এ সংক্রান্ত আগের লেখা: ব্রোকেন উইন্ডোজ তত্ত্ব—বিশৃঙ্খলার সঙ্গে অপরাধের কী সম্পর্ক?

উনিশ শতকে ব্রিটিশ গবেষকরা শহর আর মহল্লার মধ্যে অপরাধের হারের পার্থক্যগুলি খুটিয়ে দেখতে শুরু করেন। কেউ কেউ খুব সাধারণ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন—যেমন, যেখানে দারিদ্র্য বেশি, সেখানে অপরাধও বেশি হয়। তবে কেউ কেউ আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তারা জানতে চেয়েছিলেন, দরিদ্র মহল্লাতেও কেন কোথাও অপরাধ বেশি, আবার কোথাও কম। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষক, জন ম্যাকডোনাল্ড, সম্প্রতি একটি গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘’কিন্তু এই গবেষণাগুলির বেশিরভাগই শুধু তত্ত্ব দিয়েই থেমে গেছে। কীভাবে অপরাধ কমানো যায়, সে ব্যাপারে কিছু বলেনি।’’ তিনি আরও বলেন, এই ধরনের গবেষণা জনস্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণাগুলির মত নয়। ব্রিটিশ চিকিৎসক জন স্নো’র কলেরা নিয়ে কাজের সাথে তুলনা করলে এইসব গবেষণার সীমাবদ্ধতার জায়গাটা বোঝা যায়। স্নো দেখিয়েছিলেন—একটি স্থানের পরিবেশ কতটা জরুরি। তিনি কলেরা বন্ধের একটি সমাধানও দিয়েছিলেন—পানির কূপ আর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা আলাদা করে দিলে পানি থেকে রোগ ছড়াবে না।


এরিক ক্লিনেনবার্গ
দ্য নিউ ইয়র্কার, ২৩ আগস্ট, ২০১৮


অবশ্যই, সামাজিক গবেষকরা অনেক দিন ধরেই অপরাধ নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছেন। যেমন “ব্রোকেন উইন্ডোজ” তত্ত্বটা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক গবেষক জেমস কিউ. উইলসন আর রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞানী জর্জ কেলিং ১৯৮২ সালে ‘দ্য আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনে একটি লেখায় এই তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। তারা বলেছিলেন, অপরাধীরা ভাঙা জানালা বা এলাকার অন্যান্য বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে বুঝে ফেলে—এখানে কেউ কড়া নজর রাখছে না। তখন তারা ভাবে, এখানে অপরাধ করলে ধরা পড়ার আশঙ্কা কম। উইলসন আর কেলিং বলেছিলেন, এটা একেবারে নিশ্চিত না হলেও, এমন ঘটারই সম্ভবনা অনেক বেশি। যেখানে মানুষ নিজেই নিজের পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে, সেসব জায়গার তুলনায় এইরকম জায়গাগুলিতে মাদক কেনাবেচা বেশি হবে। যৌনকর্মীরা রাস্তায় দাঁড়াবে। গাড়িও চুরি হবে।

ব্রোকেন উইন্ডোজ
একটি এক্সপেরিমেন্টে ২,৩৫৬টা পরিত্যক্ত বাড়ির আশেপাশে সহিংস অপরাধ কেমন তা দেখা হয়েছিল।

অপরাধবিজ্ঞানের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার সাইটেশন হওয়া লেখাগুলির মধ্য এই “ব্রোকেন উইন্ডোজ” লেখাটি অন্যতম। এটাকে “পুলিশিং-এর বাইবেল”ও বলা হয়। আশির দশক থেকে অনেক শহর এই তত্ত্বের সুত্র ধরে “জিরো টলারেন্স” পলিসি গ্রহণ করেছে। মানে, ছোট ছোট অপরাধ—যেমন কোনো দেওয়ালে গ্রাফিতি করা, রাস্তায় অনিশ্চিত ঘোরাঘুরি, মদ খাওয়া বা ভিক্ষা করা—এসবের ওপর কড়া নজর রাখা হয়। আর এসব অপরাধ করলে আদালতও কড়া শাস্তি দেয়।

“ছোটছোট জিনিসের যত্ন নিলে, বড় সমস্যাগুলি আটকানো যায়”—এমনটাই বলেছিলেন লস অ্যাঞ্জেলস আর নিউ ইয়র্ক সিটির সাবেক পুলিশ প্রধান উইলিয়াম জে. ব্র্যাটন। তিনি এই তত্ত্ব বিদেশেও কনসালটিং-এর সময় ব্যবহার করেছেন। বাস্তবে এর মানে দাঁড়ায়—আরও বেশি মানুষকে রোধ করা, তল্লাশি করা আর গ্রেফতার করা। বিশেষ করে যেসব এলাকায় অপরাধ বেশি হয়, সেখানকার মানুষদের। এতে একটা ব্যাপার দেখা গেল—পুলিশ সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষদের, টার্গেট করছে—এমন রিপোর্ট বেড়ে গেল।

