বাচ্চা প্রথম যখন নিজের মত করে গল্পের বই হাতে নেয়, সেটি আসলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মুহূর্ত। এই ছোট অভ্যাসই ধীরে ধীরে তাকে ভাবতে শেখাবে, অনুভব করতে শেখাবে, প্রশ্ন করতে শেখাবে। কিন্তু অনেক বাবা-মা বুঝতে পারেন না এখন ঠিক কী করা উচিত, কীভাবে পাশে দাঁড়ানো উচিত। এ লেখাটি সেই পথই দেখাবে।

গল্প-উপন্যাস পড়া কেন গুরুত্বপূর্ণ
শিশু প্রথম যখন গল্পের বই হাতে নেয়, তখন অনেকেই ভাবেন, “আচ্ছা, এতে আসলে লাভটা কী?” আমাদের সমাজে এখনও অনেকের চোখে গল্প-উপন্যাস মানে শুধু সময় কাটানো বা বিনোদন। কিন্তু বাস্তবে গল্প-উপন্যাস একটি শিশুর ভেতরকার জগত গড়ে তোলার শক্তিশালী মাধ্যম।

গল্প-উপন্যাসের মাধ্যমে শিশুর যা হয়:

• কল্পনাশক্তি বাড়ে: শিশু চোখের সামনে না দেখেও মনে মনে দৃশ্য কল্পনা করতে শেখে। একটা বন, একটা নদী, একটা রূপকথার দেশ—সব যেন মাথার ভেতর সিনেমার মত ভেসে ওঠে।

• ভাষা ও শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়: নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচয় হয়। কথার গঠন, বাক্যের ছন্দ এসব পড়ে পড়ে ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা বাড়ে।


সাম্প্রতিক ডেস্ক


• আবেগ বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়: দুঃখ, রাগ, ভয়, ভালোবাসা—গল্পের চরিত্ররা এগুলি যেভাবে অনুভব করে, শিশু সেখান থেকে আবেগ চিনতে শেখে। অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারে।

• মনোযোগ ধরে রাখা শেখে: একটা গল্প শুরু করে শেষে পৌঁছানো মানে কিছু সময় ধরে মন এক জায়গায় রাখা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষমতাও শক্ত হয়।

• ভবিষ্যতের পড়াশোনার জন্য ভিত্তি তৈরি হয়: যে শিশু গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালবাসে, সেই শিশু পরে ক্লাসের বই, রেফারেন্স বই বা যেকোনো তথ্যবহুল লেখা পড়তে পারে খুব সহজেই।

• গল্প শিশুকে এমন অনেক অভিজ্ঞতা দেয়, যা বাস্তবে একসঙ্গে পাওয়া সম্ভব নয়—একবার সে নাবিক, একবার গোয়েন্দা, একবার রাজকন্যা, আবার একবার বিজ্ঞানী। সবই ঘটে নিরাপদ একটি জায়গায়—বইয়ের পাতায়।

বয়স অনুযায়ী শিশুর পড়ার প্রস্তুতি বোঝা
অনেক সময় বাবা-মায়েরা প্রশ্ন করেন, “এই বয়সে কি উপন্যাস ধরানো ঠিক হবে?” বা “এখন কি ছড়া-গল্পে থাকা ভাল?” আসলে সব শিশু একরকম না হলেও, বয়স ভিত্তিক কিছু সাধারণ ধারণা সাহায্য করে বুঝতে, কোন সময় কী ধরনের বই উপযোগী হতে পারে।

• ৩-৬ বছর বয়সীদের জন্য

এই বয়সে শিশুরা অনেক বেশি ভিজ্যুয়াল হয়। তাই বড় ও রঙিন ছবি, অল্প লেখা, ছড়া, ছোট গল্প, সহজ বাক্য ওদের জন্য বেশি উপযোগী। এখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে বইয়ের সঙ্গে “বন্ধুত্ব” তৈরি করা।

• ৭-৯ বছর বয়সীদের জন্য

এ সময় শিশুর মনোযোগ কিছুটা বাড়ে, ভাষা বোঝার ক্ষমতাও বেশি হয়। তাই ছোট ছোট অধ্যায়, ছবিযুক্ত গল্পের বই, সহজ উপন্যাস দিয়ে তাদেরকে বই পড়ার ক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এই বয়স থেকেই শিশুদের মধ্যে ধীরে ধীরে “আমি নিজের মত করে পড়তে পারি”—এই আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে।

