মনে আছে সেই টুনটুনি পাখিটার কথা? আচ্ছা ধরা যাক ওটা টুনটুনি পাখি নয়, হয়তো চিলই। মুখে রাজার মুদ্রা নিয়ে উড়ে গিয়ে নিজের বাসায় পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট বড় টুনটুনি নয়। চিল হলে সুবিধা হয় বুঝতে। রাজার স্বর্ণমুদ্রার ভাণ্ডার থেকে সে একখানা মুদ্রা মুখে নিয়ে নিজের বাসায় রেখে দিল। তারপর রাজাকে টিপ্পনি কাটতে কাটতে সে বলতে থাকত “রাজার ঘরে যে ধন আছে, আমার ঘরেও সে ধন আছে।” এখন এই প্রশ্ন দেখা দিতেই পারে যে রাজার স্বর্ণমুদ্রা পর্যন্ত পাখি গেল কীভাবে! স্বর্ণমুদ্রা তো আর তাঁতের শাড়ি না যে রোদে দিয়েছিলেন রাজা। তো, যদি পাখি সোনার মোহর মুখে তুলে নেবার সুযোগ পায়, তাহলে টুনটুনিও হতে পারে। হোক!

রাজার ঘরে যে ধন আছে, সেই ধন নিজ ঘরে রাখার যে বাসনা সেটাও শ্রেণী বোঝাবুঝির একট অমোঘ পাঠ হবে। আবার সেই বাসনাটাই কেবল নয়, বাসনা পূরণ করতে পারাটাও একটা শ্রেণী-লক্ষণ। আবার কখনো কখনো বাসনাপূরণ আর বাসনা কোনটা যে শ্রেণী বুঝতে বেশি সহায়তা করছে তাও গুলিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে, বাসনাটা উপযোগের নাকি মর্যাদা অর্জনের নাকি উপযোগ আর মর্যাদাবোধ দুয়েরই সেসবও মেলা সব ভেজাল বাঁধিয়ে দেবে। তার মানে হচ্ছে, অত্যন্ত পেঁচালো এক বিষয় এটা হতে পারে।

অনেক ছোটবেলায় আমি ঈদের ক’দিন আগে, যে বাসায় ভাড়া থাকতাম বাবা-মায়ের সঙ্গে, সেই বাসার পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। দু’জন আমার থেকেও ছোট শিশু একজনের গলায় একজন হাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন কথা বলতে-বলতে। সম্ভবত ভাইবোন হতে পারেন। যদি পোশাক দেখে সিদ্ধান্ত নিতে বলেন তাহলে হয়তো দিনমজুর কোনো বাবামায়ের বাচ্চাই বলব। এখন যে আলাপ তাঁরা করতে-করতে যাচ্ছিলেন, যেটা এই এত বছর পরও মনে আছে আমার, তা হলো: “পরশু হবে ঈদ, আমরা হালুয়া আর পুলুয়া খাবো।”

ঈদের তাৎপর্য বোঝার জন্য এমনিতেও আমার অনেক বয়স তখন হয়নি। উপরন্তু আমি একটা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকে কেবল নতুন এলাকায় এসেছি। সব মিলিয়ে ঈদের কারণে এতদিন পর এটা মনে নেই। আছে হালুয়া আর পুলুয়ার কারণে। ওদিকে পোলাও আমার পরিচিত হলেও, হালুয়া সদ্য পরিচিত হতে শুরু করেছে। অন্তত আমি যে ক’বছর বরগুণাতে ছিলাম, আর যাদের মাঝে ছিলাম, হালুয়া কোনো চলতি মিঠাই ছিল না। আমি জিনিসটাকেই চিনি মেহেরপুর গিয়ে। যাহোক, এই সদ্যচেনা মিঠাই আর পোলাওয়ের সম্ভাবনার কথা বলতে বলতে যে দু’জন আমার থেকেও ছোট শিশু রাস্তায় হাঁটছিলেন, তাঁদের সেই আনন্দ-লোভ-অপেক্ষা-পরস্পরের সম্পর্ক এই এতকাল পরে যে মনে আছে তার কারণ শ্রেণীর বাসনা। বাহ্যত তুচ্ছ দুই পোলাও আর হালুয়া! অথচ এক দুর্দান্ত স্টেটমেন্ট। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এইসব ওই শিশুত্বের ভেজাল। হয়তো আপনি অনেক ভুল ভাবছেন না। কিন্তু এটাও তো ঠিক গাদা গাদা শিশু আপনারা দেখেছেন, পেলেছেন। সকলেই পুলুয়া-হালুয়ার অনাগত দিনটির বাসনা করতে-করতে রাস্তা দিয়ে হাঁটেন না।