‘ব্রোকেন উইন্ডোজ’ তত্ত্বটা আসলে ভাবনা হিসাবে যতটা জোরালো, বাস্তবে ততটা নয়। এই তত্ত্বের কিছু সমস্যা আছে। আর সেগুলি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বেশ স্পষ্টভাবেই লেখা হয়েছে। যেমন, কোনো এলাকায় বিশৃঙ্খলা আছে কিনা, সেটা বোঝার জন্য সেই এলাকা‍র ভাঙা জানালা বা গ্রাফিতির থেকে এলাকাটির জাতিগত অবস্থাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে তত্ত্বে কী ভুল আছে, তার চেয়েও মজার হল—তত্ত্বটা কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল, আর মানুষ সেটা কীভাবে বুঝেছে। লেখকদের সেই বিখ্যাত উদাহরণটার কথা স্মরণ করুন—যেখানে তারা বিশৃঙ্খলা শুরু হওয়ার ধাপগুলি বোঝাতে চেয়েছেন…

“প্রথমে একটি জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকে, সেখানে আগাছা জন্মায়, একটা জানালা ভাঙে। প্রাপ্তবয়স্করা উচ্ছৃঙ্খল শিশুদের শাসন করা বন্ধ করে দেয়, আর এতে শিশুরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। পরিবারগুলি এলাকা ছাড়তে শুরু করে, আর তাদের জায়গায় আসে একা বসবাসকারী মানুষজন। টিনএজাররা মোড়ের দোকানের সামনে জটলা বাঁধে। দোকানদার তাদের সরে যেতে বললে, তারা অস্বীকার করে। মারামারি শুরু হয়। যেখানে সেখানে ময়লা জমতে থাকে। লোকজন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মদ খেতে শুরু করে, তারপর একসময় কেউ মাতাল হয়ে ফুটপাথে পড়ে যায়, আর তাকে সেখানেই পড়ে থাকতে দেওয়া হয়। পথচারীদের কাছে ভিক্ষুকরা টাকা চাইতে শুরু করে।”

এরপর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এই পুরো ঘটনাচক্রের শুরু যেটা দিয়ে—যেমন “একটি জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকে” আর সেখানে “আগাছা জন্মায়”—এই ধাপ দুটি মানুষের চিন্তা থেকে একরকম উধাও হয়ে গেছে। তৃতীয় ধাপ—“একটা জানালা ভাঙে”—এই অংশটাই সবাই মনে রেখেছে। এটাকেই লেখার শিরোনামে নেওয়া হয়েছে। তত্ত্ব নিয়ে যত তর্ক, সব এই অংশ ঘিরে। শুরুর আসল সমস্যা দুটি নিয়ে কেউ আর কথা বলে না। সবাই সরাসরি অপরাধের অংশটায় চলে যায়।

আমরা পেলাম “ভাঙা জানালা” তত্ত্ব। কিন্তু “পরিত্যক্ত জায়গা” নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। আর তার ফলে নীতির দিক থেকেও একদম আলাদা প্রতিক্রিয়া এসেছিল। কিন্তু যদি লেখকরা, আর যারা তাদের কথা শুনেছিল, অন্যভাবে ভাবত? যদি ফাঁকা জায়গাগুলির দিকে সেই মনোযোগটা যেত, যা ত্রিশ বছর ধরে পড়েছিল ছোটখাটো অপরাধের দিকে?

কয়েক বছর আগে, জন ম্যাকডোনাল্ড আর চার্লস ব্রানাস মিলে একটা দারুণ রিসার্চ এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেন। সমাজ বিজ্ঞানের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ গবেষণাগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। ব্রানাস বন্দুক-সহিংসতা নিয়ে কাজ করেন। প্যারামেডিক হিসাবে কাজ করার সময় থেকেই তিনি এই বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার সঙ্গে ম্যাকডোনাল্ডের দেখা হয় ২০০০-এর দশকে, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ায়। তারা তখন একসাথে মেডিকেল স্কুলের ট্রমা সেন্টারের আয়োজিত একটা সেমিনারে ছিলেন। সেমিনারের বিষয় ছিল বন্দুক-সহিংসতা। অপরাধ আর এলাকার বিশৃঙ্খলার যোগসূত্র দেখাত যে গবেষণাগুলি তারা দু’জনেই সেগুলির উপর হতাশ ছিলেন। ব্রানাস আমাকে বলছিলেন, “এই সব তত্ত্ব, ‘ব্রোকেন উইন্ডোজ’সহ, শুধু বর্ণনা দিচ্ছিল।” “ঠিক কোন বিষয়কে বিশৃঙ্খলা ধরা হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট ছিল না। আর এগুলির ভিত্তিতে কিছু করাও যেত না। পুলিশি ব্যবস্থার বাইরে অন্য ক্ষেত্রে তেমন কিছু করার সুযোগ ছিল না—যদিও পুলিশি ব্যবস্থা নিজেই ছিল জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়।”