• ১০+ বছর বয়সীদের জন্য

এ বয়সে অনেকেই পূর্ণাঙ্গ গল্প-উপন্যাস পড়তে পারে। তাই অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য ও সহজ বাস্তবধর্মী কাহিনি হতে পারে শিশুর জন্য আদর্শ। এরকম গল্পে তারা ভাল সাড়া দেয়। ধীরে ধীরে চরিত্র, কাহিনি, প্লট এসব বিষয়ের প্রতি সচেতনতা বাড়ে।

একটা সহজ লক্ষণ হল, শিশু যদি বার বার একই ছবি দেখে গল্প বলতে পারে, যদি কিছুটা সময় ধরে মনোযোগ রেখে বসে থাকতে পারে, তবে ধরে নেওয়া যায়, সে গল্প-উপন্যাসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

প্রথম বই বাছাই করবেন কীভাবে?
শিশুর হাতে প্রথম যে কয়টি বই যায়, সেগুলির অভিজ্ঞতা অনেক সময় আজীবনের জন্য বইয়ের প্রতি তার অনুভূতি ঠিক করে দেয়। অনেকে ভাবেন, “ভাল বই হলেই তো হল!” কিন্তু “ভাল” হওয়া যথেষ্ট নয়, সেই সঙ্গে “শিশুর বয়স, মানসিক অবস্থা ও পছন্দের সঙ্গে মানানসই” হওয়াটাও জরুরি।

প্রথম বই বাছাইয়ের সময় কয়েকটি দিক খেয়াল করা দরকার:

১. বয়স উপযোগী কিনা: বড়দের বই ছোটদের হাতে গেলে তারা জটিলতার কারণে অনেক সময় গল্প বুঝতে পারে না, চরিত্রের অনুভূতি ধরতে পারে না। আবার বড় বয়সী শিশুর হাতে খুব ছোটদের বই দিলে সে বিরক্ত হয়ে যায়, মনে করে, “আমাকে ছোট মনে করা হচ্ছে।”

২. ভাষা সহজ কিনা: প্রথম বইগুলির ভাষা এমন হওয়া ভাল, যেখানে বাক্য ছোট এবং শব্দগুলি পরিচিত। এমন যেন না হয় যে, প্রতি দুই লাইনে থেমে তাকে শব্দ বোঝাতে হচ্ছে। তাহলে শিশু আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে।

৩. বিষয়বস্তু শিশুর পছন্দের সঙ্গে মিলছে কিনা: শিশু যে বিষয়ে আগ্রহী, প্রথম দিকে গল্পগুলি সেই জায়গা থেকে বাছাই করলেই ভাল। কারও প্রাণী ভাল লাগে, কারও মহাকাশ, কারও গাড়ি, কারও ফ্যান্টাসি। আগ্রহের জায়গা থেকেই যদি গল্প শুরু হয়, শিশুর মনে বইয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয়।

৪. বই দেখতে কেমন: শিশুকে প্রথমে টানে “বইটা দেখতে কেমন?” রঙিন ছবি, বড় ফন্ট, পাতার ডিজাইন পরিষ্কার কিনা এসব বিষয় বিবেচনা করুন। এমন বই হাতে নিতে, উল্টেপাল্টে দেখতে চাইবে আপনার শিশু। অনেক সময় গল্পের চেয়েও বইয়ের “লুক” দিয়েই প্রথম আগ্রহ শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে শিশুরা গল্প ভালবাসতে শেখে।

পড়ার জন্য পরিবেশ তৈরি করা
শিশুকে বইয়ের সাথে পরিচয় করাতে গিয়ে অনেক বাবা-মা শুধু বই কিনে এনে রেখে দেন। কিন্তু শুধু বই থাকলেই যে শিশু পড়বে, এমনটা হয়ত না। বই পড়ার জন্য একটি শান্ত ও আমন্ত্রণমূলক পরিবেশও প্রয়োজন।

শিশুর মনে এমন অনুভূতি তৈরি হওয়া দরকার যে, বই পড়া কঠিন কিছু নয়। বরং ঘরের স্বাভাবিক অভ্যাস ও আনন্দের অংশ। এই পরিবেশ তৈরি করা খুব কঠিন নয়। ছোট কিছু পরিবর্তনেই এটি সম্ভব। যেমন:

১. ঘরে ছোট একটা রিডিং কর্নার তৈরি: আরামদায়ক ছোট চেয়ার বা কুশন, খুব উজ্জ্বল নয় বরং নরম বই পড়ার উপযোগী আলো, আর হাতের নাগালে বই রাখার ব্যবস্থা।

