আমরা এখন এআই-এর গভীর যুগে আছি, যেখানে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এআই নতুন কোনো কাজ করতে পারে এমন খবর আসে। কিন্তু আমরা যত দূর এগোচ্ছি, ততই জরুরি হয়ে উঠছে, আরও বড় প্রশ্নগুলি নিয়ে ভাবা। আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছাতে চাই? এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হওয়ার পথে আমরা কীভাবে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করব? আর পাশাপাশি, মানুষ ও এআই—দু’পক্ষই যেহেতু একসঙ্গে পরিবর্তনশীল—আমরা নিজেদের মধ্যে সর্বোত্তমটি কীভাবে গড়ে তুলব?
সম্প্রতি স্যাম অল্টম্যান টাকার কার্লসনের পডকাস্টে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে একটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত দেখা যায়। কার্লসন, ChatGPT–র নৈতিক ভিত্তি নিয়ে অল্টম্যানকে চাপে ফেলেন। তার মতে, এই প্রযুক্তির মধ্যে এক ধরনের ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ভিত্তি রয়েছে—কারণ আমরা ধরে নিই, এটি মানুষের চেয়ে শক্তিশালী এবং আমরা এর কাছে দিকনির্দেশনা চাই। জবাবে অল্টম্যান বলেন, তার কাছে এতে কোনো আধ্যাত্মিকতা নেই। তারপর কার্লসনের প্রশ্ন, “যদি এটি কেবল একটি যন্ত্র হয় এবং যা কিছু এতে ঢোকানো ইনপুটের ফলমাত্র হয়, তাহলে স্বাভাবিক দুটি প্রশ্ন দাঁড়ায়—এর ইনপুটগুলি কী? আর কোন নৈতিক কাঠামোর ভিত্তিতে এই প্রযুক্তি তৈরি?”
আরিয়ানা হাফিংটন
টাইম, নভেম্বর ২৩, ২০২৫
অল্টম্যান এরপর “মডেল স্পেক” কথাটি উল্লেখ করেন—এআই মডেলকে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করবে। ChatGPT–র ক্ষেত্রে তিনি বলেন, মডেলটিকে “মানবজাতির সম্মিলিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, শিক্ষা এসব দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়।” তবে তিনি আরও যোগ করেন, “সবশেষে আমাদের এটিকে একধরনের আচরণে পরিচালিত করতেই হয়।”
এবং এখান থেকেই আসে বহু আলোচিত “alignment problem” বা সামঞ্জস্যের সমস্যা—অর্থাৎ, এআই যেন মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা না করে বা মানুষের অস্তিত্বের ঝুঁকি না তৈরি করে—সেই জন্য এআই–কে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। মূল ধারণাটি আসলে ১৯৬০ সালেই উঠেছিল এআই-এর পথিকৃৎ নরবার্ট উইনারের কাছ থেকে। তিনি সামঞ্জস্যের সমস্যাটিকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেন:
“যদি আমরা আমাদের উদ্দেশ্য পূরণে এমন কোনো যান্ত্রিক ব্যবস্থার আশ্রয় নেই, যার কার্যক্রমে আমরা কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারি না… তাহলে নিশ্চিত হতে হবে যে আমরা যেই উদ্দেশ্য তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছি, সেটিই সত্যিকার অর্থে আমাদের কাম্য উদ্দেশ্য কিনা।”
কিন্তু আসলে এর চেয়েও বড় একটি সামঞ্জস্যের সমস্যা রয়েছে। আর সেটি ১৯৬০-এরও বহু আগে থেকে। আমরা যদি চাই এআই-কে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে, তাহলে আমাদের নিজেদেরই আগে পরিষ্কারভাবে জানতে হবে ঠিক কোন সর্বজনীন মূল্যবোধে আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের নিজেদের ইনপুট কী? আমাদের “মডেল স্পেক” কী? অর্থপূর্ণ জীবন যাপন করতে নিজেদেরকে কী মানদণ্ডে আমরা প্রশিক্ষিত করছি?