সেইসময়ে তারা নিয়মিত ক্যাম্পাসে দেখা করতে শুরু করেন। তারা তখন দিনরাত এই বিষয়গুলি নিয়েই ভাবতেন। এই সময়েই ব্রানাসকে ফিলাডেলফিয়ার একটা কনফারেন্সে তার রিসার্চ নিয়ে আলোচনা করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে তিনি বলেছিলেন, বন্দুক-সহিংসতার সঙ্গে বস্তুগত বিষয়গুলির সম্পর্ক নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চান। “আমি যখন প্রেজেন্টেশন শেষ করলাম, তখন পেনসিলভানিয়া হর্টিকালচারাল সোসাইটির একজন লোক এগিয়ে এলেন,” ব্রানাস বলেছিলেন। ওই লোকের বিশ্বাস—ফাঁকা পড়ে থাকা সম্পত্তিগুলি সহিংস অপরাধ বাড়িয়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে গরিব এলাকাগুলিতে। আর ফিলাডেলফিয়াতে এমন হাজার হাজার খালি লট পড়ে আছে। পেনসিলভানিয়া হর্টিকালচারাল সোসাইটি বা পিএইচএস-এর কাছে ছিল দারুণ সব তথ্য। আর তারা সাহায্য করতে চাইল।

ব্রানাস আর ম্যাকডোনাল্ড দু’জনেই দারুণ উৎসাহী হয়ে উঠলেন। কারণ, ফেলে রাখা জায়গা আর অপরাধের সম্পর্ক নিয়ে আগেই বেশ কিছু গবেষণা ছিল।

১৯৯৩ সালে অপরাধবিজ্ঞানী উইলিয়াম স্পেলম্যান একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি দেখান, অস্টিনে যেসব ব্লকে ফেলে রাখা বাড়ি ছিল, সেগুলিতে অপরাধের হার ছিল দ্বিগুণ। যেসব ব্লকে এমন বাড়ি ছিল না, সেগুলির সঙ্গে তুলনা করে এই ফল পাওয়া যায়। ২০০৫ সালে সমাজতাত্ত্বিক ল্যান্স হ্যানন নিউ ইয়র্ক সিটির দরিদ্র এলাকাগুলি নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেখান, কোনো এলাকায় যত বেশি ফেলে রাখা বাড়ি ছিল, সেখানে খুনের ঘটনাও তত বেশি। কিন্তু ব্রানাস আর ম্যাকডোনাল্ড আরও গভীরে যেতে চাইলেন। তারা এমন এক গবেষণা করতে চাইলেন, যার জন্য প্রচুর ডেটা লাগবে। আর দরকার হবে একটা নিয়ন্ত্রিত এক্সপেরিমেন্ট। তারা তখন আরও কিছু বিজ্ঞানীকে দলে নিলেন। একজন হেলথ ইকোনমিস্ট, একজন ইমার্জেন্সি মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর, আর একজন মেডিকেল অ্যানথ্রোপোলজিস্ট।

তাদের প্রথমদিকের এক গবেষণায় ফিলাডেলফিয়ায় দুটি সাধারণ এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। একটি এক্সপেরিমেন্টে ২,৩৫৬টা পরিত্যক্ত বাড়ির আশেপাশে সহিংস অপরাধ কেমন তা দেখা হয়েছিল। এই বাড়িগুলি ফিলাডেলফিয়ার অ্যান্টি-ব্লাইট আইনের নিয়ম ভাঙছিল। এর মধ্যে ৬৭৬টি বাড়ি মালিকরা ঠিকঠাক করে ফেলেছিলেন। মানে, শুধুমাত্র নতুন দরজা আর জানালা লাগানো হয়েছিল। আর বাকি যেগুলি ঠিক করা হয়নি, সেগুলি আগের মতই পড়ে ছিল। ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিন বছর ধরে, গবেষকরা প্রতি মাসে এসব বাড়ির আশেপাশের সহিংস অপরাধের পরিসংখ্যান তুলনা করেছেন। একদিকে ছিল সেই বাড়িগুলি যেগুলি ঠিক করা হয়েছে। আর অন্যদিকে ছিল এলাকা অনুযায়ী একইরকম, কিন্তু এখনও খারাপ অবস্থায় থাকা বাড়িগুলি।

