মাছেরা কথা বলে—শব্দ তিনটা ছোটবেলার ‘পাখি ওড়ে, মাছ ওড়ে’ খেলার মত মনে হয়। এতদিন হয়ত খেলা বা হাস্যরস হিসেবেই মাছেদের কথা বলার বিষয়টি প্রচলিত ছিল। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, বিষয়টি সত্যি। এবং অনেক দিন ধরেই মাছেরা কথা বলছে। একটি প্রতিবেদনে এ নিয়ে বিস্তারিত ছাপা হয়।


টেসা কুমুন্ডোরোস
সায়েন্স অ্যালার্ট, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২২


ঠিক যেমন বন-জঙ্গলের পরিবেশ পশুপাখির ডাকে মুখর হয়ে থাকে, তেমন বিচিত্র ধরনের কিচিরমিচির, ডাকাডাকি আর কলকাকলীতে পূর্ণ থাকে পৃথিবীর জলজ প্রাণীদের বাসস্থান। উদাহরণ হিসেবে সমুদ্রের যেসব স্থানে প্রবাল প্রাচীর থাকে, সেগুলির কথা বলা যায়। আশ্চর্য রকম কোলাহলে ভরা থাকে এসব স্থান, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কোলাহল সৃষ্টি করে মাছ।

মাছেরা কথা বলে—এটা কতটুকু সত্যি?
নিউ ইয়র্কের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজিস্ট বা পরিবেশবিদ অ্যারন রাইস বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে জেনে এসেছি, কিছু মাছ শব্দ করে। কিন্তু মাছের শব্দ সবসময়ই বিরল আর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচিত হয়।”

এতদিন ধারণা করা হতো, মাছেরা কথা বলতে বা যোগাযোগের জন্য শব্দের বিকল্প হিসেবে প্রধানত অন্যান্য উপায়ের ওপর নির্ভর করে। এসব উপায়ের মধ্যে আছে রঙের সংকেত, শরীরের অঙ্গভঙ্গি কিংবা বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো কৌশল। কিন্তু সাম্প্রতিক বিভিন্ন আবিষ্কারে দেখা গেছে, ঠিক পাখিদের মতো মাছেরাও ভোরে আর সন্ধ্যায় কোরাসের মাধ্যমে একসাথে ডাকাডাকি করে।

গবেষণা
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এভুল্যুশনারি নিউরোসায়েন্টিস্ট অ্যান্ড্রু বাস এর মতে, “এই বিষয়টা অনেকের নজরে না পড়ার সম্ভাব্য কারণ হলো, মাছেদের কথা বলতে শোনা বা দেখা যায় না সহজে। আর পানির নিচের শব্দের মাধ্যমে যোগাযোগ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে তিমি এবং ডলফিনের ওপর ফোকাস করা হয়ে থাকে।”

“কিন্তু মাছেরও কণ্ঠ আছে।”

মাছদের শব্দ যেমন হয়
কিছু শব্দ শুনতে লাগে সবচেয়ে দুর্দান্ত সাইরেন বা বাঁশির মতো। শারীরিক বিবরণ, সাউন্ড রেকর্ডিং ও কণ্ঠস্বর বা ভোকাল অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্যের রেকর্ড নিয়ে ব্যাপক গবেষণার পর রাইস ও তার সহকর্মীরা বেশ কয়েকটি শারীরিক বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেছেন। এসব বৈশিষ্ট্য থাকায় ‘রে-ফিনড’ (অ্যাকটিনোপ্টেরিগি) মাছের গ্রুপ ভোকাল কর্ড ছাড়াই শব্দ করতে পারে। এই গ্রুপে বর্তমানে ৩৪,০০০টিরও বেশি জীবিত প্রজাতি রয়েছে।

আরো পড়ুন: প্রাণীদের পূর্বাভাস ব্যবস্থাপনা

তারা যেভাবে শব্দ তৈরি করে
রাইস সাইফাই ওয়্যার (Syfy Wire) নামের এক ওয়েবসাইটে বলেছেন, “তারা নিজেদের দাঁতে দাঁত ঘষে বা জলে নড়াচড়ার মাধ্যমে শব্দ করতে পারে। আমরা এর সাথে জড়িত বেশ কয়েকটি বিশেষ ব্যাপার দেখতে পেয়েছি।”