অর্থাৎ একটা ছোটখাটো রিডিং নুক বা রিডিং কর্নার। এমন কোণো বসলে শিশুর মনে একটি “নিজস্ব জায়গা”-র অনুভূতি তৈরি হয়, যেখানেই সে শান্তভাবে গল্পের জগতে ডুব দিতে পারে।

২. প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটি পড়ার সময় রাখা: ঘুমানোর আগে ১৫-২০ মিনিট, বা বিকেলে খেলাধুলার পর ১০-১৫ মিনিট। রুটিন তৈরি হলে শিশুর শরীর-মন বুঝে যাবে, এই সময়টা বইয়ের জন্য।

৩. স্ক্রিন বন্ধ রাখাই ভাল: পড়ার সময় টিভি, মোবাইল, ট্যাব এসব দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকলে মনোযোগ ধরে রাখা সহজ হয়।

৪. বাবা-মা নিজেও একই সময়ে বই হাতে নিলে ভাল: শিশুরা দেখে শিখে। বড়রাও একই সময়ে নীরবে বসে বই পড়ছে, এই দৃশ্য তাদের কাছে পরিবারের স্বাভাবিক জীবনযাপনের অংশ মনে হয়।

শুরুতে কীভাবে গাইড করবেন?
শিশু নতুন কিছু শিখতে গেলে শুরুতে একটু আধটু বাধা আসবে। তার মানেই হচ্ছে বিষয়টা আগাচ্ছে, একে থেমে থাকা ভেবে ভুল করবেন না।

বাবা-মা হিসাবে কীভাবে শিশুকে এই বিষয়ে গাইড করবেন তার কিছু কার্যকর উপায় থাকছে।

১. একসঙ্গে পড়া (Shared Reading)

এটি পড়া শুরু করার অসাধারণ একটি উপায়। এক লাইন আপনি পড়বেন, পরের লাইন পড়বে শিশু। বা আপনি গল্প পড়ে শোনাবেন, মাঝে মাঝে সহজ শব্দ শিশুকে দিয়ে পড়াতে পারেন। এতে ওর ভয় কমবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে, আর পড়াকে সে দু’জনের জন্য যৌথ আনন্দের বিষয় হিসাবে দেখবে।

২. ছবির সাহায্যে গল্প বলা

একটি ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা যায়, “এখানে কী ঘটছে বলে মনে করো তুমি?” শিশুকে ছবি দেখে নিজের মত করে গল্প বানাতে দিন। এতে ওদের কল্পনাশক্তি বাড়ে এবং গল্পের ভেতরের বিশ্বকে নিজের মত করে ব্যাখ্যা করতে শেখে।

৩. চরিত্রের কণ্ঠ বদলে পড়া

রাজার গলা একটু গম্ভীর, ছোট শিশুর গলা নরম, ভয়ের জায়গায় শব্দ একটু ধীরে বলা। এভাবে গল্প বললে তা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই পদ্ধতি শিশুর মনোযোগ ধরে রাখার একটি অসাধারণ উপায়। এটি পড়াকেও আনন্দদায়ক করে তোলে।.

গল্প শেষ হলে কী বলবেন?
গল্প শেষ করা মানেই কাজ শেষ নয়। বরং গল্পের আসল শক্তি প্রকাশ পায় যখন গল্প নিয়ে একটু কথা হয়। এই আলাপ শিশুর বোঝার ক্ষমতা, অনুভূতির প্রকাশ এবং চিন্তা করার ক্ষমতা সবই বাড়িয়ে দেয়।

গল্পের পরে কিছু সহজ প্রশ্ন করা যায়: “গল্পের কোন অংশ তোমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগল?” “তুমি হলে কী করতে?”

এ ধরনের প্রশ্ন গল্পকে গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও শিশুকে উৎসাহ দিতে পারে নিজের ভাষায় পুরো গল্পটা বলতে, গল্পের কোনো দৃশ্য আঁকতে এবং কোনো চরিত্র অভিনয় করে দেখাতে।

এসব কাজ গল্পকে বইয়ের ভেতর সীমাবদ্ধ রাখে না। বরং শিশুর জীবনের সঙ্গে গল্পের জগতটি মিশে যায় এবং বইয়ের স্মৃতি আরও দীর্ঘস্থায়ী হয়।