দ্বিতীয় এক্সপেরিমেন্টে দেখা হয়েছিল ফাঁকা জায়গার আশেপাশে সহিংস অপরাধ কেমন। গবেষণায় দেখা যায়, ফিলাডেলফিয়াতে এমন ৪৯,৬৯০টা ফাঁকা লট আছে। এর মধ্যে অন্তত ৪,৪৩৬টা লট পিএইচএস ঠিক করে দিয়েছিল। অর্থাৎ তারা জায়গাগুলি থেকে আবর্জনা সরিয়েছিল। জমিটা সমান করে দিয়েছে। ঘাস আর গাছ লাগিয়েছে। যাতে জায়গাটা দেখতে পার্কের মত লাগে। তারা নিচু বেড়াও লাগিয়েছে। যাতে মানুষ হাঁটতে পারে, আর কেউ ময়লা না ফেলে। তারপর ব্রানাস আর তার টিম এই ঠিক করা লটগুলি তুলনা করেছে এমন কিছু লটের সঙ্গে, যেগুলি একই রকম জায়গায় অবস্থিত, কিন্তু যেখানে কিছুই করা হয়নি।

সেপ্টেম্বর মাসের এক উষ্ণ ও হাওয়া-ভরা দিনে আমি ফিলাডেলফিয়ায় গিয়েছিলাম। পিএইচএস (P.H.S.) যেসব জায়গা ঠিক করেছে, সেগুলি দেখতে। কিথ গ্রিন নামে একজন পিএইচএস কর্মী আমাকে তুলে নেন। তার দাড়ি ছিল কালো-ধুসর রঙের। তিনি নীল রঙের একটা ফোর্ড পিকআপ ট্রাক চালাচ্ছিলেন। বললেন, আমরা প্রথমে ওয়েস্ট ফিলাডেলফিয়াতে যাব। ওখানে পিএইচএস ২৩ লাখ স্কয়ার ফুট ফাঁকা জমির দেখাশোনা করে। গ্রিন বড় হয়েছেন ফিলাডেলফিয়ার এমন এক এলাকায়, যেটা এতটাই ধূসর যে মানুষ তাকে “কংক্রিট শহর” বলে ডাকে। তিনি পিএইচএস-এ কাজ শুরু করেন একুশ বছর আগে। প্রথমে ইন্টার্ন ছিলেন। পরে কমিউনিটি গার্ডেন প্রকল্পে যুক্ত হন। আমাকে বললেন, “আমি ভাবিনি যে এতদিন ধরে এই কাজ করব।” “কিন্তু যখন আমরা পরিত্যক্ত জায়গাগুলি ঠিক করতে শুরু করলাম, তখনই মনে হল—এটাই আমার জায়গা।”

গাড়ি চালাতে চালাতে গ্রিন তার শুরুর দিককার একটা কাজের গল্প আমাকে বলছিলেন। “নগর কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছিল দক্ষিণ ফিলাডেলফিয়ার দুই ব্লকের একটা এলাকা পরিষ্কার করতে। সেখানে মানুষ ও পশুর রক্তপায়ী ক্ষুদ্র এক ধরনের কীট মক্ষিকা বা ফ্লি’র উপদ্রব ছিল। আমরা যখন পৌঁছলাম, দেখলাম পুরা জায়গাটা জঙ্গল হয়ে গেছে। আগাছা, লম্বা ঘাস, এলোমেলো গাছগাছালি—সব ছিল। মানুষ ওই জায়গাটা ময়লা ফেলার স্থান হিসাবে ব্যবহার করত।” তাদের টিম শেষমেশ ১২৫টা খালি জমি ঠিক করেছিল। “কাজটা খুব অপ্রীতিকর ছিল,” তিনি বললেন। “কিন্তু যখন শেষ করলাম, তখনই বোঝা যাচ্ছিল এলাকাটা বদলাবে।” “আর মানুষজন এত খুশি ছিল!” “বাচ্চারা দৌড়ে আমার ট্রাকের কাছে ছুটে আসত। চিৎকার করে বলত, ‘মিস্টার কিথ! মিস্টার কিথ! আপনি কি কালও আসবেন?’ তারা আমাকে মিস্টার সফটির (আইসক্রিম ট্রাক) মত দেখে ফেলেছিল।”

