ধরেন আপনার নানান বিদেশী বন্ধু আছেন। সেটা কোনো ইয়ুথ সামিটে গিয়ে হয়ে থাকতে পারে। কিংবা নিজেই হয়তো আপনি বিদেশে পড়ালেখা করেন, বা আগে করেছিলেন। কিংবা আপনার বাবা যেহেতু ফ্রান্সের বাংলাদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তা ছিলেন তাই আপনার বিদেশী বন্ধু হয়েছে। কিন্তু এখনকার সাইবার কালে তো এসব দরকার পড়ে না। ইয়াহু থেকে শুরু করে ফেসবুক অবধি গত ২০ বছরে নানান উপায়ে আপনার বিদেশী বন্ধু হয়ে থাকতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে এসব সাইবার-টাইবারে কোনো তেমন নতুন বন্ধুটন্ধু হয় না। একে তো বন্ধু কাকে বলে তা যদি আমাকে বলতে বাধ্য করেন, তাহলে আপনাদের সঙ্গে আমার আলাপই বন্ধ হয়ে যাবে। দুনিয়ায় হেন বস্তু নাই যাকে মানুষে বন্ধু বলে না। আবার হেন ভেজাল নাই যা বাঁধে না তাদের মধ্যে। একজন ফরমান দেবে যে বন্ধুদের মধ্যে বন্ধুদের কাছেই ঋণগ্রস্ত হওয়া অধিক যৌক্তিক, তো আরেক দল ঘোষণা দিয়ে দেবেন বন্ধুত্বের মধ্যে টাকাপয়সার ডিল থাকলে সেই বন্ধুত্ব টেঁকে না। ফলে মাথা পুরা আউলানো অবস্থা।

কিন্তু আজকে আমাদের অধিবেশন বন্ধু বিষয়ে নয়। বলছিলাম যে সাইবারেও আসলে মানুষজন তাদের সঙ্গেই মেশে যাদের সঙ্গে সাইবারের বাইরেও মেশে। উগান্ডা বা উরুগুয়ের কারো সঙ্গে যদি কারো ফেবুবন্ধুত্ব বা সাইবার-যোগাযোগ থাকে তাহলে তাঁরা একত্রে প্রজেক্ট-ফ্রোজেক্ট কিছু একটা করেন বলেই ধরে নেয়া উচিত হবে।

উপরে আমার কল্পিত উদাহরণেও ভেজাল আছে। যদি সত্যিই আপনি আন্ডারগ্রাজুয়েট ইংরাজি দেশে পড়ে থাকেন; কিংবা সত্যিই যদি দূতাবাসে কর্মরত কোনো উচ্চাসন পুরুষ আপনার ছোটবেলার বাবা হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি এখন বাংলাদেশে আছেন এই অনুমানই এত ভুল যে উপরে ওটা লেখার কারণে আমার নিজেরই খুব অশান্তি লাগছে। লিখে যখন ফেলেছি, তখন আর মুছব না। আপনাদেরও কপাল-লিখন যেরকম মোছা যায় না। মোটের উপর বিদেশে পড়ালেখাও করেছেন আবার দেশেও ফিরে এসেছেন এঁরা হলেন রাষ্ট্রীয় কিছু কর্মচারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারসমেত। আরো কিছু আছেন অমুক বা তমুক শিল্পপতির পুত্ররাজি যাঁদের হয়তো এসে সংসদের চেয়ারগুলোতে বসবার পারিবারিক সিদ্ধান্ত আছে।

জিনিসটা যত সোজা মনে করলেন তত একেবারেই নয় কিন্তু। কিন্তু মূল বিষয় হলো, আপনি ঢাকা আছেন, আর আপনার বিদেশী বন্ধু ঢাকায় বেড়াতে আসবেন তিন বা চারদিনের জন্য। বেড়াতে আসা বলতে এখানে কোনো একটা বিজনেস-সামিট হতে পারে, আপনাদের বিল্ডার্স এসোসিয়েশনের উন্নয়নের সূক্ষ্ম দিকগুলোর উপর বক্তৃতা দিতে আসতে পারেন, কিংবা নিছকই আপনাদের গার্মেন্টে ইস্তিরির বড় মেশিনগুলো গরম হয়ে গেলে কোনদিক দিয়ে কীভাবে ঠাণ্ডা করবেন সেই বিষয়ে তালিম দিতেও আসতে পারেন। যেটাই হউক, বাংলাদেশে ওটাই বেড়ানো। তবে বিদেশী হিসাবে তাঁর আসলেই উগান্ডানিয়ান বা সিরিওলিয়ান এমনকি সিরিয়ান না হয়ে প্রকৃত পশ্চিম ইউরোপীয় বা আমেরিকীয় হলে আজকের আলাপটা ভাল হবে। তবে আপনি যদি কাছের কোনো বন্ধুকেই ঢাকা আনতে চান, তাহলে ধরুন সিঙ্গাপুরই হলো।