কারণ এই প্রশ্নগুলির উত্তর না জানা পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্তই নিতে পারব না, ঠিক কোন ইনপুটগুলি আমরা চাই এআই ব্যবহার করুক।
এমনকি যদি আমরা আজকের মানবসমাজের অবস্থা অনুযায়ী নিখুঁতভাবে এআই-কে সাজাতে পারি, তবুও সেটি সর্বোত্তম ফল দেবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তাই এখনই সময় আমাদের মূল্যবোধগুলি পরিষ্কার করে নেওয়ার। তারপর এর ভিত্তিতে প্রযুক্তি বা এআইকে নির্মাণ করার।
কারণ বর্তমানে আমরা যে সময়ের মধ্যে আছি, সেখানে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে এক গভীর অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। আমাদের আধুনিক দুনিয়ায় আমরা সেই আধ্যাত্মিক ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়েছি, যার ওপর আমাদের সভ্যতাগুলি, পশ্চিম হোক বা প্রাচ্য, দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা বহু শতাব্দী ধরে সেই ভিত্তির আলোয় পথ চলেছি, কিন্তু এখন সেই পরোক্ষ আলোকচ্ছটাও নিভে আসছে। ফলে আমরা দিশাহীন এবং ভাসমান অবস্থায় আছি।
এই ভিত্তি আলোকায়ন যুগ এবং শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে, কিন্তু তারপরও আমরা সেই চিরন্তন সত্যগুলির ওপর নির্ভর করতাম। আমরা হয়ত আগের মত সেগুলি উচ্চারণ করতাম না, কিংবা বিশ্বাসও কমে গিয়েছিল। তবুও আমাদের জীবনযাত্রা সেই মূল্যবোধগুলির দিকনির্দেশ পেত। কিন্তু এখন যেহেতু সেই সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়েছে এবং আমরা চাই এআই যেন মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়—তাই প্রথমে আমাদেরই সেই মূল্যবোধগুলি খুঁজে বের করতে হবে এবং আবার জুড়ে নিতে হবে।
তার নতুন বই, ‘Against the Machine: On the Unmaking of Humanity’–তে পল কিংসনর্থ ব্যাখ্যা করেন যে প্রতিটি সংস্কৃতি আসলে এক ধরনের “পবিত্র শৃঙ্খলা”র ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি লেখেন:
“এটি অবশ্যই খ্রিস্টধর্মনির্ভর হতে হবে এমন নয়। এটি ইসলামি, হিন্দু বা তাওবাদীও হতে পারে।”
আলোকায়ন যুগ আমাদের সেই পবিত্র শৃঙ্খলা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, কিন্তু—কিংসনর্থের ভাষায়—“সমাজ তা টের পায়নি, কারণ পুরোনো সেই পবিত্র শৃঙ্খলার স্মৃতিসৌধগুলি তখনও দাঁড়িয়ে ছিল, যেমন রোমান সাম্রাজ্য পতনের পরেও ভাস্কর্যগুলি দাঁড়িয়ে থাকত।”
আর আমরা আজ যা দেখছি, তা হল—যখন সেই পবিত্র ভিত্তি হারিয়ে যায়, সমাজ যে মূল্য চুকায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
“সমাজের প্রতিটি স্তরে অস্থিরতা—রাজনীতি থেকে শুরু করে মানুষের আত্মা পর্যন্ত।”
এটাই কি আমরা এখন দেখছি না?
কিংসনর্থ লেখেন:
“এটি আমাদের সময়ের অদ্ভুত, উত্তেজনাপূর্ণ, ভেঙে পড়া এবং হতাশায় ভরা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে পারে।”
কার্লসনের সঙ্গে আলাপচারিতায় অল্টম্যান বলেন, এআই-কে মানবজাতির “সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা” দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল—আমরা নিজেরাই কি সত্যিই মানুষ হিসাবে আমাদের সেই পূর্ণ সমষ্টিগত অভিজ্ঞতায় পৌঁছাতে পারছি?
আমরা যখন এমন একটি রূপান্তরমূলক প্রযুক্তি তৈরি করছি—যা আমাদের জীবন সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই বদলে দেবে—তখন নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা এআই-কে এমন মৌলিক এবং অপরিবর্তনীয় মূল্যবোধের ওপর প্রশিক্ষিত করি, যেগুলি আমাদের মানুষ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে।