গ্রিন ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন ফর্টিয়েথ স্ট্রিট ধরে। রাস্তা ছিল শহরের পশ্চিম পাশে। বললেন, “আপনার চোখ খোলা রাখুন।” চারপাশটা অনেকটা শিকাগোর এনগেলউড আর নর্থ লনডেলের মত লাগছিল। এই জায়গাগুলি আমি আগেও গবেষণার জন্য দেখেছি। এখানে রো হাউজ আর অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং দাঁড়িয়ে ছিল এক সারিতে। কিছু বাড়ি ফাঁকা, কিছু ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর তাদের ঠিক পাশেই খোলা জায়গা। ওই সব জমিতে ছিল ঘন আগাছা, আবর্জনা, আর ছয় ফুট উঁচু ঘাস।

“ওই জায়গাটা দেখছেন?” গ্রিন একটা কর্নার লটে গাড়ি থামালেন। চারপাশে ছিল নিচু কাঠের বেড়া। দুটা বেঞ্চ ছিল, ছাঁটা গাছ আর সুন্দরভাবে কাটা ঘাস। তিনি বললেন, “ওটা আমাদের ঠিক করা জায়গাগুলির একটা। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে—জায়গাটা কেমন পরিচ্ছন্ন আর যত্নে রাখা।”

আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। ছোট্ট পার্কটার মধ্যে দিয়ে হাঁটলাম। কয়েক পা দূরে ছিল একটা ফাঁকা বাড়ি আর বড় একটা খালি জমি। ওখানে ঘাস এতটাই উঁচু আর ছড়ানো হয়ে গেছে যে সেগুলি ফুটপাথ পেরিয়ে রাস্তায় পৌঁছে গেছে। “এই জায়গাটা—একেবারে এলোমেলো,” গ্রিন বললেন। “সম্ভবত মালিক আমাদের কাজ করতে দেয়নি। বা এমন কেউ মালিক, যাকে আমরা খুঁজেই পাইনি। যদি আপনি এই এলাকায় থাকেন, তাহলে এই ধরনের জায়গা থেকে যত ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে তার সব কিছুর সাথেই আপনাকে লড়াই করতে হবে। পোকামাকড়, ময়লা, অপরাধ—সব আসবে এই জায়গা থেকে। আর নতুন কিছু বানানোর চিন্তা থাকলে সেটা আরও কঠিন হবে। মানুষ এইরকম জায়গা দেখলেই পালানোর চিন্তা করে।”

আমরা সরু রাস্তা পেরিয়ে আরেকটা জায়গা দেখতে গেলাম। ঠিক তখন লোরেটা নামের এক তরুণী আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলেন। ত্রিশের কাছাকাছি বয়স। তিনি জগিং করছিলেন। আমি থেমে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি এখানে থাকেন?” “না,” তিনি বললেন। “তবে আমি এই পাড়ায় প্রায়ই হাঁটি।”

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ছোট ছোট পার্কগুলি দেখেছেন? যেগুলির চারপাশে ছোট বেড়া দেওয়া?”

তিনি বললেন, “তেমন খেয়াল করিনি।” একটু তাকিয়ে চারপাশে তাকিয়ে সেগুলি লক্ষ্য করলেন। তারপর বললেন, “তবে দেখতে বেশ সুন্দর।”

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “ফেলে রাখা জায়গাগুলি দেখেছেন? যেখানে আগাছা আর ময়লা পড়ে থাকে?”

“হুম, হ্যাঁ,” লোরেটা হালকা হাসি দিয়ে বললেন। “আমি রাস্তার এই পাশ দিয়ে কেন হাঁটছি জানেন?” একটু থেমে তিনি অন্য পাশের জায়গাটা দেখলেন। বললেন, “এই জায়গাগুলি ভয়ঙ্কর। বোঝাই যায় না ভিতরে কী হচ্ছে, কে আছে। এই এলাকায় এমন জায়গা অনেক আছে। আমি যতটা পারি, এগুলি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।”

গ্রিন আর আমি আবার রওনা দিলাম। তারপর গিয়ে উঠলাম ওয়েস্টমিনস্টার স্ট্রিটে। তিনি একটা বড় খালি জায়গা দেখালেন। জায়গাটা এখন কমিউনিটি পার্ক। স্থানীয় মানুষজন নিজেরাই সেটা বানিয়ে নিয়েছে। সেখানে ছিল পিকনিক টেবিল আর ছোট একটা বাগান। গ্রিন বললেন, “এই ব্লকটা ঠিক করতে এক দোকানদার সাহায্য করেছিলেন। তার দোকান কয়েক ব্লক দূরে। তিনি শুধু চেয়েছিলেন পাড়াটা দেখতে সুন্দর হোক। যেন মানুষ রাস্তায় বের হয়, বাগানে সময় কাটায়।” “এরকম প্রায়ই দেখা যায়। আমরা জায়গাগুলি ঠিক রাখলে, বাসিন্দারাও এগিয়ে এসে নিজের মত জিনিস যোগ করে।”