পড়ায় উৎসাহ বাড়ানোর সহজ উপায়
সব শিশু হয়ত সমান আগ্রহ নিয়ে বই পড়বে না। কারও ক্ষেত্রে আগ্রহ তৈরি করতে সময় লাগে। এই আগ্রহ তৈরির ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ কৌশল খুব ভাল কাজ করে।

১. বই যেন শিশুর হাতের নাগালে থাকে

বুকশেলফ খুব উঁচুতে হলে শিশুকে বার বার বলতে হয়। তাই নিচের তাকেই কয়েকটি বই সাজিয়ে রাখা ভাল, যাতে সে নিজের মত করে বই নিতে পারে।

২. একই বই বার বার পড়লে সমস্যা নেই

অনেক শিশু এক বই বার বার পড়ে। এতে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। পরিচিত গল্পের মাধ্যমে সে ভাষা, শব্দ আর গল্পের গঠন অজান্তেই শিখে নিচ্ছে।

৩. বই বাছাইয়ে শিশুকে অংশ নিতে দেওয়া

বইমেলা, লাইব্রেরি, বইয়ের দোকান যেখানেই যান, শিশুকে নিজের পছন্দ মত বই বাছাই করতে দিন। নিজের ইচ্ছায় বই নিলে পড়ার আগ্রহও বেড়ে যায়।

৪. ছোট লক্ষ্য ও ছোট পুরস্কার

তাকে “এই সপ্তাহে ২টা গল্প শেষ করব” ধরনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে দিন। শেষ হলে স্টিকার, প্রশংসা বা ছোট্ট কোনো পুরস্কার দিন। এটা চাপ নয়, বরং পড়াকে একটু মজাদার করে তোলার উপায়।

যে ভুলগুলি এড়িয়ে চলবেন
শিশুকে পড়ার অভ্যাস করাতে চাওয়াটা নিঃসন্দেহে একটি ভাল চাওয়া। কিন্তু কখনও কখনও ভাল উদ্দেশ্য থেকে আমরা বাচ্চাদের ওপর অহেতুক চাপ প্রয়োগ করে ফেলি। যা তাদেরকে ওই কাজ থেকে বরং আরো দূরে ঠেলে দেয়। তাই এক্ষেত্রেও কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

১. জোর করে পড়াতে চাওয়া

শিশু যদি ক্লান্ত থাকে, মন খারাপ থাকে বা খেলতে চায় সেই সময় জোর করলে বইয়ের প্রতি বিরক্তি তৈরি হতে পারে। বই তখন আনন্দ নয়, শাসনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

২. শিশুর পছন্দকে তাচ্ছিল্য করা

অনেকে ভাবেন, কমিক্স বা গ্রাফিক নভেল “আসল বই” নয়। কিন্তু শিশুর পছন্দকে ছোট করলে সে বই থেকে দূরে সরে যায়। বরং তার পছন্দের জায়গা থেকেই ধীরে ধীরে অন্য বইয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

৩. অতিরিক্ত কঠিন বই ধরিয়ে দেওয়া

বোঝার আগেই কঠিন বই দিলে শিশু মনে করে “বই মানেই ঝামেলা!” প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা যত সহজ ও আনন্দদায়ক হবে, পড়ার প্রবণতাও ততই বাড়বে।

৪. ভুল পড়লে বকাঝকা করা

বার বার থামিয়ে ভুল শুধরে দিলে শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস কমে যায়। চেষ্টা থাকলে ধীরে ধীরে শিখে নেবে। ধৈর্যই এখানে মূল চাবিকাঠি।

৫. অন্যের সঙ্গে তুলনা করা

“অমুক এত দ্রুত পড়ে, তুমি পারো না!”—এই ধরনের তুলনা শিশুর নিজেকে ছোট মনে করায়। বই ভালবাসার পথটা তখন আরও কঠিন হয়ে যায়।

যখন শিশু পড়তে চায় না
সব শিশু শুরু থেকেই বই পছন্দ করবে না এটাই স্বাভাবিক। এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের উদ্দেশ্য হল, বইকে শিশুর দৈনন্দিন জীবনের অংশ করে তোলা। কিছু সহজ কৌশল এক্ষেত্রে খুব ভাল কাজ করে।

১. অল্প সময় দিয়ে শুরু করুন: প্রথম দিনেই ২০ মিনিট বসানোর দরকার নেই। ৫ মিনিটই যথেষ্ট। সময়ের সাথে সাথে অভ্যাস তৈরি হলে সময় বাড়ানো সহজ হবে।

