একটি পড এয়ারলকে ওঠার সাথে সাথেই ‘পেগাসাস’ যানের চকচকে সাদা অভ্যন্তরে থাকা দুটো সিটে আটকে গেলেন দুই যাত্রী। এরপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পডটি ঘণ্টায় ১০০ মাইল গতিতে ট্র্যাক বেয়ে ছুটে গেল এবং এর প্রথম যাত্রীদের একটি নিরাপদ স্টপেজে পৌঁছে দিল। যাত্রাটি কেবল মাত্র ১৫ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে গতির মাত্রা হিসাবে নতুন কোনো রেকর্ড গড়া হয়নি। তবে এর মধ্য দিয়েই ‘ভার্জিন হাইপারলুপ ওয়ান’ বিশ্বের প্রথম সংস্থা হিসাবে হাইপারলুপ প্রযুক্তি সফলভাবে পরীক্ষা করার ইতিহাস তৈরি করল।
হাইপারলুপ হলো স্থলভাগের ওপর দিয়ে এমন একটি উচ্চ গতির পরিবহন ব্যবস্থা, যাতে মানুষ রেল লাইনের মতো করে স্থাপিত একটি ভ্যাকুয়াম টিউবের ভেতর দিয়ে শূন্যে ভেসে থাকা পডে চড়ে ঘণ্টায় ৭৬০ মাইল (১২২০ কিমি) বা শব্দের চেয়েও বেশি গতিতে ভ্রমণ করতে পারবে। এতে জাপান এবং জার্মানিতে উচ্চ-গতির রেল প্রকল্পগুলির মতো চৌম্বকীয় উত্তোলন বা ম্যাগনেটিক ল্যাভিয়েশন পদ্ধতির প্রয়োগও রয়েছে।
আশ্চর্যজনকভাবে দ্রুত পরিবহনের জন্য ভ্যাকুয়াম টিউব ট্রানজিট সিস্টেমের ধারণা আমাদের মাঝে দীর্ঘকাল ধরেই আছে। ১৮৪৫ সালে ব্রিটেনের প্রকৌশলী ইসামবার্ড কিংডম ব্রুনেল (যিনি তার সময়ের ইলন মাস্ক হিসেবে খ্যাত) দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডে একটি টিউব নির্মাণের প্রস্তাব দেন। যার মধ্য দিয়ে ট্রেনগুলি ঘণ্টায় ৭০ মাইল (১১০ কিলোমিটার) গতিবেগে চলতে পারবে। সে সময় ঘণ্টায় ৭০ মাইল গতিবেগ ছিল অকল্পনীয়। টিকিয়ে রাখা যাবে এমন উপাদানের অভাবের কারণে প্রকল্পটি অবাস্তব হিসাবে প্রমাণিত হয় এবং ব্রুনেলের প্রস্তাব বাতিল হয়।
ব্রুনেলের প্রচেষ্টার ১৭৫ বছর পর টেসলা এবং স্পেসএক্সের সিইও ইলন মাস্ক নতুন করে টিউবুলার ট্রানজিট প্রযুক্তির দিকে বিশ্বের দৃষ্টি ফেরান। ২০১৩ সালে তিনি ৫৮ পৃষ্ঠার একটি টেকনিক্যাল পেপার প্রকাশ করেন, যাতে তিনি হাইপারলুপের নকশার রূপরেখা তৈরি করেন। এটি হবে সৌরচালিত পরিবহন ব্যবস্থা, যাকে তিনি ‘একটি কনকর্ড, একটি রেলগান এবং একটি এয়ার হকি টেবিলের মধ্যে সমন্বয়’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।
মাস্ক দাবি করেন, এই যানবাহনে চড়ে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে সান ফ্রান্সিসকো যেতে মাত্র ৩৫ মিনিট লাগবে এবং যাত্রীদেরকে মাত্র ২০ ডলারের টিকেট কাটতে হবে। তবে মধ্যবর্তী পথের দূরত্ব ৩৫০ মাইল (৫৬০ কিলোমিটার)! আর এর অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হবে ৬০০ কোটি ডলার। তিনি আরও বলেন, হাইপারলুপ বর্তমান যেকোনো পরিবহন ব্যবস্থার চেয়েও নিরাপদ, যা দুর্যোগপুর্ণ আবহাওয়া এবং ভূমিকম্পেও অক্ষত থাকবে। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মাস্ক নিজে খুব বেশি সম্পদ ব্যয় করেননি। তিনি বরং তার হাইপারলুপ আলফাকে একটি ওপেন-সোর্স ডিজাইন হিসাবে বাজারে ছেড়ে দেন। যাতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কোম্পানিগুলি নিজেরাই গবেষণা করে এর আরো উন্নতি ঘটাতে পারে।
২০১৪ সালে ভার্জিন হাইপারলুপ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের লক্ষ্য ছিল মাস্কের প্রস্তাবিত হাইপারলুপ পরিবহন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। তারা মাস্কের প্রাথমিক প্রস্তাবটিতে উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনে এবং লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে সান ফ্রান্সিসকো রুটে তা নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ভার্জিন ভবিষ্যতের এই যানবাহনকে পরিবেশ বান্ধব রাখতে চায়। এজন্য তারা এর আসনগুলি পশুর চামড়া দিয়ে না বানিয়ে উদ্ভিদ থেকে আসা কাঁচামাল দিয়ে তৈরি চামড়াজাতীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি করবে। আর এর ভেতরের অন্যান্য জিনিসপত্রও নবায়নযোগ্য উপাদান থেকে তৈরি করা হবে।
টিউবের ভেতরে একটি ট্রেন কীভাবে কাজ করবে?