আমরা রাস্তা পেরিয়ে তিনটা রো হাউজের দিকে গেলাম। বাড়িগুলির দুই পাশে পকেট পার্ক ছিল। কাছে যেতেই দেখলাম, এক লোক বসে আছেন পিকনিক টেবিলে। তার চুল ধূসর। চোখে সানগ্লাস। হাতে কাঠের লাঠি। একটা ফ্লিপ ফোনে তিনি কথা বলছিলেন। পরে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন, “আমার নাম মিকি।” গ্রিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই পার্ক কি এলাকাটাকে বদলেছে?” তিনি বললেন, “আরে, একদম!” তারপর তিনি পাশের বাড়ির বারান্দার দিকে তাকালেন। সেখানে একজন নারী বসে ছিলেন দোলনা চেয়ারে। পরনে সাদা টি-শার্ট আর পায়ে স্যান্ডেল। নাম জয়েস। তিনি খুব আরামে বসেছিলেন। মিকি বললেন, “ওকে জিজ্ঞেস করুন। ও সব জানে।”

জয়েস মাথা নাড়লেন। বললেন, “আমি এখানে থাকছি দশ-বারো বছর ধরে। আমি যখন এসেছিলাম, এই জায়গাগুলি খুব খারাপ ছিল। মাদক এবং খারাপ কাজ হত। ছোটরা ভাল কিছু করত না। লোকজন তাদের কুকুর ছেড়ে দিত, সারা জায়গা ঘুরে বেড়াত। উফ, কী গন্ধ হত!” তিনি মুখটা কুঁচকে একটু কাঁপলেন। “কিন্তু আমি আসার কিছুদিন পরেই জায়গাটা ঠিক করা হয়। টেবিল বসায়, বড় ছাতাও দেয়। তখন থেকেই বাচ্চারা আসা শুরু করে। আমরাও বাগান শুরু করি। আগে সবাই এই ব্লকটা এড়িয়ে চলত। জায়গাটা কুৎসিত ছিল, ভয়ঙ্করও। বুঝতেই পারতেন না, সেই ঝোপ থেকে কখন কে বেরিয়ে আসবে। এখন অবস্থা অনেক ভাল।”

গ্রিন আর পিএইচএস-এ তার সহকর্মীরা মনে করতেন, ফেলে রাখা জমি আর বাড়িগুলি ঠিক করার কারণে দরিদ্র এলাকাগুলির অবস্থা ভাল হচ্ছে। কিন্তু তারা পুরাপুরি নিশ্চিত ছিলেন না। ব্রানাস আর ম্যাকডোনাল্ড একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করছিলেন। তাদের হাইপোথিসিস ছিল—এই সংস্কারের কাজ আশপাশে সহিংস অপরাধ কমিয়ে দেয়। ব্রানাস আমাকে বলেছিলেন, “এসব শুধু বিশৃঙ্খলার চিহ্ন না। এই জায়গাগুলিতে এমনিতেই এমন পরিবেশ তৈরি হয়, যেখানে বন্দুক-সহিংসতা ঘটার সুযোগ বাড়ে। একটা এলাকা হয়ত শুধু দরিদ্র ছিল, কিন্তু এসব থাকলে সেটা হয় গরিব আর ভয়ঙ্কর—দুটাই।”

কারণ খুবই সোজা। ফেলে রাখা বাড়িগুলিতে অপরাধীরা পালিয়ে লুকাতে পারে। অস্ত্র লুকানোর জায়গা হিসাবেও এগুলি ভাল। খালি জমিগুলি মাদক কেনাবেচার জন্য ব্যবহৃত হয়। একদিকে নিয়ম মেনে চলা মানুষরা এসব এলাকা এড়িয়ে চলে। অন্যদিকে পুলিশ এলে মাদক বিক্রেতারা লম্বা ঘাসে তাদের জিনিস লুকিয়ে রাখে। এসব জায়গায় নজর রাখা খুব কঠিন। স্থানীয়দের জন্যেও, পুলিশের জন্যেও।

‘ব্রোকেন উইন্ডোজ’ থিওরির যারা সমালোচক, তারা জানেন—দারুণ সব থিওরি অনেক সময় বাস্তব তথ্যের কাছে হার মানে। আর তাই ব্রানাস খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, যখন তাদের প্রথম গবেষণার ফলাফল এল। এই গবেষণা ছাপা হয়েছিল আমেরিকান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ-এ। সেখানে দেখা যায়, যেসব পরিত্যক্ত বাড়ি সংস্কার করা হয়েছিল, তাদের আশপাশে বন্দুক-সহিংসতা ৩৯% কমেছে। আর যেসব খালি জমি ঠিক করা হয়েছিল, সেগুলির আশেপাশে কমেছে ৫%। কম হলেও এটা গুরুত্বহীন না। এমন ফলাফল সমাজ বিজ্ঞানে খুব কমই দেখা যায়।