তো, বাসনা দিয়ে আমরা শ্রেণীর একটা রূপরেখা বুঝে ফেলতে পারব। কিন্তু উপযোগের জায়গায় গুরুত্ব দিলেন তো আরেক ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছেন। আপনি ভাবলেন, পুলুয়া আর হালুয়ার বাসনা! যাঁর উদরপূর্তি নিয়মিত ঘটে তিনি এক শ্রেণী, যাঁর বাসনা ভেসে বেড়ায় তিনি আরেক শ্রেণী। ব্যস, বুঝে ফেলেছেন! আসলে একেবারেই ভুল করে ফেললেন। নিয়মিত উদরপূর্তি দিয়েও সহজে কোনো শ্রেণীর সীমা বুঝবেন না। উপযোগের ঊর্ধ্বে যেতে হবে আপনার। এখানেই ব্র্যান্ডের কারুকাজ।

ব্র্যান্ড বললাম বটে। বাস্তবে কনজুমারের রুচির প্রশ্ন, সূক্ষ্ম জ্ঞানের প্রশ্ন, ঠিকঠাক ব্র্যান্ড সামলানির প্রশ্ন। তাছাড়া খাদ্যদ্রব্য-ট্রব্যে ব্র্যান্ড এমনিতেও ভোগ্যপণ্যের তুলনায় মিহিবস্তু। ব্র্যান্ড দিয়ে একটু বিস্তৃত কিছুই আমরা বুঝব। ধরুন, মমিন সাহেব সপরিবারে দাওয়াত খেতে গেছেন সলিম সাহেবের বাড়িতে। এখানে মেজবান ও মেহমান দুজনেরই নাম পুরুষ নিলাম, কারণ ধরে নিন এঁরা পরস্পর পরিচিত। তো সলিম সাহেবের স্ত্রী নিজে বেড়ে খাওয়াচ্ছেন। খুবই আদর করে বাচ্চাদের পাতে দিচ্ছেন। লিঙ্গ ও বাৎসল্য বিন্যাসে যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। তো তিনি মমিন সাহেবের ছেলেমেয়ের পাতে পাবদা মাছের দোপেঁয়াজি তুলে দিতে-দিতে, আদরের অংশ হিসেবেই, প্রশ্ন করে বসলেন “বলো তো আম্মু, কী মাছ খাও?” এখন একটা গুরুতর শ্রেণীসংঘাত দেখা দিতে পারে। আপনাদের অনেকেই হয়তো মানতে চাইবেন না। বলবেন এ হলো গিয়ে স্ট্যাটাস, মর্যাদা, খান্দান। বহু আগে ওয়েবার সাহেব এসব বুঝিয়ে গেছেন! কিন্তু জনাব, মার্ক্স আর ওয়েবারের মধ্যে বনাম-বনাম বাঁধিয়ে, পেজগি লাগিয়ে আপনার শ্রেণী বুঝতে কোনো ফায়দা নেই। এটা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফুটবল ময়দান নয়।

ওহো, ওই উদাহরণ তো শেষ হলো না। তো মমিন সাহেবের কন্যা খাবার মধ্যে চাচিজানের এই সস্নেহ প্রশ্ন কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারল না। সে খাওয়া থামিয়ে মাছের দিকে একবার, ভাইয়ের দিকে একবার, বাবার দিকে একবার আর প্রশ্নকারী চাচির দিকে (মানে সলিমপত্নী) একবার তাকাতে শুরু করেছে। এমনিতে এমন কিছু সময় তাতে লাগবার কথা নয়। কিন্তু এতেই মমিন সাহেবের বুক ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করেছে। তিনি স্ত্রীর দিকে, মানে নিজের স্ত্রীর দিকে, প্রথমত কাতর, পরের দিকে বিহ্বল, এবং পরিশেষে অহেতু-ক্রোধ নিয়ে তাকাতে শুরু করেছেন। সবই কিন্তু এই সামান্য কয়েক সেকেন্ডেই ঘটে চলেছে। মমিন সাহেবের স্ত্রীও অসহায়ভাবে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ফেলতে পারেন। যদি এই মেহমান পরিবারের এই কয় সেকেন্ডের তাকাতাকি মেজবান পরিবার পরস্পর লক্ষ্য করে থাকেন, না করার কোনোই কারণ নেই যদিও, তাহলে তাঁরাও পরস্পর তাকাবেন। শিশুরা বাদ থাকলেও শিশু পিতামাতাসমূহ তাকাবেনই। এবং, আপনারা নিশ্চিত হতে পারেন যে তাঁদের তাকানিতে ওইসব অনুভূতিরাশি নাই যা সলিম-পরিবারের সদস্যদের রয়েছে তখন। তো মমিন সাহেব যখন দুর্ঘটনাটা না ঘটুক আপ্রাণ প্রার্থনা করে চলেছেন ‌তখন তাঁর কন্যা একগাল হাসি দিয়ে, আবিষ্কার করার বিজয়ী ভঙ্গিসমেত, ঘোষণা দিয়ে ফেললেন “জানি তো চাচি/আন্টি, এটা হলো ট্যাংরা মাছ।” তো ওদিন স্বশ্রেণীর আন্দাজ করে যে দুই পরিবার দাওয়াত প্রদান ও গ্রহণ করেছিলেন, তা ওই পাবদাকে ট্যাংরা বলার পর পুরাপুরি ভ্যাবদা মেরে গেল। মানে সেটাই হবার কথা।