২. তার আগ্রহের জায়গা থেকেই শুরু করুন: ফুটবলপ্রেমী হলে ফুটবল-ভিত্তিক গল্প, গাড়ি পছন্দ করলে গাড়ি-কেন্দ্রিক কমিক্স, সুপারহিরোর ভক্ত হলে তার প্রিয় চরিত্রের বই।

৩. বইকে খেলাধুলার মত করে তুলুন: গল্পের চরিত্র হয়ে অভিনয়, “এরপর কী হতে পারে?” এই নিয়ে অনুমান-খেলা, গল্পের দৃশ্য আঁকার ছোট চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি। এগুলি বইকে গেমের মত মজার করে তোলে।

৪. অডিওবুক ব্যবহার করা যেতে পারে: অডিওবুক শুনতে শুনতে হাতে বই ধরলে শিশু গল্পের প্রবাহ বুঝে ফেলতে পারে। শব্দ-চেনা, ছবি-চেনা সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে ঘটে।

৫. মনোযোগ কম থাকলে সময় কয়েক ভাগে ভাগ করুন: একটানা ১৫ মিনিট নয়, ২-৩ মিনিট পড়া, একটু বিরতি, তারপর আবার ২-৩ মিনিট। বড় বইকে ছোট “সেগমেন্টে” ভাগ করলে সহজ লাগবে।

নিরাপদ ও উপযুক্ত বই বাছাই
শিশুরা মানসিকভাবে সংবেদনশীল, তাই বই বাছাইয়ের সময় কিছু বিষয় বিবেচনা করুন। একটি গল্প যদি তার বয়স, আবেগ বা মানসিকতার সঙ্গে না মেলে, তবে তা উল্টো প্রভাব ফেলতে পারে।

বই বাছাইয়ের সময় খেয়াল করুন, এতে অতিরিক্ত সহিংসতা আছে কিনা, খুব ভয়াবহ বা অন্ধকার বিষয় আছে কিনা, বয়সের তুলনায় অতি পরিণত সম্পর্ক বা রোমান্স আছে কিনা, ভাষা কটু বা অপমানজনক কিনা।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, গল্প কি কোনো জাতি, গোষ্ঠী বা শরীরের গড়ন নিয়ে বিদ্রূপ করছে? এ ধরনের লেখা শিশুর মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদী রিডিং প্ল্যান
পড়া যেন দিনের আবেগ অনুযায়ী ওঠানামা না করে, বরং ধীরে ধীরে জীবনের অংশ হয়ে ওঠে—এর জন্য একটি ছোট পরিকল্পনা রাখা যায়। কঠোর নিয়ম নয়, বরং একটি কার্যকর ও সহজ কাঠামো তৈরি করুন। যেমন, মাসে ২-৪টি বই, সপ্তাহে নির্দিষ্ট একটি সময় “শুধু পড়ার” জন্য, পড়া বইয়ের নাম, তারিখ ও অনুভূতি একটি খাতায় লেখা।

আর, আরেকটি বিষয় শিশুদের মধ্যে উৎসাহ তৈরি করতে পারে। তা হল একটি সুন্দর রিডিং জার্নাল। যেখানে থাকবে: বইয়ের নাম, বই কত তারিখে পড়া শেষ হয়েছে, এর সবচেয়ে ভাল লাগা অংশ, নতুন শেখা শব্দ। এই চর্চা শিশুর লেখার ক্ষমতাও বাড়ায় এবং বইয়ের সঙ্গে সংযোগ আরও গভীর হয়।

সবশেষে বাবা-মা বা গার্ডিয়ান হিসাবে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, পাঠ্যাভ্যাস কোনো প্রতিযোগিতা নয়। এখানে প্রথম বা শেষ নেই। কেউ দ্রুত আগায়, কারো একটু সময় লাগে। এখানে মূল বিষয় হল শিশু যেন বইকে ভয় না পায়, বই যেন তার কাছে আনন্দের একটি দরজা হয়ে থাকে। বই যেন বাবা-মায়ের সাথে সময় কাটানোর একটি আন্তরিক মাধ্যম হয়ে ওঠে।

সময়, ধৈর্য আর স্নেহ—এই তিনটি থাকলেই কোনো চাপ ছাড়াই সুন্দর পাঠ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। শিশুর হাতে তাই বই তুলে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। সেই বইয়ের ভিতরের পথটুকুতে তার সাথে কিছুটা পথ হাঁটা, এটাই আসল গাইডেন্স। এখান থেকেই জন্ম নেয় আজীবনের বই-বন্ধুত্ব।