আরও একটা বিষয় ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ব্রানাস বললেন, কোথাও প্রমাণ মেলেনি যে সহিংসতা এক এলাকা থেকে পাশের এলাকায় সরে গেছে। অপরাধ আসলেই কমেছে। আর সেই কমা এক-দুই মাসের না। ফলাফল টিকেছিল এক বছর থেকে প্রায় চার বছর পর্যন্ত। এই সুবিধা অনেক বেশি টেকসই, যেটা অন্য অনেক অপরাধ কমানোর প্রোগ্রামে পাওয়া যায় না।

“সত্যি বলতে, ফলাফলটা আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি ছিল,” ব্রানাস বললেন। এই ফল তার সামনে একটা নতুন দিক খুলে দিল—অপরাধ ঠেকানোর এক নতুন পদ্ধতি পেলেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তিনি একধরনের গবেষণার কাজ করেছিলেন। এখন যেটাকে তিনি মনে করেন, একরকম ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্ট। ওই গবেষণা ফোকাস করত যাদের অপরাধ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিল তেমন মানুষদের উপরে। ব্রানাস বললেন, “আমি যখন ইউনিভারসিটি অফ পেনসেলভেনিয়াতে কাজ শুরু করি, তখন আমরা বন্দুক-সহিংসতা কমাতে খুব চেষ্টা করছিলাম। আমাদের দলে দোভাষী ছিল, সোশ্যাল ওয়ার্কার ছিল, কমিউনিটি লিডারও ছিল। তাদের অনেকেই ছিল অসাধারণ। আমাদের কিছু সফলতাও এসেছিল। কিন্তু সেই সাফল্য ছিল স্বল্পস্থায়ী। শেষে যা হল, আমরা হয়ত পঞ্চাশজন বাচ্চাকে সাহায্য করতে পেরেছিলাম। শুধু সেই সময় যারা ছিল, তারাই একটু উপকৃত হয়েছিল।”

এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ অপরাধ কমানোর নীতি মানুষকে শাস্তি দেওয়ার দিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। জায়গাগুলি ঠিক করার দিকটা গুরুত্ব পায় না। প্রেসিডেন্ট “স্টপ অ্যান্ড ফ্রিস্ক” নামে একটা জাতীয় পুলিশ প্রোগ্রামের কথা বলেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল চাইছেন আরও কঠোর সাজা। “ল’ অ্যান্ড অর্ডার” ঘরানার লোকজন আবার সরব হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা হাউজিং সোসাইটি, লাইব্রেরি, প্রবীণদের কেন্দ্র বা কমিউনিটি গার্ডেনের মত জায়গাগুলির জন্য খুব কমই টাকা খরচ করি। অথচ এসব জিনিস মানুষকে রাস্তায় আনে। রাস্তায় চোখ রাখার মত মানুষের সংখ্যা বাড়ায়। আর যেসব এলাকা অপরাধ-প্রবণ, সেগুলির জন্য আমরা তো আরও কম খরচ করি। যেমন অপরাধীদের হটস্পট ফেলে রাখা জমি বা পরিত্যক্ত বাড়ি। ব্রানাসের টিমের মতে, এই জায়গাগুলিই আমেরিকার শহরের প্রায় ১৫ শতাংশ জায়গা জুড়ে আছে।

ফিলাডেলফিয়ার গবেষণা বলছে—মানুষের ওপর না, জায়গা বা পরিবেশের ওপর কাজ করলেই বেশি ফল পাওয়া যায়। ব্রানাস আর তার টিম লিখেছে, “আমেরিকায় লাখ লাখ ফাঁকা আর পরিত্যক্ত সম্পত্তি আছে।” এসব ঠিক করা খুব সহজ। খরচও কম।

সবচেয়ে ভাল ব্যাপার হল, এই প্রোগ্রামগুলিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর খুব বেশি চাপ পড়ে না। আর শুনে অবাক লাগলেও, এগুলির খরচ নিজে নিজেই উঠে আসে। ব্রানাসের টিম লিখেছে, “ফেলে রাখা বাড়ি আর খালি জমি যদি সাধারণভাবে ঠিক করা হয়, তাহলে প্রতিটা খরচ করা ডলারের জন্যে করদাতারা ৫ থেকে ২৬ ডলার পর্যন্ত লাভ পান। আর পুরা সমাজের জন্য এই লাভ হয় ৭৯ থেকে ৩৩৩ ডলারের মত।” মানে, জায়গাগুলিকে ফেলে রাখা শুধু বিপজ্জনক না। এতে খরচও অনেক বেশি পড়ে।

