আজ, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, রোজ রবিবার, ইতালির সংসদ নির্বাচনের ভোট অনুষ্ঠান অইতাছে। ইতালির জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষের ৪০০ জাতীয় সংসদ সদস্য (দেপুতাতি > ডেপুটি বা এমপি) ও উচ্চ কক্ষের ২০০ সদস্য (সেনাতরি > সিনেট) নির্বাচনের এই ভোট।
এই প্রথম ১৮ বছর বা তার অধিক বয়সী সকল ইতালিয়ান নাগরিক ইতালির উভয় কক্ষের নির্বাচনে ভোট দিতাছে। আগের নিয়মে নিম্নকক্ষে বা দেপুতাতি নির্বাচনে ভোট দেয়ার সর্বনিম্ন বয়স যদিও আঠারো বছরই আছিল, কিন্তু সিনেট নির্বাচনে ভোট দেয়ার সর্বনিম্ন বয়স আছিল ২৫ বছর। ২০২০ সালে এক গণভোটে পাশ হওয়া সংবিধান সংশোধনীর বলে বর্তমান আইন বলবৎ হইছে। ঐ সংশোধনীতে দেপুতাতির আগের সংখ্যা ৬৩০ থিকা কমায়া ৪০০ আর সিনেটের সংখ্যা ৩১৫ থিকা কমায়া ২০০ করা হয়। ভোট শুরু হইছে সকাল ৭টায়, চলবে রাত ১১টা পর্যন্ত।
যদিও আমি এই নির্বাচনের ভোটার না তবুও বেলা ১২টা নাগাদ বাসার কাছের একটা ভোট কেন্দ্রে ভোট দেখতে গেলাম। আমার পোলার স্কুলে এই ভোটকেন্দ্র করা হইছে। স্কুলের দুইটা গেট খোলা, মেইন গেটে কয়েকজনের একটা লাইন থাকলেও অন্য গেটে কাউরে তেমন দেখলাম না।
কয়েকটা ছবি নিলাম। যহন চইলা আইতাছি তহন রাস্তার শেষ মাথায় প্রতিবেশী আনজেলোর লগে দেহা। আনজেলো লারোক্কা রোম কমুনে ফটোগ্রাফারের চাকরি করত, ইদানিং পেনশনে গেছে। আমারে জিগাইল, কেন্দ্রের সামনে বড় লাইন আছে কিনা। আমার “আছে” শুইনা সে প্রায় অ্যাবাউট টার্ন অইতেছিল, আমি আবার কইলাম, কয়েকজনের লাইন মাত্র। তারপর আনজেলোর মনে অইল ও কইল যে সে মাস্ক নিয়া আহে নাই, আর এই অছিলায় সে ফিরা যাওনের জন্যে পা বাড়াইল। আমি কইলাম, যারা ঢুকতাছে আর বাইর অইতাছে তাগর কারো মুখে তো মাস্ক দেখলাম না! আমার কথা হুইনা আনজেলো কেন্দ্রের গেটের দিকে ফিরল।
কিছুদূর আগাইতেই দেখা কিয়ারার লগে, কিয়ারাও আমার প্রতিবেশী, জন্মসূত্রে সে দক্ষিণ ইতালির রেজিওনে পুলিয়ার অধিবাসী। রোমের লা সাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকাল থিকা এই এলাকার বাসিন্দা। সে বছর দুই অইল মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর অইছে, এহন কোনো এক প্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলিংয়ের চাকরি করে। সে সৌজন্য বিনিময় কইরা কইল ভোট দিতে যাইতেছে। সে কইল, লাইনে যাতে খাড়াইতে না অয় সেই জন্যে দুপুরের খাওয়ার সময় ভোট দিতে আইলাম, এহন তো তুমি কইতাছ ঐহানে লাইন আছে। ইতালিয়ানরা সব আমার নাহালই চালাক!
সে হো হো হাসল। আমি তারে জিগাইলাম, এইবার কি গতবারের তুলনায় বেশি মানুষ ভোট দিবে? হ্যায় কইল, থিওরেটিকালি তাই অওনের কথা। তয় খুব যে বেশি হবে তা জোর দিয়া কওন যায় না। হ্যায় আরো কইল, এই ভোটটা খুউব ইম্পর্ট্যান্ট। আমি কইলাম, কেন?
হ্যায়—পরিবর্তন দরকার না!
আমি—পরিবর্তন অইব?
