পাখিদের একটানা আকাশে ওড়ার আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে সমুদ্র উপকুলীয় একটি পাখি। গত বছর অক্টোবর মাসে কানাডার সিটিভি নিউজ এই তত্য সম্প্রচার করেছে। জানা যায়, আমেরিকার আলাস্কা থেকে ১২ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পথ একটানা পাড়ি দিয়ে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছায় পাখিটি।

দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বার-টেইলড গডউইট নামের এই জাতের পাখিগুলি প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিতে অভ্যস্ত। কিন্তু এর আগে তাদের কেউ একটানা এতটা লম্বা পথ পাড়ি দেয়নি।

বার-টেইলড গডউইট হল এমন উপকূলীয় পাখি যাদের ঠোঁট অনেক লম্বা। গ্রীষ্মকালে এরা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে বাস করে। উপপ্রজাতি ভেদে এই প্রজাতির পাখিরা বিভিন্ন ঋতুতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে থাকে। তবে যে পাখিরা গ্রীষ্মকাল কাটায় আলাস্কায় তারা শরৎ ও শীত সবসময়ই নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে কাটায়।

প্রতিবছর এই পাখিরা যে পরিবেশগত করিডোরটি পাড়ি দেয় তার নাম ইস্ট এশিয়ান-অস্ট্র্যাল্যাশিয়ান ফ্লাইওয়ে। এই পাখিদের এমন কিছু অনন্য শারীরিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলি তাদেরকে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করে।

গ্লোবাল ফ্লাইওয়ে নেটওয়ার্কের জেসি কনক্লিন দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, “তাদের দেহে অবিরাম শক্তি উৎপাদনের এক অভাবনীয় দক্ষতা রয়েছে। তাদের দেহের কাঠামো একটি জেট ফাইটার বিমানের মতো। লম্বা, চোখা ডানা এবং এর নিখুঁত ডিজাইন তাদেরকে আকাশে ওড়ার ক্ষেত্রে প্রচুর সুবিধা দেয়।”

জেসি কনক্লিন সিটিভি নিউজকে বলেন, ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর আমাদের এই নতুন রেকর্ড গড়া পাখিটি আলাস্কা ছেড়ে যায়। শনাক্তকরণের জন্য পাখিটির পায়ে রঙিন ট্যাগ (নীল, নীল, লাল এবং সাদা) লাগানোর পরে এর নাম দেয়া হয় 4BBRW। পাখিটি আরো কয়েকটি বার-টেইলড গডউইটের একটি গ্রুপের সদস্য ছিল যাদেরকে গ্লোবাল ফ্লাইওয়ে নেটওয়ার্ক (জিএফএন) দ্বারা ট্র্যাক করা হচ্ছিল। জিএফএন হল বিশ্বব্যাপী গবেষকদের একটি সংগঠন যারা পাখিদের বিশ্বভ্রমণের ওপর নজর রাখে।

অন্যান্য পাখিরা যে রুট ধরে দক্ষিণে যাচ্ছিল সেই একই রুট ধরেই 4BBRW পাখিটিও উড়ছিল, কিন্তু সে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে গিয়ে একটু মোচড় নিয়েছিল। যে কারণে তাকে অন্য পাখিদের চেয়ে কিছুটা বেশি পথ উড়তে হয়েছিল।

সিটিভি নিউজ.সিএ-কে পাঠানো এক ইমেইলে কনক্লিন জানান, 4BBRW পাখিটির এই রেকর্ডগড়া যাত্রা শেষ হতে ৯ দিনেরও বেশি সময় লেগেছে। টানা ৯.৩৩ দিন ধরে আকাশে উড়েছিল পাখিটি।

জিএফএন-এর ওয়েবসাইটে ট্যাগ লাগানো পাখিদেরকে রিয়েল-টাইমে ট্র্যাক করা সম্ভব বা পেছনে ফিরে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পাখির উড়ান দেখতে পাওয়া সম্ভব। কনক্লিনের মতে, এই নির্দিষ্ট ট্র্যাকিং প্রকল্পটির জন্য অর্থের যোগান দিয়েছে টি-গিয়ার ফাউন্ডেশন থ্রো বার্ডস কানাডা। ফলে “কানাডা এই প্রকল্পের ফলাফলগুলির কিছুটা মালিকানা নিতে পারে!”

১৮ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর-এর মধ্যে 4BBRW-কে জুম করে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে তাঁর যাত্রার জিগজ্যাগিং দেখতে পাওয়া যায়। ওয়েবসাইট অনুসারে, পাখিটি এই সময়টিতে প্রায় ১২,৯০০ কিলোমিটার উড়েছিল। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, রাউন্ডিং এরর বাদ দিলে সম্ভবত এটি প্রায় ১২,২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে।

২৬ সেপ্টেম্বর জিএফএন টুইট করে জানায় যে, 4BBRW “নিউজিল্যান্ডের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে।”

তারা আরো জানায় যে, “সে এমনভাবে বাতাসে উড়ছে যা দেখে মনে হয় যেন এই উড়াল পথের জন্যই তাকে তৈরি করা হয়েছে।” এই সময় তার স্থলগতি ছিল প্রতি ঘণ্টায় ৮০-৯০ কিলোমিটার অবধি আর পেছন দিক থেকে ধেয়ে আসা বাতাসের গতি ছিল ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার।

কোনো পাখির একটানা সর্বোচ্চ পথ পাড়ি দেয়ার আগের রেকর্ডটি গড়েছিল E7 নামকরণকৃত একটি নারী বার-টেইলড গডউইট পাখি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর তথ্যমতে, ২০০৭ সালে আলাস্কা থেকে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত ১১, ৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ উড়েছিল পাখিটি। এবং এতে সেই পাখিটির সময় লেগেছিল ৯ দিন। সেবারই প্রথম গবেষকরা ওই পাখিদের নিয়মিতভাবে এত লম্বা পথ পাড়ি দেয়ার বিষয়টি আবিষ্কার করেন। এর আগে বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না যে, সমুদ্র উপকূলীয় এই পাখিগুলি প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে একটানা এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারে।

4BBRW এবং তার সঙ্গীরা এখন নিউজিল্যান্ডের পুকোরোকোরো মিরান্ডাতে অবস্থান করছে। মূলত সেখানকার উপকূলীয় পাখি কেন্দ্রেই তাদের শরীরে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার ট্যাগ লাগানো হয়েছিল।

পাখিদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ওই কেন্দ্রের এক বিজ্ঞপ্তিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, শুধুমাত্র 4BBRW-ই নয় আরেকটি পাখিও নতুন রেকর্ড গড়েছে। 4BWWY নামকরণকৃত আরেকটি পাখি অস্ট্রেলিয়ার দিকে চলে যাচ্ছিল। পরে ভুল বুঝতে পেরে সে আবার নিউজিল্যান্ডের দিকে উড়ে আসে।

এর ফলে তাকে প্রায় ১১,৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। 4BWWY নামকরণকৃত ওই পাখিটি একটানা প্রায় ২৩০ ঘণ্টা আকাশে উড়েছিল।