সেদিন ছিল শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২০। ছবি তুলেছি রাজিবপুর গ্রামে। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা। তারই একটি গ্রাম এই রাজিবপুর।
তখন মাঘের শীত। ঘন কুয়াশায় মোড়ানো ভোর। সেদিন সেই ভোর সাররিয়াল / অলৌকিক এক অনুভূতির মধ্যে নিয়ে গেছিল আমাকে! এই রকম ঘনঘোর কুয়াশা প্রথম দেখি দিল্লীতে। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাস। হাড়কাঁপানো কনকনে শীতের অভিজ্ঞতাও ওই আমার প্রথম। তখন কুয়াশাকে সাররিয়াল মনে হয় নাই। এবার হলো। কেন হলো? উত্তর পেলাম না। আসলে কখন কি অনুভূতি হবে তার পুরোটা আমরা কেউ জানি না!
এসেছি নেত্রকোণায়, কেন্দুয়া সদরের সবুজ গ্রাম আমলীতলায়। এই গ্রামের ছেলে সৈয়দ আবু আবেদ সাহের। বাপ-দাদার পুরোনো ভিটা নতুন করে সাজিয়েছে।
আমাদের পরিচয় ১৯৮৬ সালে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গিয়ে। তখন আমরা কলেজে, প্রথম বর্ষে পড়ি। কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচিতে পরিচয় হওয়া ৯ জন এসেছি আমলীতলায়। সাহের আর ওর স্ত্রী মেহেরের আমন্ত্রণে। প্রায়ই আসি। এবার বেশ বড়সড় দল আমাদের।
ছবির গল্প
ফৌজিয়া খান
রাতে খোলা উঠানে আগুন লাকড়ি জ্বালানো হয়েছে। তার চারপাশে বসে আমরা হৈ হৈ রৈ রৈ করব। পাশেই খাটানো আছে তাবু। আছে লেপ তোশক বালিশে ওমের ব্যবস্থাও। আড্ডাবাজিতে ক্লান্ত হয়ে ঘুম পেলেই বন্ধুত্বের উত্তাপ বুকে নিয়ে তুলাের ওমের মধ্যে ঢুকে পড়ব। আমরা এগারো জন। লিখে ফেলার পর মনে পড়ে গেল, ‘ওরা এগারো জন’! একটা সিনেমার নাম। দেশ স্বাধীন হবার পর পরই বানানো ছবি। দেখিনি। শুনেছি, এর বিষয় মুক্তিযুদ্ধ।
আমাদের সকলেরই জন্মসাল দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’এক বছর এদিক-ওদিক হবে। দেশের সাথে সাথে আমরাও বড় হয়েছি। বেড়াতে আসা এই এগারো জনের মধ্যে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ইন্টারপ্রিটেশনে ঐক্যমত নেই। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। বন্ধুর বাড়ির আতিথেয়তায় তার কীবা সম্পর্ক!
