কেউ যখন আপনার সঙ্গে নিজের অবস্থার তুলনা করতে শুরু করে, সে আর আপনার বন্ধু নাই।

সে অলরেডি সইরা গেছে আপনার থেকে। ওই বন্ধুত্বটাও মৃত ততক্ষণে। সে শত্রুও না, যেহেতু কোনো অ্যাকশন নেয়া শুরু করে নাই।

আমার ক্ষেত্রে এইটা অহরহ হয়। অনেক বন্ধু, তারপর কী হয়, তারা আমারে আর দেখতে পারে না হঠাৎ কইরা। বিশেষত যখন আমি আমার ক্রিয়েটিভ দিকগুলিতে অনেক অ্যাকটিভ হই। এবং পরিস্থিতি সর্বোচ্চ খারাপ হইলে তাদের কথাগুলি সাধারণত এরকম হয়―”নিজেকে কী মনে করো, তুমি এমন কিছু না। হইয়া উঠতে পারো নাই এখনো কিছু, আগে হও তারপর কথা বইলো!” এরকম আরো অনেক কিছু।

যেগুলির ৯৯ শতাংশই মিন ও রুড। এই পরিস্থিতিতে আমি এই পর্যন্ত ৩ বার পড়ছি। কিন্তু তার পিছনে আরেকটা জিনিস আমি দেখি। ছদ্ম নিয়া থাকে, তা হইলো―আমি ‘যা-ই’ হইছি, তাদের তা না হইতে পারা।

এর মধ্যে “আচরণ ঠিক করো” কথাটা আমার হাস্যকরই লাগে। আমি ভিন্ন মানুষ। তাদের কথা বা আচরণের প্রতি আমার রেসপন্স তাদের মত হবে না। আমি রুড হইলে তারা বলতে পারে যে এই জায়গাটাতে রুড হচ্ছো। কিন্তু “রুড কেন হবা” ধরনের সম্পর্ক ভালো কি? এইটা টক্সিক বন্ধুত্বের লক্ষণ। প্রথমত আপনাকে বলার পরিবর্তে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, আপনার আচরণ ঠিক কইরা দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয়ত, আপনার আচরণের মালিকানা যে তার তা বলা হচ্ছে।

আচরণ কী হবে আপনার তা কি ঠিক কইরা দিতে পারে কেউ? বিশেষত আপনি যার চাকরি করেন না?

আমি বন্ধুত্বকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মত দেখতে পছন্দ করি না। আমার বন্ধু আর কারো বন্ধু হইতে পারবে না, তার আমার সঙ্গে এই এই কথা বলতে হবে, দিনে এতবার অন্তত কথা বলতে হবে, কেন নিজ থেইকা সব বলবে না, এইটা কেন বলবে না আমাকে ওইটা কেন বলবে না, কেন আরেকজনের সঙ্গে ঘুরতে যাবেএগুলি দাম্পত্য, বন্ধুত্ব না। অনেক প্রেমিক-প্রেমিকারাও এরকম সম্পর্কে থাকে অবশ্য।

যেই কারণে বেস্ট ফ্রেন্ড নামক জিনিসটা বিরক্তিকর লাগে আমার। আপনি সারাক্ষণ একটা মানুষের সঙ্গে কীভাবে আলাপ করবেন? ২৪ ঘণ্টা একটা চেহারা নিয়া কি বইসা থাকা যায়, তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব? আবার সব কথা তাদেরকে বলতে হবে। নাইলে বলবে, আমাকে তো বললি না।

এই জিনিসটা বেশির ভাগ মানুষ সাপোর্ট করে। অর্থাৎ, পারসোনাল স্পেস ও প্রাইভেসি পুরাপুরি নষ্ট করতে থাকার মাধ্যমে বেস্ট ফেন্ড ধরনের ফ্রেন্ডশিপগুলি টিকা থাকে।

এইটা যেকোনো টক্সিক রিলেশনশিপের চেয়েও টক্সিক।

আমি ভাই ক্রিয়েটিভ লোক। নিজের মত থাকতে আমি যতটা চাই, তারচেয়ে অনেক বেশি এইটা আমার দরকার।