ধীরে ধীরে এই খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। ব্রানাস যখন তার গবেষণার ফল প্রকাশ করা শুরু করলেন, তখন আমেরিকার নানা শহর এমনকি দেশের বাইরের শহরও একই কাজ শুরু করল। কিথ গ্রিন আমাকে বলেছিলেন, “বিগত কয়েক বছরে অনেক শহরের লোক এখানে এসেছে। ডেট্রয়েট, শিকাগো, ট্রেন্টন, এমনকি সিউল থেকেও। শিকাগো থেকে যে লোকটা এসেছিল, সে বার বার বলছিল, ‘অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!’” ২০১৬ সালের মধ্যে তারা দেশের কেন্দ্রীয় অনুদান থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার তুলে ফেলেছিল। তারপর নিউ অরলিন্স, নিউয়ার্ক আর ক্যামডেন (নিউ জার্সি), ফ্লিন্ট (মিশিগান), আর ইয়াংসটাউন (ওহাইও)-এ ব্লাইট-সংস্কার প্রকল্প শুরু হয়। প্রতিটি এক্সপেরিমেন্টেই ব্রানাসের অনুরোধে প্রশিক্ষিত ফ্রন্টলাইন গবেষক আর বেতনভুক্ত স্থানীয় বাসিন্দারা কাজ করতেন।

এই ধারণাগুলি অবশ্য নতুন কিছু না। ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ স্বাস্থ্য গবেষক জন স্নো কলেরার প্রাদুর্ভাব নিয়ে কাজ শুরু করেন। জায়গাটা ছিল লন্ডনের সোহো এলাকার ব্রড স্ট্রিট। তখনকার মানুষ, এমনকি বিজ্ঞানীরাও ভাবতেন রোগটি ছড়ায় “মিয়াজমাটা” বা খারাপ গন্ধ থেকে। কিন্তু স্নো সন্দেহ পোষণ করেছিলেন।

আরো পড়ুন: কলেরার কারণ আবিষ্কার ও জন স্নো

তিনি রোগীদের ম্যাপে বসিয়ে দেখেন, সবাই একটা নির্দিষ্ট পানির পাম্পের চারপাশের। এরপর তিনি স্থানিয় কাউন্সিলকে রাজি করান পাম্পটা বন্ধ করতে। ওই একটা কাজেই মহামারির বিস্তার থেমে যায়। এটাই ছিল এপিডেমিওলজির সূচনা। এরপর জনস্বাস্থ্যেও বড় পরিবর্তন আসে। আর এই বদল শুরু য়েছিল মানুষ নয়, জায়গা নিয়ে ভাবনা থেকে। ব্রানাস বললেন, “আমরা গর্বিত যে এই এলাকার মানুষদের কাজ দিতে পেরেছি। কিন্তু আরও বেশি স্থায়ী সমাধান পাওয়া যাবে—জায়গাগুলি ঠিক করা হলে।”

অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ


এরিক ক্লিনেনবার্গ (Eric Klinenberg) জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৭০, নিউইয়র্ক সিটি

লেখকের পরিচয়

সমাজবিজ্ঞানী এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক এরিক ক্লিনেনবার্গ সামাজিক বিজ্ঞান, নগর পরিকল্পনা ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার জন্য সুপরিচিত।

তিনি খুব সহজভাবে দেখান, কীভাবে সামাজিক অবকাঠামো যেমন লাইব্রেরি, ও বিভিন্ন ধরনের জনপরিসর—একটি সমাজে সমতা, ভাল স্বাস্থ্য এবং সক্রিয় নাগরিক জীবন ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ক্লিনেনবার্গের কাজের বড় অংশ জুড়ে সমাজে মানুষের বিচ্ছিন্নতা এবং বিভিন্ন ধরনের সংকট বা দুর্যোগ নিয়ে বিশ্লেষণ। তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের একটি Heat Wave, যেখানে তিনি ১৯৯৫ সালের শিকাগোর তীব্র তাপদাহ বিশ্লেষণ করে দেখান যে, সামাজিক সম্পর্কের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামো কীভাবে দুর্যোগের সময় মানুষের মৃত্যুহার বাড়িয়ে দেয়।

তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বই Going Solo-তে একাকী জীবনযাপনের বাড়তে থাকা প্রবণতা এবং এর পেছনের সামাজিক কারণ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এরপর প্রকাশিত Palaces for the People (২০১৮) বইয়ে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ভালভাবে পরিকল্পিত এবং যত্ন নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা সামাজিক স্থানগুলিই আসলে বৈষম্য ও সমাজের বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়াই করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।