রাত। কনকনে ঠাণ্ডা। ঘন কুয়াশা। আমরা বসেছি গাছ তলায়। সকলের গায়ে গরম কাপড়। লাকড়ি জ্বলছে মধ্যিখানে। তবুও মনে হলো, বাতাস মাতাল হয়ে গেছে। আড্ডায় কামড় বসাচ্ছে শীতের হিম। কুয়াশার ঘন চাদর ঢেকেছে রাত। দমকা বাতাসে কুয়াশার ওই চাদর উড়ছে যেন পত পত করে। তেড়ে তেড়ে উড়ে এসে ঢুকে পড়ছে তাবুতে। লেপ তোশক সব ভিজিয়ে দিয়েছে। আমরা ইট বালু সিমেন্টের ঘরে ঢুকে পড়লাম। আড্ডায় ওম ফিরে এলো।
ম্যারাথন আড্ডায় পুরোটা সময় আমি থাকলাম না। ঘুমাতে গেলাম। আড্ডার হই হই শব্দ শুনছি। এক সময় ওদের রৈ রৈ কমল। বুঝলাম, সবাই ঘুমাতে গেল। চারদিক শুনসান। আমার আর ঘুম হল না।
ফজরের আজান শুনলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে জানালার গ্রিল স্পষ্ট হল। বন্ধ কাচের ওপারে সাদা। বুঝলাম, কুয়াশার চাদর ফুড়ে সূর্য আলো ছড়াতে শুরু করেছে। এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। আর অপচেষ্টা না করে উঠে পড়লাম। শরীর আপাদমস্তক মুড়ে পথে বেরুলাম।
মূল সড়ক ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। পিচে মোড়ানো সড়ক। এত কুয়াশা! দুই হাত দূরের কিছুও দেখতে পাই না। জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই। আমি হাঁটছি। হাঁটছি। হাঁটছি। কোথাও কেউ নেই। সাদা কুয়াশায় শুধু পিচঢাকা কালো সড়ক হাতখানেক দেখা যায়। বাকিসব কুয়াশার ভিতর লীন হয়ে আছে।
কুয়াশায় বিলীন সেই ভোরে আর কেউ নয়, কিছু নয়—কবি জীবনানন্দ দাশকেই মনে পড়ল! মনে হল, পৃথিবীটা মায়াবী পাড়ের একটা দেশ। তার মধ্যে অনন্তকাল ধরে হেঁটে চলেছি আমি—নিশানাবিহীন। আমার অতীত নেই, ভবিষ্যতে স্বপ্ন নেই—আছে কেবল দিকচিহ্নহীন বর্তমান। বহমান বর্তমান মুহূর্তের মধ্যে অতীত হয়ে কালের গহ্বরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার কোনো আপন নেই, পরও নেই। আছে কেবল দূর দিগন্তে বিলীন এই পথচলাটুকু!
আমি হাঁটছি। হেঁটেই চলেছি।
ঘণ্টাখানেক পর গায়ের কাপড়গুলো বাড়তি মনে হতে লাগল। কুয়াশা ক্রমশ হালকা হতে শুরু করেছে। শিশির ভেজা চারপাশটা একটু একটু দেখতে পাচ্ছি। আদি-অন্তহীনতার পরাবাস্তব অনুভূতি থেকে মাটির পৃথিবীতে নেমে আসতে থাকলাম।
পথের দু’ধারে বাড়ি-ঘর দেখতে পাচ্ছি। ক্ষেত-প্রান্তর তখনও দূর কুয়াশায় বিলীন। হাঁটছি। রাস্তার ঠিক পাশ ঘেষে অবাক এক দৃশ্য চোখে পড়ল।
ছয়-সাতটা মাটির চুলা। গায়ে গা ঘেষে, একসঙ্গে। দেখে অবাকই লাগল। ওদের কাছে এগিয়ে গেলাম। নানা ফর্মের। সবগুলোতেই ব্যবহারের চিহ্ন রয়েছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখি বিশাল উঠানের ওই পাড়ে ঘর দরজা জানালা সব বন্ধ। সকলে ঘুমুচ্ছেন বোধহয়।
বেশ বড় বাড়ি। উঠান অনেক বড়। কিন্তু রাস্তার ঠিক ধার ঘেষে রান্নার ব্যবস্থা! এমনটা এর আগে কখনো চোখে পড়েনি। নানা ফর্মে, ছোট-বড় একগুচ্ছ চুলা যৌথতার কথা বলে। ভিন্ন হাড়িতে খাওয়া অনু পরিবারগুলো হয়তো বা একসাথে বসে রান্না করে। ব্যাপারটা ভাবতে বেশ সুন্দর লাগল! কার্ডিগানের পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে দু’চারটা ছবি তুলে বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে।