তো তিনি কী করবেন! গরমে একটু হাঁসফাঁস করতে পারেন, বিশেষত বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠবার আগ পর্যন্ত। সিঙ্গাপুরেরই যদি হন, তাহলে তাও করবেন না। এসব গরমে তাঁর অভ্যাস আছে। তো বিমানবন্দরের ঠিক সামনে থেকে তিনি গাড়িতে উঠবেন। তিনি র‍্যাডিসনে থাকবেন নাকি শেরাটনে তা অবশ্যই তাঁর অফিসের উপর যেমন নির্ভর করতে পারে, আবার আপনার সুপারিশের উপরও নির্ভর করতে পারে। যদি আপনি চান যে তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে, যদি আদৌ সময় পান, সামনের শৃঙ্খলাবদ্ধ সামরিক এলাকা দেখবেন, তাহলে র র‍্যাডিসনেই সুপারিশ করতে পারেন। যদি আপনি প্রতি সন্ধ্যাতেই ঢাকা ক্লাবে পানাহার করাতে নিতে চান, তাহলে হয়তো ইন্টারকন্টিনেন্টাল অধিক প্রায়োগিক হতে পারে।

এমন না যে ইন্টারকন্টিনেন্টালে তুললেই আপনার রূপসী বাংলা আর শেরাটন/ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এর কলোনিয়াল অতীত নিয়ে বক্তৃতা দিতে হবে। তেমনি র‍্যাডিসনে থাকতে সুপারিশ করলেও আপনার বিদেশী বন্ধুর সঙ্গে হোটেলের মালিকানা বা জমি অধিগ্রহণের জটিল বিষয় নিয়ে কথা তুলতে হবে না। তিনিও এসব শুনতে হোটেলে উঠছেন না।

তারপর তিনি ভুস ভুস করে গাড়িতে দু’পাশে জবরদস্তির বৃক্ষশোভিত, আলোমণ্ডিত রাস্তায় আসবেন। বনানীর ফ্লাইওভারে চড়বেন, নামবেন। যদি মধ্যরাত্রির ফ্লাইট হয়ে থাকে, ঢাকার মেঘরহিত আকাশের দিকে একটু তাকাবেন। তারপর জাহাঙ্গীর গেটের দিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে সোনারগাঁও বা রূপসী বাংলা ওরফে ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠবেন। রাত্রি অধিক হলে রুমেই কিছুমিছু খেয়ে টেয়ে দেবেন ঘুম। পরদিন সকালে ওই হোটেলেরই কনফারেন্স রুমে গিয়ে বসবেন। অবশ্যই রাতের পোশাকে নয়। যদি কোনো কারণে তিনি ওই ইস্তিরি ঠাণ্ডা করার কারিগরি বুদ্ধি দিতেই এসে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাঁর গাজীপুরের দিকে যেতে হতে পারে। তখনও অবশ্য আরেকটা ঘনকাচের জানালাসমেত মাইক্রো তাঁকে নিতে আসবে। এই মাইক্রোর জানালা দিয়ে অবশ্যই তিনি তাকাতে পারেন। তবে সম্ভাবনা বেশি তিনি তাঁর দেশে পরিজনদের এই সময়ে ফোন দেবেন। কিংবা জরুরি কিছু ফাইল আইপ্যাড বা এরকম কিছু ইয়েতে ভরে সেগুলো রিভাইস টিভাইস করবেন। তাহলে হোটেল কনফারেন্স কিংবা ফ্যাক্টরির তালিমের পর তাঁর সন্ধ্যাকালে তিনি কই যাবেন তা নির্ভর করবে আপনি তাঁকে পানাহারে কোথায় নিতে চান তার উপরে। এখানে আহারকে খুব একটা বড় করে দেখার চল নেই। সঙ্গ বা বিহার হলো মুখ্য বিষয়। পানও হতে পারে, তবে বাংলাদেশে ওটা নিয়ে আলাপ না বাড়ানোই ঠিক হবে।

বললাম বটে যে ঢাকা ক্লাবে পানাহার, কিন্তু আপনি গল্ফ ক্লাবেও নিতে পারেন। তো আপনি এই বন্ধুকে নিয়ে ঢাকা ক্লাবে যাবেন নাকি গল্ফ ক্লাবে যাবেন তা আসলে আপনার বর্তমান ব্যবসাপাতি ও মেলামেশার ধরনের উপর নির্ভর করে। দুই জায়গাতে যাবার পক্ষেই কাঁড়ি কাঁড়ি যুক্তি আছে। গুলশান ক্লাবে যাবেন না তাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে আপনি যদি সেয়ানা হোস্ট হোন, তাহলে গুলশান ক্লাব আপনার দ্বিতীয় সন্ধ্যার ট্রিট হলেও হতে পারে, পয়লা দিন নয়। আবার আপনি বা আপনার বৈদেশী বন্ধু সাংস্কৃতিকমার্কা বা হেরিটেজ মার্কা হলে দ্বিতীয় রাত্রিতে আপনার তাঁকে পুরান ঢাকায় নিয়ে যাওয়া এবং গরুর-ভেড়ার কান-লেজ বা এরকম বিশেষায়িত কিছু খাওয়ানো অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হবে। ফলে কোন সন্ধ্যায় কোথায় যাচ্ছেন তা অনেকগুলো মৌলিক দশার উপর নির্ভর করে। আর অবশ্যই করে বন্ধুটি কয়দিন থাকবেন তার উপর।