হাইপারলুপ সিস্টেমের মূলে রয়েছে ঘর্ষণ ও বায়ুর প্রতিরোধ, এই দুটি জিনিস পথ থেকে সরিয়ে ফেলা। যেকোনো যানবাহনের গতি এই দুটি জিনিসের কারণেই কমে যায়। ঘর্ষণ দূর করার জন্য পডটিকে এর লাইনের ওপরে ভাসমান অবস্থায় চালাতে হবে। যার ফলে তা ম্যাগনেটিক লেভিটেশন (ম্যাগলেভ) ট্রেনের মতো হয়ে যাবে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, ম্যাগলেভ ট্রেনে দুই সেট চুম্বক ব্যবহার করা হয়: এক সেট চুম্বক ট্রেনটিকে লাইন থেকে উঠিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে দেয় আর আরেক সেট চুম্বক ভাসমান ট্রেনটিকে দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। শূন্যে ভেসে চলার কারণে ম্যাগলেভ ট্রেনের গতি অনেক বেশি হয়। কেননা তখন আর এটি লাইনের সঙ্গে ঘষা খায় না।
ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো ভিত্তিক অ্যানার্জি অ্যান্ড ডিফেন্স কর্পোরেশন ‘জেনারেল অ্যাটোমিক্স’-এর ম্যাগলেভ সিস্টেমের প্রাক্তন পরিচালক স্যাম গুরোল বলেন, দুই সেট চৌম্বকীয় তরঙ্গ একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তারা গাড়িটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই কাজ করে শুধু।
গুরোল বলেন, “ম্যাগলেভের সুবিধা হলো, এটা আপনাকে খুব উচ্চ গতিতে চালিয়ে নিয়ে যায়, পাশাপাশি গুণগত মান সম্পন্ন একটি যাত্রাও উপহার দেয়। অনেকটা ম্যাজিক কার্পেটে চড়ার মতো অনুভূতি দেবে।”
চলার পথ থেকে বাতাসের প্রতিরোধ একেবারে কমিয়ে ফেলার মাধ্যমেই হাইপারলুপের এই অতি দ্রুতগতি অর্জিত হয়। যাত্রীবাহী পডগুলি একটি নিম্ন-চাপযুক্ত বদ্ধ টিউবের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, যার ভেতর থেকে প্রায় সমস্ত বাতাস শুষে বের করে দেয়া হয়। টিউবের ভেতরে বাতাসের চাপ এত কম থাকে যে, এর অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ লাখ ফুট (৬১,০০০ মিটার) ওপরের মতো হয়ে যায়। নিশ্ছিদ্র টিউবের মধ্যে থাকার কারণে হাইপারলুপ সিস্টেমটি দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থেকে সুরক্ষিত থাকবে এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে চলাচল করতে পারবে।
হাইপারলুপের অসুবিধা
যদিও প্রযুক্তিটি ট্রেন চলাচলে ঘর্ষণ এবং বাতাসের প্রতিরোধ সমস্যার সমাধান করে অবিশ্বাস্য গতি এনে দেয়, হাইপারলুপ প্রকল্প অন্য এক ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারে। আর তা হলো অর্থনৈতিক সংকট। এটি ব্যয়বহুল। অর্থনীতি ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে সান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত ইলন মাস্ক প্রস্তাবিত ৩৫০ মাইলের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যে ৬ বিলিয়ন ডলার খরচের কথা বলা হয়েছে, তা অনেক কম করে বলা। এবং ২০১৬ সালে ফাঁস হওয়া একটি আর্থিক নথি থেকে জানা যায়, মাস্ক প্রস্তাবিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গেলে আসলে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার লেগে যাবে। তার মানে প্রতি মাইলে ব্যয় হবে ১২১ মিলিয়ন ডলার।
