ছবিটা গভীর রাতের দিকে তোলা। গভীর মানে মানুষ তখন কোনো এক যানবাহনে চইড়া সাত আসমান পরিভ্রমণরত। এর মধ্যে পাতালপুরীও পড়ে। ইহজগতে সে আর নাই। রাত্রি ৩টার পরে বায়োলজিক্যাল ঘড়ি তাকে ধীরে ধীরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার দিকে নিয়া আসে। ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে মনোজাগতিক কোনো এক স্তরে, এই শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের মিলমিশে, অনেকে সত্যি সত্যি আর ইহলোকে ফেরেন না। আমি ছবিটা তুলি অ্যাগজ্যাক্টলি ৩টার পর পর। জীবজগত ও প্রাণীজগত তখন তাদের জড় অবস্থার প্রতি সবচেয়ে নিকটবর্তী—এমন টাইমে।
আমি হোটেল থেইকা হাঁটতে বাইর হইছিলাম। কুয়াকাটা সাগরপাড়ে।
দক্ষিণবঙ্গের অনেক জলরাশি ও নদী-নালা পার হইয়া গিয়া কুয়াকাটায় পড়তে হয়। বৃহৎ বৃহৎ সব বাংলাদেশের জাঁদরেল নদী তারা। বরগুনা পার হইয়া পটুয়াখালীতে পড়লেই সারা গায়ে চতুর্দিক থেইকা পানি পানি লাগা শুরু হয় দেখবেন। সেজন্য সূর্য থাকলে হিউমিডিটিও প্রচুর।
আনম্য ফারহান
আমি একটা রৌদ্রালোকিত দিনই পাইছিলাম। শরৎকাল গিয়া সাইরা হেমন্ত শুরু হইছে চতুর্দিকে। বাতাসে শীত ভাসতেছে। যেন সিন্দুকে লুকানো কনক। গুম-গুমা-গুম হাসে সে। হৃদয় থেকে ছাড়ে চুপিত ঘ্রাণ। গভীরতা আর অ-গভীরতার মাঝখানে কী যেন একটা দোলাইতে থাকে, এরকম।
অবশ্য সব শরৎকাল আর হেমন্তই এমন। গুঁড়া গুঁড়া। পিছলাইয়া চলে মেজর ঋতুগুলার অববাহিকায় পৌঁছাবে বইলা। বসন্তও। আর, ব্যক্তির মানসিকতার সাথে সমানুপাতিক হারে তার অতিকথন বা না-কথন। কেন কোনোকিছু কেউ ওভাররেট করে, তার কাহিনী বোঝার চেষ্টায় আমি ঘুরতেছিলাম সেদিন।
তার মধ্যে, হঠাৎ এই জায়গাটায় আইসা একত্রে এত তালগাছ দেইখা আমি থাইমা গেছিলাম। মাথায় চলতে থাকা চিন্তাগুলি থামাইয়া দৃশ্যটা দেখলাম। তারপর আরও ভাল কইরা দেখলাম। দেখলাম যে, কোনোকিছু ওভাররেটেড হয় হইল আসলে, ওই সেই পার্সপেক্টিভের কারণে। তা ব্যক্তির ইম্পোজ করা। কম্পোজ করা। সুপার-ইম্পোজ করা। বাদবাকি সিরিজ অব ইভেন্টস তত আর খুইলা বলার কিছু নাই। আমি মনে মনে উত্তর পাইয়া একটু খুশীই হইছিলাম।
চারিদিকে লোক কইমা গেছিল ততক্ষণে। কক্সবাজারের মত অত ওপেন সমুদ্রসৈকত না এইটা। অনেকটা প্রাইভেট বিচের মত। যদিও দীর্ঘ সৈকত, তবে পাড় থেইকা বালুকাবেলা অনেক দূরে। আর জোয়ারের সময় পানি তেড়ে আইসা এখনও পাড় ভাঙে। গাছ, মাটি, রাস্তা খুইলা খুইলা পড়ে। এই জায়গাটা তেমনই পাড় ও সৈকতের কোলের মধ্যে। আজ আছি কাল নাই, এইরকম বাণী গায়ে ঝুলাইয়া সে যেন বেড়াইতে আসা মানুষদেরকে একটু আলাভোলা কইরা দেওয়ার আয়োজন কইরা রাখছে।
আমি যদিও খুশীই হইছিলাম। তার কারণ একটু আগে বলছি।