বাসায় ফিরবার সময় মমিন সাহেবের থমথমে মুখ। “এত কিছু কিনে খাওয়াই তোমার ছেলেমেয়েদের, অথচ লোকজনের সামনে ইজ্জতটা তো গেল ঠিকই।” এই ধরনের কিছু কথাবার্তাও তিনি স্ত্রীকে শোনাতে শোনাতে আসতে পারেন বাসায়। এই বিষয়টাকে দয়া করে লঘু করে দেখবেন না। দুনিয়ায় এত ভোগ্যপণ্য বাদ দিয়ে, এমনকি রাশি রাশি বৈশ্বিক খাবার পাবার কালে দুইটা দেশি মাছের উদাহরণে যা আমরা হাজির করলাম তার গুরুত্ব একদমই কম নয়। আর মমিন সাহেবের ইজ্জত প্রসঙ্গকে নিছক মর্যাদা-টর্যাদা দিয়ে বুঝে নিয়ে ‘উহা শ্রেণী নয়’ তা গণ্য করবেন না। খাদন প্রক্রিয়ায় তথা কনসাম্পশনে কতটা অর্জন হলো সেটার মানদণ্ড ও ঘোষণাপত্র দুই-ই সচল থাকতে থাকে। ফলে দুই পক্ষের এক শ্রেণীতে থাকবার আনন্দ মুহূর্তে ভেস্তে যেতে পারে। কিংবা আপনিও দূর থেকে সমরূপ ভেবে সিদ্ধান্তে এলে গোলমাল করে ফেলবেন। যেহেতু প্রতিদিন শ্রেণীযুদ্ধ হচ্ছে না, বা যেটা হচ্ছে সেটা ঢিসুম-ঢাসুম যুদ্ধ নয়, তাই চিকনা বুদ্ধির সামাজিক শ্রেণী বোঝার চেষ্টাটা অন্যরকম হবে।

এখানে পাবদার জায়গায় চিজও হতে পারত। তখন ধীরে ধীরে এমনকি খাদ্যদ্রব্যের মধ্য থেকেও আমরা ব্র্যান্ডের মাহাত্ম্য বুঝতে পারতাম। যেমন, পৌঁছানোর সাথে সাথে চায়ের সঙ্গে চিজ ধরিয়ে দিলেন সলিম-পত্নী। মমিন সাহেবের স্ত্রী হয়তো বললেন “হ্যাঁ চিজ ওদের খুবই প্রিয়।” সলিম সাহেবের স্ত্রী কিন্তু ঠিকই মনে করিয়ে দেবেন “উঁহু আপা! এটা হলো নরওয়ের (বা ডেনমার্কের) চিজ।” হয়তো শ্রেণী ফস্কে যাবার আতঙ্কে মমিন সাহেব নিজে অংশ নিলেন, “যেবার আমি ডেনমার্ক (বা নরওয়ে) গেছিলাম, আসার সময়ে আড়াই কেজি নিয়ে এসেছিলাম। ছেলেমেয়ে তো দুই রাতে সাবাড় করে দিল।” হয়তো একথা শুনে ছেলে মেয়ের পানে, আর মেয়ে ছেলের পানে তাকিয়েও রইল, অন্যজনের এমন কিছু মনে পড়ে কিনা বুঝতে, তবে তাতেও মমিন সাহেবের পরিবারের রক্ষা নাই। সলিম সাহেব নিজে এবার পেরেক পুঁতে দেবেন “না না এটা ঠিক নরওয়ের যেকোনো চিজ নয়। এটা হলো গরুটিকে আগের তিন দিন বিশেষ ঘাস খাওয়ানোর পর যে দুধটি হয়, সেটি মালিকের তত্ত্বাবধানে…।” ইত্যাদি। এই বিশদ বিবরণীর পর মমিন সাহেবের পরিবারে চিজ-খাদন বিষয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবার কোনো বক্তাই আর অবশিষ্ট থাকেন না। তাঁরা অধোবদনে, গরুটির ঘাস খাবার মতোই, চিজ খাদনে মনোনিবিষ্ট হন। তো, এই চিজ ব্র্যান্ডের মাহাত্ম্য বুঝবার একটা দারুণ সূত্রপাত হতে পারে। এখন এসব আলাপে বাড়ি, গাড়ি, টিভি, তৈজসপত্র, পোর্সেলিন, ফার্নিচার সব বসিয়ে বসিয়ে আগাতে পারবেন।

আদাবর, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

কভারের ছবিতে মানস চৌধুরী, ছবি. বন্যা মির্জা