তারপর আবার সেই দূর কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া পিচ বিছানো পথ ধরে সামনে হাঁটতে থাকলাম। ধীর পায়ে। আমার তো তাড়া নেই কোনো। এবার দু’একজন মানুষের দেখা পেলাম। দুটি বাচ্চা ছেলে পরস্পর কাঁধে হাত রেখে পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে ওরা মিলিয়ে গেল কুয়াশার ভিতর।
উল্টোদিক থেকে হনহনিয়ে হেঁটে এলেন আরেক লুঙ্গিপরা লোক। পাতলা এক শাল গায়ে। মাথায় উলের টুপি। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কোথায় চলেছেন কে জানে তা। এরপর নির্জন ভোরের বুক চিড়ে ছোট্ট একটি ট্রাক তারচেয়ে বহুগুণ বড় মাল নিয়ে ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। লাল মাফলারে কানমাথা ঢেকে ফুলহাতা শার্ট গায়ে কালচে নীল প্যান্টের এক যুবক সাইকেল চালিয়ে এল। পাশ দিয়ে যাবার সময় অকারণেই বেল বাজাল।
আমি ধীর পায়ে হেঁটে চলেছি। কুয়াশা কমে আসছে। ক্ষেতে ক্ষেতে ধানের চারা দেখতে পেলাম। ওদের ডগা শিশিরে ভেজা। সড়ক থেকে আলপথে নেমে গিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। তখনও আলো ফোটেনি ভালো মতো। ছবি তেমন যুতের হল না। মোবাইল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। দেড় ঘণ্টা হেঁটে ফেলেছি! ফেরার পথটুকুও হেঁটেই ফিরব। সদ্য অপারেশন করা শরীর আমার। ফিরতি পথ ধরলাম।
পথে এবার মানুষ পেলাম। মহিলাদের পরনে শাড়ির উপর পাতলা একটা শাল, শিশু আর পুরুষদের হাফহাতা জাম্পার, মাথায় উলেন টুপি বা মাফলারও আছে। কারো বা জ্যাকেট। কাউকেই শীতে জবুথবু মনে হল না। আমার পরনে অবশ্য পরতে পরতে অনেকগুলো গরম কাপড়।
আমি হাঁটছি। সড়কে কিছু বাহনও চলতে শুরু করেছে। দূর থেকে এক জায়গায় কিছু মানুষ দেখলাম। আমি থামলাম। চারপাশটা বুক সমান টিন দিয়ে ঘেরা, উপরে চালা। মধ্যিখানে উঁচু এক মাচাং। তাতে লাল উলেন জামা, মাথায় নীল মাফলার প্যাঁচানো লোক বসে।
সেখানে স্টোভের চুলা জ্বলছে। চুলায় লোহার তাওয়া। তাতে গোল গোল সাদা গুল্লিমতো কিছু সেঁকছেন। তেল ছাড়া। কাছেই দু’চারটি বাচ্চা ছেলে আর কয়েকজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। তাদের কারোর কারোর হাতে সেই গুল্লি পিঠা। খাচ্ছেন। বুঝলাম, এটা পিঠা কেনাবেচার দোকান একটা।
কাছে গেলাম। মনে ইচ্ছা, দু’চারটা ছবি তুলি—টুকটাক কথা বলি। অচেনা সাধারণ জনের সাথে কথা না বললে কি সেই জায়গা পুরোটা দেখা হয়? হয় না। আমি তাই যেখানেই যাই পথে পাওয়া মানুষের সাথে কথা বলি। চট করে তো কারো ছবি তোলা যায় না। আর হঠাৎ করে আলাপও জমানো যায় না।
পিঠা দেখার ছুতায় কথা শুরু করলাম। দোকানি জানালেন, পেছনেই বাড়ি। এটা অস্থায়ী দোকান। ভোর থেকে সকাল আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলে। রাতে চালের গুড়ায় কাই বানিয়ে ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন।