এই পুরা আলাপেই আমরা হোস্ট এবং গেস্ট উভয়কে পুরুষ আন্দাজ করে আগাচ্ছি। এমন নয় যে আমাদের কোনো সংস্কার আছে। তবে আপাতত এভাবেই আজকের আলোচ্য বিষয়টি সকলের জন্য সুগম থাকবে। তো বন্ধুটি আমাদের সাংস্কৃতিকসংবেদসম্পন্ন। মানে কিনা কালাচারাল সেন্সিটিভিটি আছে তাঁর। যদি থাকে তাহলে তিনি “আমারে ঢাকার নাইটলাইফ দেখাও” হয়তো বলবেন না। বলবেন “তোমাদের ইয়ুথদের দেখতে চাই।” ডিনারের পর তিনি নাইটলাইফ উচ্চারণ করুন আর ইয়ুথ উচ্চারণ করুন, মোটের উপর আপনি কাছাকাছি জায়গাতেই নিয়ে যাবেন। বিলিয়ার্ড বোর্ড, কিছু গোপন বাংলাদেশে অনুচ্চারণযোগ্য পানীয়, অল্পবিস্তর আইনী সীমানার মধ্যকার হুক্কা, কথা বোঝা যায় না এমন কিছু গানবাজনার ব্যাপক শব্দ, আর পর্যাপ্তসংখ্যক যুবক-যুবতী। মোটামুটি এই হলো এই জায়গাগুলোর উপাদান। আপনি নিয়ে যাবেন।

তো তিন দিন বা আড়াই দিন পর যখন এই লোক নিজের দেশের জন্য আবার হোটেল থেকে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলেন, তখন ঢাকার যে চেহারা প্রতিমূর্তি মাথায় নিয়ে গেলেন সেটাতে গরিব ঢাকা কই? কী বুঝলেন এর থেকে? আপনিও যখন সিঙ্গাপুর, রোম, প্যারিস, আমস্টারডাম, বস্টন, নিউ ইয়র্ক যান তখন যেই শহরটা আপনি দেখেন সেটা হলো আপনার এই বন্ধুর মতো করে দেখা শহর। এর নাম হলো পর্যটকীয় চোখে দেখা। আপনি যখন সেসব শহরের রাস্তাতে ভুস ভুস করে বৃক্ষরাজি ও ফুলদল দেখতে-দেখতে আগান তখন ঠিকই আপনার চোখে বিদ্যুৎকর্মী, সাফাইকর্মী কেউই পড়ছেন না। কয়লা খনির শ্রমিকদের চোখে পড়ার অবশ্য এমনিতেও কারণ নাই। কয়লা খনি থাকে শহর থেকে মেলা দূরে। আর সেখানকার খনিশ্রমিক মরলেও বাঁশখালীর মতো গুলিতে না মরে, চাপা পড়ে মরে যেতে পছন্দ করেন বেশি। খবর বা টিভিতে তাঁদেরও আয়ু এক বা দেড় দিন।

এদিকে সুয়ারেজ বা হাগুকর্মীদেরও দেখার সম্ভাবনা কম। অমিতাভ বচ্চন যে ধরনের সুয়ারেজে আমজাদ খান প্রমুখদের পিছনে দৌড়াদৌড়ি করেন, ঠিক সেরকম বড় ও দৌড়ের উপযুক্ত না হলেও, তাঁদের কাজ করার কথা রাস্তার নিচে। হয়তো ঠিক যখন আপনি ওই রাস্তা দিয়ে ভুস ভুস করে যাচ্ছেন আর পিংক ক্যাসিয়া বা কোনো একটা ফুল দেখছেন তখনও তাঁরা নিচে থাকতে পারেন। কিন্তু দেশে ফিরে ওসব দেশের চকচকা ভাব যখন চকচক করা গোল গোল চোখে বলতে থাকেন তখন এইসব অদৃশ্য শ্রমিকের যে আপনি জানেন না তা বিলক্ষণ বোঝা যায়।

আমাদের আজকের বক্তব্য হলো এই যে পর্যটক-আপনি যে বিদেশের শহরে ঘুরে শ্রমিকবিহীন শহর দেখেন, ওইটা আপনার চোখের ঘোরতর সমস্যা। আবার ঘোরে-থাকার সমস্যা। ডাক্তারদের কিচ্ছু করার নাই এমন সমস্যা। ছোট লোকদের ঢেকেঢুকে রাখতে পারাই বড় শহর হয়ে উঠবার প্রধান শর্ত।

আদাবর, ২৩ এপ্রিল ২০২১ 

কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. শরৎ চৌধুরী, ২০১৭