাস্টিক খুব ভাল কাজ করে। সঠিক ভাবে প্লাস্টিক খাবারের মোড়কিকরনের জন্য ব্যবহারের কিছু উপায় আছে।
খাবার ও প্লাস্টিকের মোড়কের মাঝে একটু জায়গা রেখে দিন। মোড়কটি যেন খাবারের সাথে না লাগে তা নিশ্চিত করুন।
গরম করার সময় খাবার মোড়ক থেকে মুক্ত করে নিন।
উপসংহার
প্লাস্টিক সব ঘরে ঘরে, সব শিল্পে এখন সর্বজনীন পলিমার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। খাদ্যের মোড়ক তৈরিতে বর্তমানে এলডিপিই মূল পলিমার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর সংশ্লেষণ এর জন্য পলিমারাইজেশন এবং বিভিন্ন রসায়নিক প্রক্রিয়াজাতকরণ এর প্রয়োজন। এই রাসায়নিকগুলি, যেমন প্লাস্টিসাইজার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, খাবারের সাথে সংস্পর্শে এসে খাবারের মান কমিয়ে দেয়। এছাড়াও, পলিমারাইজেশন প্রতিক্রিয়ায় সবসময়ই মোনোমার এবং অলিগোমার এর মত অনু খাবারে ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
সম্প্রতি বায়োফিল্ম দিয়ে খাবার ঢাকার বিষয়টি আলোচনায় আসছে। বায়োফিল্ম খাবারকে সরাসরি প্লাস্টিক এর সংস্পর্শ থেকে বিরত রাখে। কিন্তু যেকোনো বায়োফিল্ম দ্বারা তা সম্ভব না। কিছু কিছু বায়োফিল্মই খাবারকে নিরাপদ রাখতে পারে। আবার কিছু ফিল্মের খাবারের মধ্যে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে খাবারে চর্বি বেশি থাকে খাবার মোড়ানোর জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিকগুলি সেই খাবারের সাথে বেশি মিশে যায়। আরো ভয়ের বিষয় হল, গরম করার সময় যদি খাবার প্লাস্টিক এর স্পর্শে থাকে তখন খাবারে প্লাস্টিক এর মিশ্রণ আরো বেড়ে যেতে পারে। তাই, প্লাস্টিক মোড়ানো খাবার যদি আপনি গরম করতে চান বা মাইক্রোওয়েভে দিতে চান, তাহলে প্লাস্টিক আলাদা করে এগুলি করাই ভাল।