হ্যায় অনাস্থা সুলভ একটা হাসি দিয়া ভোট দিতে চইলা গেল।
ফিরার পথে বাসার কাছে দেখলাম কোনার রেস্টুরেন্টে বাইরে বইসা জুলিয়া আর লুকা লাঞ্চ করতাছে। অরা সমবয়সী, একসাথে থাকে, বয়স ৩৫/৩৬, লুকা কম্পিউটার প্রোগ্রামার আর জুলিয়ার পেশা সম্বন্ধে জানি না। আমার দোকানের রেগুলার কাস্টমার, প্রতিবেশী ও ফ্রেন্ডলি। জিগাইলাম, ভোট দিছ? জুলিয়া কইল লাঞ্চ সাইরা ভোট দিতে যাবে, লুকা রেজিওনে মলিজের ভোটার তাই তার ভোট দেয়া অইব না এবার।
তারপর বিকাল বেলা যখন দোকানে বইসা এই ডায়রি লেখতাছি তখন এক নাম না জানা কাস্টমার দোকানে ঢুকলে তারে জিগাইলাম হ্যায় ভোট দিছে কিনা। তার বয়স ৫০-এর ঘরে। হ্যায় কইল, ভোটকেন্দ্র যদিও তার বাসার বগলেই কিন্তু হ্যায় ভোট দেয় নাই, দিবেও না, তার বউ অবশ্য সকাল বেলা ভোট দিয়া দিছে, কিন্তু তার এই ব্যাপারে কোনো ইন্টারেস্ট নাই। হ্যায় কইল, যারা ভোটে খাড়াইছে তাগর কারো উপরে তার বিশ্বাস নাই। হ্যায় কয়, এইসব বাম-ডান-মধ্য সব ভুয়া, এগোর কোনো আইডোলজি নাই।
তারপর দোকানে ঢুকল আলেসান্দ্রো, পিয়ানোবাদক, আমার দোকানের সামনের দালানের বাসিন্দা, বয়স ৪০-এর ঘরে, জিগাইলাম ভোট দিছে কিনা। হ্যায় কইল, কেবল ভোট দিয়া আইল। আমি জিগাইলাম ভোটকেন্দ্রে ভোটার কী রকম? সান্দ্রো একটু স্কেপটিকাল। কয়, না, তেমন ভোটার কই! এহনতরি ভোট দেওনের হার তো কমই হুনতাছি।
আলেসান্দ্রো বাইর অইতে না অইতেই দোকানে ঢুকল ফ্রাঙ্কো, আমার ও আমার পরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রতিবেশী ও রেগুলার কাস্টমার। বয়স ৮৫, তার জন্যে দোকানে একটা টুল আছে, সে তার টুলে বইতে বইতে কইল, কেবলমাত্র সে তার ভোট দিয়া আইল।
ফ্রাঙ্কো সারাজীবন খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাট আর ডানদের ভোট দিছে, এই কথা সে লুকানোর প্রয়োজন মনে করে না, আজকেও যে তার নড়চড় অয় নাই তা তার কথার ঢঙেই বুঝা গেল। হ্যায় কইল, ভোটকেন্দ্রে গিজ গিজ করতাছে ভোটার। ফ্রাঙ্কো ঘোষণা করল, এইবার একটা জোয়ার আইছে, মেলোনি জোয়ার! এইডা হ্যায়ও দেখছে, অন্যরাও দেখছে, তাই ভোট দেওনের জন্যে সব ঝাপায়া পড়ছে।
আমি কইলাম, মেলোনি জোয়ারের মাজেজা কী! ফ্রাঙ্কো আমতা আমতা শুরু করল, কয়, হ্যায় তো কহনও ক্ষমতায় আছিল না, অন্যরা যারা ক্ষমতায় আছিল তাগর মুরাদ তো দেখা অইছে। আমি কই, মেলোনি তো বের্লুসকুনির সরকারের মন্ত্রী আছিল। ফ্রাঙ্কো কয়, যুবক কালে, হে তো মেলা আগে!
আমাগো আলাপ আর আগাইল না, তিনজন কাস্টমার একলগে দোকানে ঢুকল, ফ্রাঙ্কো তার মাইয়ার টেলিফোন পাইয়া দোকান থিকা বারায়া গেল।
আরো পড়ুন: ইতালিতে করোনায় এত বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কারণ কী
রাত দশটার দিকে দোকান বন্ধ করতাছি, এমন সময় লুকা ঢুকল কিছু সদাই কিনতে। আমি জিগাইলাম, জুলিয়া কি ভোট দিছে শেষমেশ? লুকা কইল, বাসায় ঢুকার পর দুইজনেরই চোখ জড়ায়া আইতেছিল, তো পইড়া রইল বিছানায়, এই সে এতক্ষণে উইঠা আইল, জুলিয়া এহনো বিছানায়।
আমি কইলাম, ভোট দুইডা তাইলে মাটি অইল, আইলসামিতে ডেমোক্রেসি মাইর খাইল। লুকা—হ, টিকিট কাইটা তিন ঘণ্টার জার্নি কইরা গিয়া কইতে অইত এইডা এইডা চোর তারপর আবার টিকিট কাইটা তিন ঘণ্টায় ঠেঙ্গায়া ঠেঙ্গায়া ফেরন, এই ডেমোক্রেসি ধুইয়া পানি খাইলে আমার দিন যাবো! কয়দিন পর যহন বাড়তি বিল পরিশোধ করা লাগবে তখন পাবলিক টের পাবে এটা কীসের ডেমোক্রেসি!
ভিয়া জিওভান্নি মিনগাজ্জিনি, রোম, ইতালি, ২৫ অক্টেবর ২০২২
লেখক পরিচিতি
ফরিদ আহম্মেদ, নথিপত্রের নাম ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ, জন্ম ১৬ নভেম্বর ১৯৬৫। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থিকা পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর। হর্টিকালচারের পুস্তিকা অনুবাদ দিয়া রুটিরুজি শুরু। সরকারি চাকরি: পরিসংখ্যান প্রভাষক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ (১৯৯৩), নির্বাচন কমিশন (১৯৯৩-২০০২), শ্রম মন্ত্রণালয় (২০০২-২০০৫)। ২০০৫ সাল থিকা ইতালিতে বসবাস। পুস্তিকা: একা ফরিদ আহম্মেদ (সাহিত্য, ১৯৯১), আমার জুতার গল্প (সাহিত্য, ১৯৯২), মানে কিছুই না- একটা যৌথ প্রচেষ্টা (দীর্ঘ কবিতা, ১৯৯৮); সম্পাদনা: চলক (গণিত ও পরিসংখ্যান বিষয়ক সাময়িকী, ১৯৮৮-১৯৯১), রকবাজ (সাহিত্য সাময়িকী, ২০০৫)।