যেকোনো ধরনের ট্রানজিটের মতো হাইপারলুপ ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমেও ঝুঁকি আছে। ফলে অপ্রত্যাশিত বিপর্যয় প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এই সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এত উচ্চ গতিতে চলার সময় একটি সামান্য ভূমিকম্প বা ভ্যাকুয়াম টিউবের সামান্যতম ভাঙ্গন যাত্রী এবং ক্রুদের জন্য বড় কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারে। সুরক্ষার নিশ্চয়তার পাশাপাশি হাইপারলুপ সিস্টেমে যাতায়াতের খরচও এমন হতে হবে, যাতে যাত্রীরা বর্তমানে প্রচলিত অন্যান্য পরিবহন পদ্ধতি ছেড়ে এর দিকে আকর্ষিত হয়।
এর মতো বড় আকারের প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নে ভালো প্রকৌশল জ্ঞানের পাশাপাশি ভাল রাজনীতিও দরকার। নব্বইয়ের দশক এবং ২০০০ এর গোড়ার দিকে গুরোলের সংস্থা লাস ভেগাস থেকে আনাহাইম পর্যন্ত চলাচলের জন্য ম্যাগলেভ-ভিত্তিক উচ্চ-গতির ট্রেন লাইন নির্মাণে জার্মান সংস্থা ট্রান্সপ্রাইডের সাথে সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে সাবেক মার্কিন সেনেটর হ্যারি রেড (নেভাডা) সেনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, উচ্চগতির ট্রেনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে এই রাজ্যের। ফলে তিনি প্রকল্পটি মাঝপথে এসে বাতিল করে দেন।
গুরোল বলেন, “এমন রাজনৈতিক পরিবর্তন যে কোনো অগ্রগতিকেই উল্টে দিতে পারে। শত শত প্রকৌশলীর ১৫ বছরের কাজসহ পুরো প্রকল্পটিই মাঠে মারা গেল।”
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর মতে, ২০১৮ সালে সাংবাদিক জামাল খাশোগির নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে ভার্জিন হাইপারলুপের প্রাক্তন চেয়ারম্যান রিচার্ড ব্র্যানসন সমালোচনা করলে, সৌদি আরব কোম্পানিটির সাথে তাদের যে ১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি ছিল, তা বাতিল করে। তবুও, ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত সংস্থাটি বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে এবং ২০৩০ সালে এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা করছে। এর আগে ২০২১ সালের মধ্যেই হাইপারলুপের যাত্রা শুরু করার কথা বলেছিল ভার্জিন।
ভার্জিন ছাড়াও এই পরিবহন পদ্ধতির সমস্যা দূর করার জন্য যে সংস্থাগুলি কাজ করছে, তার মধ্যে আছে হাইপারলুপ ট্রান্সপোর্টেশন টেকনোলজিস (হাইপারলুপটিটি)। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টার্টআপ, চীনে একটি পরীক্ষামূলক ট্র্যাক নির্মাণের জন্যে চুক্তি করেছে। এছাড়া নেদারল্যান্ডসের হার্ড্ট হাইপারলুপ এবং কানাডিয়ান কোম্পানি ট্রান্সপডও কাজ করছে।
যতক্ষণ না এই সংস্থাগুলি কয়েক মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহ করে একটি কার্যকর সিস্টেমের জন্য প্রয়োজনীয় বিশাল পরিমাণ জমি বরাদ্দ পাচ্ছে এবং প্রমাণ করছে যে সিস্টেমটি নিরাপদে পরিচালিত হতে পারে, ততক্ষণ হাইপারলুপ শুধু অদূর ভবিষ্যতের একটি স্বপ্ন হিসেবেই রয়ে যাবে।