যার ক্রিয়েটিভিটি নাই তার তো দশ হাজার বেস্ট ফ্রেন্ড থাকলেও সমস্যা নাই, সে পারলে বিয়া করবে বন্ধুত্ব করার আগে।

আমার তো বন্ধুত্ব নামক বিয়া বা অন্য যেকোনো বিয়া টিকায়া রাখার মত টাইম নাই। এইটা বন্ধুলোকেরা বুঝতে পারে না।

তো ক্রিয়েটিভ লোক হিসেবে, আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া হচ্ছে গ্রো করা। ক্রিয়েটিভ উন্নতি, শিফটিং, নিজের ভুল ধরতে পারা, নিজেকে চ্যালেঞ্জ করা, নিজেকে মনিটর করা এই সবকিছু তো আমাকে টানবেই। কিন্তু তার জন্য আমার একা থাকা প্রয়োজন। দীর্ঘ সময়, বিরতিহীনভাবে। পারসোনাল স্পেস ও কোনো কিছু শেয়ার না করার, কথা না বইলা থাকার স্বাধীনতা দরকার।

যিনি ক্রিয়েটিভ না, তিনি তার জায়গাতেই থাকতেছেন। তার চেয়ে যে অনেক অনেক উপরে উইঠা গেছে, সে চায় অয় নিচে নাইমা আইসা আমার পাশে বইসা থাক।

এখন আমার কি আমার লেভেল ছাইড়া নিচে নাইমা থাকা সম্ভব? তাইলে আমার নিজের লেভেলে যে গ্রোথ সারাক্ষণ হচ্ছে, তা আমি কীভাবে পাবো?

দেখা যায়, নন ক্রিয়েটিভ বন্ধুরা নিজেদেরকে ক্রিয়েটিভ বন্ধুদের সমানে রাখতে চায়। তা হয় না।

হায়ারার্কি ছাড়া সম্পর্ক হয় না। যিনি আপনার চেয়ে বড়, যিনি আপনার চেয়ে ভিন্ন―তার বড়ত্ব ও ভিন্নতা মাইনা নিয়া সঙ্গে থাকাই বরং সম্পর্ক।

পৃথিবীর ভালো বন্ধুত্বগুলি এমন। ক্রিয়েটিভ ও নন ক্রিয়েটিভ ধরনটা বিশেষত।

দেখবেন সায়েন্টিস্টের বন্ধু যদি হাউজ ওয়াইফ হয়, বন্ধুত্ব টক্সিক না হইলে এবং ভালো হইলে হাউজ ওয়াইফ স্বীকার করে তার বন্ধু সায়েন্টিস্ট। এবং তার বন্ধু যে অবশ্যই তার চেয়ে বড়, সেইটা সে মানে ও প্রকাশ করতে ভয় পায় না।

তো এই হায়ারার্কি যখন বিদ্যমান ও প্রকাশ্য, সায়েন্টিস্ট কি নিজেকে তার হাউজ ওয়াইফ বন্ধুর চেয়ে ছোট ভাববে না বড়? সে ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে বড়দের, ভাববেও নিজেকে বড়। যে নিজেকে আপনার চেয়ে বড় ভাবে (আপনারও তাতে সমস্যা নাই), সে আপনার চেয়ে বড় হিসেবেই কথা বলবে আপনার সঙ্গে।

গুড ফ্রেন্ডশিপ বা হিংসা নাই এমন বন্ধুত্বে এগুলি ম্যাটার করে না। ডমিনেট কে করবে তা ভিন্ন জিনিস।

আপনি জামাই বিয়া করতে চান আপনার চেয়ে অনেক অনেক উচ্চশিক্ষিত, যোগ্যতাসম্পন্ন। তা স্বীকার করতে আপনার সমস্যা নাই। কিন্তু আবার বন্ধু আপনার চেয়ে বড় হইলে তা আপনি নিবেন না। ক্রিয়েটিভ হইলে, বলবেন, তুমি এমন কিছু হও নাই রিয়া!

আমি হই নাই, তুমি হও। আমারটা না হইলে নিজেরটা হও। কিন্তু তুমি হও নাই তাই আমিও হই নাই, এইটা অবাস্তব চিন্তা।

গ্রিনরোড, ১২ জুন ২০২১
কভারে অর্জয়িতা রিয়া