ফজরের আজান হলে চ্যাপা মাছের ভর্তা বাটা হয়। তিনি এখানে এসে চুলা ধরান। হাতের মুঠোয় গুল্লিগুলো বানিয়ে টাটকা সেকে বিক্রি করেন। ভর্তা বাটা, কাই বানান বাড়িতে। ওগুলো করেন তার স্ত্রী।
গুল্লিগুলো তাওয়ায় সেঁকতে সেঁকতেই কথা বলছেন দোকানি। ক্রেতাদের কয়েকজন শিশু, বেশির ভাগই বয়স্ক পুরুষ। চাহিদামাফিক পিঠা আর ভর্তা পুরোনো খবরের কাগজের টুকরোয় তুলে দিচ্ছেন। ৬টি পিঠা সাথে চ্যাপার ভর্তা—দাম ৫ টাকা। পিঠার নাম মুমিনসিংগা ভাষায়—ম্যারা পিঠা। আমি ঘুরে-ফিরে দেখছি।
দোকানি জিজ্ঞেস করলেন, কয়টা দিবাম। বললাম, চাই না কোনো। ছবি তুলতে চাই—পিঠা আর আপনাদের। তারা সানন্দে রাজি হলেন।
ছবি তুলতে তুলতে জানলাম, বাড়িতে সকালের খাবার তৈরি হবার আগে তার ক্রেতারা আসেন এইখানে। হালকা নাশতা হিসেবে খান এই পিঠা। ৫ টাকায় ৬টি পিঠা কিনে ভাগজোক করে খান কয়েকজন। গপসপ করেন। গালগল্প শেষে বাড়ি ফেরেন। গোসল সেরে বাড়িতে বানানো গরম খাবার খেয়ে কাজে বেরিয়ে যান।
আমার বৃত্তান্তও জানতে চাইলেন তারা। বেড়াতে এসেছি শুনে তাদের প্রশ্ন, কোন বাড়ি।
বন্ধুর নাম জানি। ওদের বাড়ি কোন নামে পরিচিত তা জানি না। উত্তর প্রশ্ন করিয়েরাই দিতে পারলেন। তারা ধরে নিলেন গাড়িওলা বাড়িরই মেহমান হবো আমি।
পিঠার ছবি তুলছি যখন দোকানি আমাকে পিঠা দিতে চাইলেন। আমি তো খাবো না। হেঁটেছি। এখন হাত না ধুয়ে কিছুই খাবো না। মানিব্যাগও সাথে নিয়ে বেরুইনি। আমার কাছে একটি কানাকড়িও নেই।
তারা জোরাজুরি করতেই থাকলেন। শেষে বাধ্য হয়ে বলেই ফেললাম, সাথে টাকা নেই। তখন, দোকানি এবং ক্রেতারা হা হা করে উঠলেন! টাকা নাই তো কী হইছে। আপনে আমরার মেমান। দুইন্যায় টেকা-পুইসাই কি সব?
দোকানি ৬টি পিঠা এবং চ্যাপা ভর্তা সুন্দর করে সাজাতে লাগলেন। ওই আতিথেয়তা উপেক্ষা করার মতন মনের জোর আমার নেই। বললাম, এতগুলা খেতে পারব না। তাওয়া থেকে একটা গরম পিঠা দ্যান। পকেট থেকে টিস্যু বের করে করলাম। হাতের তালুতে ওই টিস্যু পেতে দিলাম। তিনি দুটি দিলেন—আমি একটি তুলে নিতে বললাম।
গরম পিঠাটা ওখানে দাঁড়িয়েই খেলাম। মনে মনে দুশ্চিন্তা হল, পথের পাশে এইভাবে আমজনতার সাথে পিঠা খেয়ে হোস্ট বাড়ির ডেকোরাম ভঙ্গ করছি কি!
খেতে খেতে টুকটাক আরও কথা হলো। পথের পাশে এই পিঠা আসরে কোনো নারী ক্রেতা দেখলাম না। তারা নিশ্চয় তখন বাড়িতে। সকালের খাবার রানতে বাড়ির চুলা ধরিয়েছেন।
ফিরতি পথে হাঁটতে শুরু করলাম। কুয়াশা অনেকটা কেটেছে। লোকজন, বাহন আরো বেশি চলতে শুরু করেছে। এখন আর আমার মনে সাররিয়াল কোনাে অনুভব নেই। আমার ভেতরে তখন সত্যিকারের বাস্তব বাংলাদেশ। এর মানুষ। মানুষের আন্তরিকতা। আতিথেয়তা।
আমি এই ভূমির সন্তান। এই বাস্তব বাংলাদেশকে আমি ভালোবাসি। যতবার ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি শুনি ততবার আমার বুকের ভিতর একটা কাঁপন তৈরি হয়।
২৭ আগস্ট, ২০২০