বাংলাদেশের সাহিত্য আর বিশ্বসাহিত্য নিয়া চিন্তা করতে গেলে, প্রথমেই যে ভাবনাটা আসে—এই দুই জগতের মধ্যে আসলে দূরত্বটা কোথায়?
হারুকি মুরাকামি, ওরহান পামুক বা ঝুম্পা লাহিড়ী, ওনাদের বইগুলি ঠিক কী কারণে সারা বিশ্বে অনূদিত হয়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্টসেলার তালিকায় জায়গা পায়? অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের সাহিত্যিকদের উপস্থিতি বলতে গেলে নাই-ই।
বাংলাদেশের সবচে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ওনার প্রকাশিত উপন্যাস সংখ্যা দুই শ’র বেশি। কয়টা অনুবাদ হইছে ইংরেজিতে?
গত বছর ফোর্বসের একটা আর্টিকেল “মোস্ট স্পোকেন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড”-এ দেখলাম, ভাষাভাষীর দিক দিয়া বাংলা ভাষার অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। তাইলে, আমাদের এই দুরবস্থা কেন? বাঙালি বাদে অন্য কোনো জাতি বাংলা ভাষায় কথা বলে না, তাই?
অর্ণব ফেরদৌস
পশ্চিমা সাহিত্যের বাজার যেমনে কাজ করে, ওদের প্রকাশনা সংস্থাগুলি সাধারণত এমন বই সিলেক্ট করে, যেগুলি অনুবাদ সহজ, স্থানীয় সংস্কৃতির জটিলতা কম। যেমন, মুরাকামির লেখায় জাপানের রাস্তাঘাট, লোকাল মিউজিকের রেফারেন্স থাকলেও তা এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যেন পশ্চিমা পাঠক সহজে কানেক্ট করতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্য অনেক সময়ই এই সহজবোধ্যতার ফর্মুলা মানতে চায় না। আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ বা সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’-এর মত উপন্যাসগুলি মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস, গ্রামীণ জীবনের জটিলতা বা নারীর সংগ্রাম এমন গভীরে নিয়া যায় যে ওইগুলি অনুবাদ করলেও পশ্চিমা পাঠকের কাছে সেইসবের প্রেক্ষাপট বোঝা কঠিন।
অনুবাদের সংকট তো আছেই। বাংলাদেশের সাহিত্যের বেশিরভাগ কাজই হয় বাংলায়। ইংরেজি বা অন্য ভাষায় অনুবাদ হয় হাতেগোনা। যদিও এর কারণ হিসাবে অনেকেই বলেন, বাংলা সাহিত্যের বাজার ছোট। আমার মনে হয় না, এইটা কোনো বড় ফ্যাক্টর। কিংবা বলা যাইতে পারে, অজুহাত মাত্র।
আবার সমস্যা শুধু অনুবাদেই না, অনুবাদের পদ্ধতিতেও। অনেক সময় অনুবাদে মূল লেখার আবেগ, ছন্দ বা সাংস্কৃতিক রেফারেন্স হারায়া যায়। যেমন, শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসটার জটিল বর্ণনা ও প্রেক্ষাপট অনুবাদে ধইরা রাখা প্রায় অসম্ভব। এই রকম সাহিত্য অনুবাদ করতে সাহিত্য বুঝলেই হবে না। দরকার পেশাগত দক্ষতা ও টার্গেট মার্কেট স্টাডি।
ইংরেজিতে লেখা বাংলাদেশী লেখক তাহমিমা আনাম, জিয়া হায়দার রহমান এর বই তো পশ্চিমা পাঠক, দেশের ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা ঠিকই পড়তেছে। এর কারণ কি শুধু ইংরেজি ভাষা নাকি গ্লোবাল মার্কেট আন্ডারস্ট্যান্ডিং?