তালগাছ নিয়া আমার ভাল ভাল স্মৃতি আছে। আমার বাপের বাড়ির পিছনে একটা বাড়ি আছে। বাচ্চু কাকার বাড়ি বলি আমরা। উনিই থাকেন, দেখাশোনা করেন। মালিক যারা, তারা বছরে একবার আসে। বা আসেও না। আমরা বাচ্চু কাকাকেই দেখি। উনাকেই মালিক বইলা স্বীকার কইরা নিছি। উনিও আমাদের এইদিকে অবাধে আসেন, আমরাও উনার ওইদিকে অবাধে যাতায়াত করি। এইরকম পাড়া-পড়শীমূলক সমান সমান সম্পর্ক প্রায়। এই বাড়িতেই প্রথম আমার করমচা গাছের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এবং তার ফলের আশ্চর্য স্বাদ ও ভিতরের দুধ-সাদা রস আমাকে যে কী আপ্লুত করছিল, সেই কোন ছোটবেলায়, মনে পড়লে আজও আনন্দিত হই।
জীবনের অনেক প্রথম অভিজ্ঞতা আমার এই বাড়িতে। তো, এই বাচ্চু কাকার বাড়ির পুকুরের পাড়ে একটা তালগাছ ছিল। যেইটা আমাদের বাসার পিছন দিক। ভরা বর্ষায়, গভীর রাতে পুকুরভর্তি পানিতে তাল পড়ত। সেই শব্দে আমাদের যেন কত কত যুগের অপেক্ষার অবসান হইত। আমরা পরের দিন সেই তাল খাইতাম। ঘরে চিবাইয়া নেওয়া কাঁচা তাল—নারকেল দিয়া ঘন কইরা জ্বাল দেওয়া। মুড়ি দিয়া মাখাইড়া সেই তাল যে কী আশ্চর্য স্বাদের জিনিস, তা আর কী বলব।
তালগাছ কোথাও দেখলে আমি একটু দাঁড়ায়ে পড়ি। সময় নিয়া দেখার চেষ্টা করি। ভালবাইসা ওদেরকে শুনাইয়া শুনাইয়া তালবৃক্ষ বইলা ডাকি। এত লম্বা, তালকোম্পানিরা, এক পায়ে দাঁড়াইয়া, মনে করাইয়া দেয় রবীন্দ্রনাথের তালগাছ কবিতাটার কথা:
“মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে তারাদের এড়িয়ে যেন কোথা যাবে ও! তার পরে হাওয়া যেই নেমে যায়, পাতা-কাঁপা থেমে যায়, ফেরে তা'র মনটি ... তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে।”
ছবিতে হইছে যদিও উল্টা কথা। তালগাছগুলা যেন বিছায়ে রাখছে নিবিড় কোনো হস্তবন্ধনী। যেভাবে কবি কাজী নজরুল ইসলাম উনার ওই বিখ্যাত ফোটোগ্রাফটাতে দুই বাহু বুকের কাছে ভাঁজ কইরা ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া থাকেন, মাথাভর্তি তালগাছের মত গোল চুল নিয়া—চোখে স্থির, শান্ত, বহুদূরব্যাপী তাকাইয়া থাকা গভীর ড্যাব-ড্যাবে দৃষ্টি—ওইরকম। আহারে। ভিতরে যেন গিয়া বইসা থাকা যাবে। হিম হিম কোমল সাগরের ডাক থেকে আসতেছে যেন বহুদূর নামক ওই তাকাইয়া থাকা দৃষ্টিবৎ হৃৎপিণ্ডের শব্দ।
আলোয়-আঁধারে-রাত্রিতে তারা উৎপাদন করতেছে কুসুম। কুসুমের পানে চাইয়া থাইকা তার ভিতরেই অসংখ্য কুসুম উৎপাদন করে মানুষ।
এই ছবিটাও যেমন উৎপাদিত হইল।
আমি যে ছবিটা তুলব বা এইরকম দৃশ্য দেখতে পাব, অবশ্যই তা জানতাম না। তার আগে যেই চিন্তাটা আমার মাথায় ছিল, কেন কোনো কিছু কেউ ওভাররেট করে বিষয়ক, সেই উত্তর জানার জন্য পার্সপেক্টিভ দেখাও নিশ্চয়ই আমার উদ্দেশ্য ছিল না। তবে, দৃশ্যটা দেখার এবং ছবিটা তোলার মধ্যবর্তী মোটামুটি মিলিসময় থেইকা দীর্ঘসময় পর্যন্ত, আমি আমার চিন্তাভাবনার প্রতি কনভিন্সড হইতে পারছিলাম। খুব সামান্য একটা শব্দ কুসুমের মাধ্যমে পুরা আবিষ্কৃত জিনিসটা আঁটানো গেছিল। আর অসামান্য এই কুসুমকে যে দেখাও যাইতেছিল, সেইটা তুলতে পারা হইছিল।
ছবি: ২১/১০/২০২৪