সিফুডপ্রেমীরা সতর্ক হোন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আপনার প্লেটে থাকা সুস্বাদু টুনা মাছের টুকরাগুলির আকার ছোট এবং দুর্লভ হয়ে যেতে পারে।
গ্লোবাল চেঞ্জ বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণার ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, সমুদ্রে তাপবৃদ্ধির কারণে অনেক প্রজাতির মাছের আকৃতিই ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসবে। এগুলির মধ্যে টুনা মাছ একটা।
গবেষণা দেখিয়েছে, সমুদ্রের তাপ বাড়তে থাকলে মাছেরা শারীরিক বৃদ্ধি ঘটানোর জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না। মাছের মত শীতল রক্ত বিশিষ্ট প্রাণিরা নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। আর সমুদ্রে পানির উত্তাপ বেড়ে গেলে মাছের বিপাক ক্রিয়ারও গতি বেড়ে যায়, ফলে শরীরের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে তাদের আরো বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। মাছ শ্বাস নেয় ফুলকার সাহায্যে, পানি থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন নিয়ে সেখানে কার্বন ডাইঅক্সাইড ছেড়ে দেয়।
মার্লেন সিমন্স
নেক্সাস মিডিয়া নিউজ, ২৯ আগস্ট ২০১৭
সমস্যাটা হচ্ছে ফুলকার ওপরের অংশ মাছের শরীরের অন্যান্য অংশের মতো একই হারে বৃদ্ধি পায় না। এবং গরম পানিতে অক্সিজেন থাকে ঠাণ্ডা পানির তুলনায় কম।
গবেষণা অনুসারে একটা মাছ যদি ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, ধরা যাক সেটা কডমাছ, তাহলে এর ফুলকা বৃদ্ধি পাবে ৮০ শতাংশ। গবেষকরা বলছেন, টুনার মতো দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং বেশি পরিমাণে অক্সিজেন নেয় এমন মাছগুলির আকৃতি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যেতে পারে। অন্যদিকে, ব্রাউন ট্রাউট বা যে মাছগুলি টুনার মতো অত দ্রুতগতির না, প্রত্যেক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ বৃদ্ধিতে তাদের আকৃতি কমবে ১৮ শতাংশের মতো।
নিপন ফাউন্ডেশন—ইউনিভার্সিটি অভ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া নেরিয়াস প্রোগ্রামের ডিরেক্টর অভ সায়েন্স এবং এই গবেষণার সহ-লেখক উইলিয়াম চেয়াং বলেন, একটা সময়ে যখন ফুলকাগুলি আর দীর্ঘকায় শরীরের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে না, তখন মাছগুলি বড় হওয়া বন্ধ করে দেয়। গত কয়েক দশকেই মাছের ওপর এই প্রভাবের ফলে আকৃতি ছোট হয়ে যাওয়া দেখেছি আমরা।
এই গবেষণার লিড অথর এবং সি আরাউন্ড ইউএস-এর প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর ড্যানিয়েল পওলি’ও এই বিষয়ে সহমত জানান। তিনি আলাদাভাবে জোর দিয়ে বলেন, ফুলকা পানি থেকে কী পরিমাণ অক্সিজেন নিচ্ছে তার ওপর মাছকে নির্ভরশীল থাকতে হয়। এই নির্ভরশীলতা বড় মাছের মধ্যে নিজে নিজেই প্রকাশিত হয়। তাপ বাড়তে থাকলে মাছের অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যায়, তখন তারা পরিমাণে কম পায়।
আরো পড়ুন: ‘আর্জেন্টাইন অ্যান্ট’―শত কোটি পিঁপড়ার আগ্রাসী মেগা কলোনি
গবেষকরা প্রথমে নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ-এ ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক রচনায় পানির তাপবৃদ্ধি এবং মাছের আকৃতির ব্যাপারে তাদের তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এটাকে তারা বলছেন ‘গিল অক্সিজেন-লিমিটেশন থিওরি’ বা জিওএলটি। তাদের এই তত্ত্ব থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত ‘ভুল অনুমান’-এর ভিত্তিতে নেওয়া বলে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন নরওয়ে এবং ফ্রান্সের তিন গবেষক।
চেয়াং এবং পওলি এই সমালোচনায় সাড়া দিয়ে ২০১৩ সালে সম্পন্ন গবেষণাকে সঠিক বলে দাবি করেন।
প্রকৃত আকৃতির এক বিন্দুও যদি কমে, তবে মাছ উৎপাদনের সম্ভাব্য হার কমবে। চেয়াং বলেন, সেটা সরাসরি আমাদের ফিশ ইন্ড্রাস্ট্রিকে প্রভাবিত করবে। আর প্রত্যেক ডিগ্রি সেলসিয়াস বায়ুমণ্ডলীয় তাপের কারণে এই ক্ষতির পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। পৃথিবীর কিছু কিছু অংশে এই ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতে পারে। সেখানে মাছের চাহিদার ওর উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা দেবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইতোমধ্যেই মাছের আকৃতি ছোট হতে শুরু করেছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা এর মধ্যেই পানির তাপ বাড়ার কারণে মাছের ওপর কী প্রভাব পড়ছে দেখতে পাচ্ছি। যেমন, আমার ইউকে’র সহকর্মীরা নর্থ সি’র মাছের আকৃতির ওপর দীর্ঘমেয়াদে সংগ্রহ করা তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখেছে, স্টকে গত কয়েক দশকে হেডক এবং সোলের মতো মাছগুলি আকৃতিতে ছোট হয়েছে। আর ওই সংকোচনের কারণ প্রধানত ছিল ওই অঞ্চলের সমুদ্রে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
আরো পড়ুন: গৃহপালিত হওয়ার কারণে ছোট হয়ে আসছে গরুর মস্তিষ্ক
তার উপর, অক্সিজেনের অভাবে মাছগুলি হয়তো একসময়ে শ্বাসরোধ হয়েই মারা যেতে পারে। পওলি বলেন, অক্সিজেনের অভাবে এর মধ্যেই আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে মাছ মরে যাচ্ছে। যদিও অক্সিজেনের ঘাটতি মানেই মাছ মরে যাবে এমন না। ঘাটতি অল্প মাত্রার হলে, মাছের বৃদ্ধি থেমে যাবে মাত্র। এই কারণেই অনেক গরম পড়লে চাষীরা তাদের পুকুরে অধিক বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করেন।
অক্সিজেন ঘাটতি শুধু যে সমুদ্রের জীব জগৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়, এর ফলে খাদ্য শৃঙ্খলের অন্যান্য প্রাণিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পওলি বলেন, তারা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ তাদের শিকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
চেয়াং বলেন, বড় মাছগুলি সাধারণত ছোট মাছগুলিকে খায়। তাই, শারীরিক আকৃতির পরিবর্তন হয়ত খাদ্যজালের মিথস্ক্রিয়া এবং গঠন বদলে দেবে, ফলে বাস্তুতন্ত্র যেভাবে কাজ করত—তাও বদলে যেতে বাধ্য।
নেক্সাস মিডিয়া নিউজ থেকে অনূদিত