আমি বলতেছি না, মাতৃভাষায় লেখা সাহিত্য গ্লোবাল পাঠক পাইতে হইলে ইংরেজিতেই লেখা লাগবে।
রিসার্চগেইটে কে. আনিস আহমেদ এর একটা জার্নাল পড়তেছিলাম কয়েকদিন আগে। ওইখানে গায়ত্রী স্পিভাকের একটা মন্তব্য উনি উল্লেখ করছেন এইভাবে, গ্লোবাল সাহিত্যের লেন্সে বাংলা সাহিত্যরে “অতিমাত্রায় স্থানীয়” বা “স্টাইলিস্টিক্যালি নন-কম্পিটিটিভ” বইলা ধরা হয়। আমি মনে করি, গ্লোবাল কনটেক্সটে ভাবলেও সাহিত্য লোকাল হওয়া কোনো সমস্যা না বরং এইটা সাহিত্যের শক্তি। সাহিত্য লোকাল হয়েই গ্লোবাল।
বরং বলা যাইতে পরে, গ্লোবাল সাহিত্যের মানদণ্ড তৈরি হইছে পশ্চিমা এস্থেটিক্সের ওপর ভিত্তি কইরা। যেখানে তুলনামূলক সাহিত্য চর্চায় ইউরোপকেন্দ্রিকতা এতটাই প্রভাবশালী যে, বাংলাদেশের সাহিত্য শুধু অনুবাদ করলেই চলবে না, ওইখানে জায়গা করে নিতে হইলে ইউরোপীয় ফর্ম বা থিমের অনুকরণ করতে হবে।
যেমন, মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমাদের অনেক ভাল উপন্যাস আছে। প্রায় সকল উপন্যাসেই আবেগ, বেদনা এত ব্যক্তিগত ও স্থানীয় ভঙ্গিতে উপস্থাপিত যে, গ্লোবাল পাঠকরে তা টাচ করতে পারে না। কারণ এইসব উপন্যাসে যে বিশ্বজনীন মানবিক সংঘাত আছে, সেইটা ধরতে হইলে দরকার স্থানীয় প্রেক্ষাপট বোঝা। কিন্তু আমাদের সাহিত্য গ্লোবাল মার্কেটে প্রায় অনুপস্থিত থাকায় এই প্রেক্ষাপট তৈরিই হইতে পারে নাই।
বিশ্বের বড় লাইব্রেরিগুলিতে গেলে, বাংলা সাহিত্য ক্যাটেগরিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া বাংলাদেশী কোনো সাহিত্যিকের বই পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এই বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার সারা বিশ্বে শুধু রবীন্দ্রনাথেই আটকায়া আছে। যেন এরপর আর এই বাংলা অঞ্চলে কেউ সাহিত্য চর্চা করে নাই। এই মৃত অবস্থা কেন তৈরি হইতে পারল?
গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের যে কয়টা সাহিত্য অন্য ভাষায় অনুবাদ হইছে তা এক হাতের আঙুলেই গুইনা ফেলা যাবে।
এখানে অনুবাদ ক্যাটেগরিতে লেখকরা পুরস্কার পান বিদেশি বই বাংলায় অনুবাদ করে। নিশ্চয় প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু বাংলা বই অন্য ভাষায় অনুবাদ কইরা পুরস্কার পাইছেন, এই রকম এখনও ঘটে নাই মনে হয়। বাংলা সাহিত্য অনুবাদে কোনো সরকারি বরাদ্দ আছে বইলাও আমার জানা নাই। এই অবহেলার কারণ কী? সমস্যাটা কোথায়?
এইটারে তো সংকটই বলা যায় যে, বাংলা সাহিত্যের কোনো গ্লোবাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নাই।
আরেকটা বড় সমস্যা আমি মনে করি, সাহিত্য সমালোচনার দুর্বলতা। আমাদের সমালোচনার বেশিরভাগই বই পর্যালোচনা বা লেখকের প্রশংসায় আটকায়া থাকে। গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, তুলনামূলক পাঠ খুবই কম। গ্লোবাল মিডিয়াতেও কাভারেজ নাই। কারণ কি দুর্বল সাহিত্য, তাই ক্রিটিকদের অনীহা ও দায়সারা ভাব? নাকি আজকাল মানুষ পড়তেছেই কম?