মাছেরা কথা
নিউরোসায়েন্টিস্ট অ্যান্ড্রু বাস

“সম্ভবত সবচেয়ে কমন অ্যাডাপটেশন বা অভিযোজনের বৈশিষ্ট্য হলো সুইম ব্লাডার বা মাছের পটকার সাথে যুক্ত পেশী। প্রকৃতপক্ষে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের ঐচ্ছিক পেশী বা কঙ্কাল পেশীর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত সংকোচন হয় টোডফিশের পটকার পেশী। এগুলি হাই-পারফর্মিং বা উচ্চ দক্ষতা সম্পন্ন অভিযোজন।”

সব মাছ কি কথা বলে?
মাছের ১৭৫টি পরিবারের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই শব্দের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে। অর্থাৎ, পূর্বে অনুমান করা এক-পঞ্চমাংশের তুলনায় অনেক বেশি কথা বলা মাছ। বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিবর্তনের ধারায় মাছেদের মধ্যে এভাবে কথার মাধ্যমে যোগাযোগ বা ভোকাল কমিউনিকেশন অন্তত ৩৩ বার স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, মাছেদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার আছে।

মাছের কথা বলার ইতিহাস
আরো কিছু চমৎকার তথ্যের একটা হলো, প্রায় ১৫৫ মিলিয়ন বছর আগে মাছেরা কথা বলা শুরু করে। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ থেকে বোঝা যায়, এ ঘটনা স্থলের মেরুদণ্ডী প্রাণীদের যখন প্রথম কণ্ঠস্বর তৈরি হয়েছিল, সেই একই সময়ে ঘটেছে। আর স্থলের মেরুদণ্ডী প্রাণীদের থেকেই আমরা মানুষেরা শেষ পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছি।

গবেষকরা তাদের গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, “আমাদের ফলাফল দৃঢ়ভাবে এই হাইপোথিসিস সমর্থন করে যে, সোনিফেরাস বিহেভিয়র (অর্থাৎ শব্দ সৃষ্টি বিষয়ক আচরণ) হলো প্রাচীন একটি ব্যাপার। সব মিলিয়ে, এই ফাইন্ডিংগুলি মেরুদণ্ডীদের মধ্যে এই ধরনের চরিত্রের বিবর্তনের পক্ষে শক্তিশালী নির্বাচনের যে চাপ, সেটাই হাইলাইট করে।”

মাছেদের মধ্যে যারা বেশি কথা বলে
কিছু মাছের দল অন্যদের তুলনায় বেশি আলাপি। সবচেয়ে বেশি কথা বলা গোষ্ঠীর মধ্যে আছে টোডফিশ ও ক্যাটফিশ। যাইহোক রাইস এবং তার দল সতর্ক করেছেন, তাদের এই বিশ্লেষণ শুধুমাত্র যেসব মাছ আওয়াজ তৈরি করে, সেগুলি নিয়েই আলোচনা করেছে। যেসব মাছ আওয়াজ করে না, সেগুলিকে বিশ্লেষণে রাখা হয়নি। এমন হতে পারে, আমরা এখনো পর্যন্ত অন্যান্য মাছেদের কথা শোনার মতো যথেষ্ট চেষ্টা করিনি।

আরো পড়ুন: যেভাবে কোনো বস্তুর বয়স বের করেন বিজ্ঞানীরা

খাবার, বিপদের সতর্কতা, সামাজিক ঘটনা (এলাকার দখল নিয়ে ঝগড়া) এবং অবশ্যই যৌনতার মতো বিষয় নিয়ে আলাপ করার চেষ্টা করতে পারে এসব মাছ। অন্তত এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার সম্ভাবনা রয়েছে এসব প্রাণীর। কিন্তু অন্য আর কী নিয়ে তারা কথা বলে, তা কে-ই বা জানে!

প্রায় শূন্য হয়ে আসা প্রবাল প্রাচীর পুনরুজ্জীবিত করার জন্য মাছদের আবার ডেকে আনতে কিছু গবেষক এমনকি পানির নিচে সাইরেনের মতো শব্দ করে মাছেদের গান ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন।

রাইস বলেন, “মাছ সবকিছু করে। তারা শ্বাসের সাথে বাতাস নেয়, তারা ওড়ে, তারা যেকোনো কিছু এবং সবকিছুই খায়। ফলে মাছের ব্যাপারে বা তারা যে শব্দ করতে পারে, সে সম্পর্কে কোনো কিছুই আমাকে অবাক করবে না।”

গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি পিয়ার রিভিউড জার্নাল ‘ইকথিয়লজি অ্যান্ড হার্পিটোলজি’ (Ichthyology & Herpetology)- তে প্রকাশিত হয়েছে।

অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