আমার বেশিভাগ পড়াশোনা হয় কিন্ডেল বা মোবাইলে। দুইটা প্লাটফর্ম আমি খুব ফ্রিকুয়েন্টলি ব্যবহার করি। একটা লিবি (Libby), আরেকটা ক্যানোপি (Kanopy)। লিবিতে সারা বিশ্বের লাইব্রেরিগুলি নিজেদের বইয়ের ডিজিটাল কপি, ই-বুক, অডিওবুক, ম্যাগাজিন ইত্যাদি আপলোড করে। মার্কেটের সঙ্গে অলওয়েজ আপ টু ডেট। আর ক্যানোপি অনেকটা নেটফ্লিক্সের মতন। প্রচুর ফিল্ম, ডকুমেন্টারিতে ভরা। ইন্টারেস্টিং পার্ট হইতেছে, দুইটা প্ল্যাটফর্মেই লাইব্রেরি কার্ড ব্যবহার কইরা মেম্বাররা সকল কনটেন্ট উপভোগ করতে পারে। খুবই ইউজার ফ্রেন্ডলি ও সহজ সিস্টেম।
কষ্টের কথা হইল, এই প্ল্যাটফর্মগুলিতে সারা বিশ্বের ফিল্ম, লিটারেচার পাওয়া গেলেও, বাংলা কনটেন্ট বলতে আছে সত্যজিৎ রায় আর রবীন্দ্রনাথ। মাঝেমধ্যে ভাবি, এই রকম প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে কীই বা লাগে? আমাদের দেশের টেক ট্যালেন্টরা ঘরে বসেই ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড কাজ করতেছে, গ্লোবাল বড় কোম্পানিগুলির সঙ্গে। চাইলেই একটা এক্সপার্ট টিম তৈরি করা যায়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বা বাংলা একাডেমি কি এই দায়িত্ব নিতে পারে না?
আমার মনে হয়, পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারা খুবই জরুরি। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, প্রিন্টিং প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াইতে না পারার কারণে আরবির মত একসময়ের শক্তিশালী ভাষা ডিক্লাইন হইতে হইতে এখন বছরে মাত্র সতেরো-আঠারো হাজার বই পাবলিশ হয়। যেখানে এক পেঙ্গুইন হাউজের বার্ষিক পাবলিকেশনই এর চাইতে বেশি।
এখনকার সময়টা টেকনোলজির। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের সময় প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এডপ্ট করতে না পারলে বাংলা ভাষা তথা সাহিত্যের অবস্থা এর চাইতেও খারাপ হইতে পারে।
প্রতিবছর আমাদের বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়তেছে। কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, বইমেলা আর বিভিন্ন প্রকাশনীর কয়েক বছরের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে, বিক্রীর সংখ্যাও বাড়তেছে কিনা। আমার আশঙ্কা, সেইটা নেগেটিভই হবে।
এত বইয়ের হার্ডকপি প্রকাশ হইতেছে, অথচ কোনো ডিজিটাল প্রকাশনার ব্যবস্থা বা প্ল্যাটফর্ম নাই। ফলে, দেশের বাইরে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। নামে মাত্র কিছু বই দেশের বাইরে যায়। রাজনৈতিক জটিলতায় কলকাতার বইমেলায় অংশগ্রহণও একপ্রকার কঠিন হয়ে দাঁড়াইছে। ইংরেজি অনুবাদ না হওয়ার কারণে আমাদের প্রকাশকেরা কলকাতা বাদে অন্য দেশের বইমেলাতেও অংশগ্রহণ প্রাসঙ্গিক মনে করেন না।
যদি মানুষের সাড়া পাওয়াই শিল্পের অস্তিত্বের ভিত্তি, তবে এই সাড়া আর কীভাবে তৈরি হবে? কীভাবে দেশের সাহিত্য ডিজিটাইজ করাসহ বিশ্বসাহিত্যে নিজেদের উপস্থিতি তৈরি করা যাবে?
এইটা ঠিক যে, সাহিত্যের মূল শক্তি তার বৈচিত্র্যে। তবু প্রশ্ন তৈরি হয়, বিশ্বসাহিত্য যখন মার্কেট ড্রিভেন, তখন বাংলাদেশের সাহিত্যকদের কি শুধু স্থানীয় পাঠকদের কথা ভেবেই লেখা লাগবে? নাকি গ্লোবালাইজেশনের চাপে নিজেদের স্বকীয়তা কমপ্রোমাইজ করতে হবে?
জানি, এর উত্তর সহজ না। তবে এইটুকু বুঝতে পারি, বিশ্বসাহিত্য পরিমণ্ডলে বাংলা সাহিত্য তথা বাংলাদেশের সাহিত্য এইভাবে সাইডলাইন্ড হইতে থাকলে, একসময় তা পুরাকীর্তি চর্চায় পরিণত হইতে বেশি সময় লাগবে না।
ঢাকা, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫
পরিচিতি
অর্ণব ফেরদৌস আর্টিস্ট, লেখক ও কম্পিউটার প্রকৌশলী