গত আলাপটি ‘ঐতিহ্যে’র বিলুপ্তি নিয়ে করবার কারণে ঐতিহ্য-সংরক্ষণ বিষয়ে পরের আলোচনাটি করবার একটা দায়িত্ব আমি বোধ করেছি। ফলে এই আলাপটি কীভাবে ‘ঐতিহ্য’ সংরক্ষিতও হতে পারে সে বিষয়ে সাব্যস্ত। গত আলোচনাটি খাদ্যবস্তু নিয়ে হবার কারণে এটিও তাই নিয়েই করছি। আর এবারে আমি দ্বিধাহীনভাবে একটি খাদ্যবস্তুকেই নির্বাচন করছি — ঝালমুড়ি।

ঝালমুড়িকে ঐতিহ্যের মর্যাদা দিতে অনেকেরই প্রাণে বাধতে পারে। তবে সাহিত্য ও সমাজস্মৃতিতে এর যে প্রভাব তাতে সত্যিই হারিয়ে গেলে তা ঐতিহ্যসম বলে মনে হতে পারত। অন্তত মধ্যবিত্ত পাঠকদের তো বটেই। তাছাড়া, আমরা ঝালমুড়ি দিয়ে বৃহৎ ও গ্রহণযোগ্য ‘ঐতিহ্য’-সংরক্ষণও বুঝে ফেলবার একটা সম্ভাবনা রাখি। যাহোক, সংরক্ষণের একটা সহজ-সরল উপায় হলো তা কোথাও ভরে ফেলা, বা ভরে দেয়া। যাঁদের ধ্বনিপ্রীতি আছে তাঁরা প্রায়শই ভরে-দেয়াকে সান্ধিয়ে বা হান্দায়ে-দেয়া হিসেবে উচ্চারণ করে মাত্রাবৃদ্ধি ঘটিয়ে থাকেন। বয়াম বা ইত্যাদি তো হতেই পারে, তবে শুকনা খাদ্যবস্তুর ক্ষেত্রে সেক্ষেত্রে অনায়াসেই প্লাস্টিক-পলিথিন মোড়কে ভরে-ফেলা যায়। (জাদুঘর বা ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাচের জারে বা বাক্সে ভরে-ফেলতে হয়)।

অনেকেই যখন চিন্তিত হয়ে উঠছিলেন ঝালমুড়ি বুঝি বা হারিয়ে গেল, বাস্তবে তা কিন্তু গেল না। অনেকের এমত চিন্তার বাস্তব ভিত্তি ছিল। এমনকি করোনার আগেও রাস্তাঘাটে ফিরিওয়ালার উপস্থিতি খেদিয়ে-খেদিয়ে কমানো হচ্ছিল। ঝালমুড়ি সততই ফিরিওয়ালা-নির্ভর খাদ্য (বা ঐতিহ্য) ছিল। সিভিল এই খেদানির মধ্যে ঝালমুড়ি যাতে অবলুপ্ত না হয় সেজন্য এগিয়ে এলেন সার ও কীটনাশক প্রস্তুতকারী কোম্পানি, প্ল্যাস্টিক কোম্পানি, এমনকি ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি। তাঁরা যেটা করলেন, পলিথিনের মোড়কে ঐতিহ্যবাহী ঝালমুড়িকে ভরে ফেললেন। বড় বড় মোড়কে দ্রব্যাদি ভরবার দীর্ঘকালের অনুশীলন থাকার কারণে, আন্দাজ করা যায়, ঝালমুড়ির অপেক্ষাকৃত ছোট মোড়ক তাঁদের জন্য অনায়াস এন্টারপ্রাইজ ছিল।

এখন বাস্তবে ঝালমুড়ি আর অবলুপ্ত হয়নি। অন্তত নিকট ভবিষ্যতে এই খাদ্যদ্রব্যটির অবলোপের সম্ভাবনাও তিরোহিত হয়েছে। ঐতিহ্য-সংরক্ষিত হবার এই আনন্দময় ফলাফলটিতে কেবল খুশি না-হয়ে, এবং দোকান থেকে প্যাকেট-প্যাকেট ঝালমুড়ি না-খেয়ে, আমাদের আরও কিছুটা পর্যালোচনা করতে পারা উপকারী হবে। এই যে একটা ঐতিহ্য প্রায় উধাও হবার যোগাড় হচ্ছিল, সেটাকে উধাও না-হতে-দেবার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন পড়ল। বাস্তবেই তাই পড়ে। এখানে কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে ব্যবস্থাপনাতে দক্ষ হিসাবে। কিংবা দক্ষযজ্ঞ সামলানোর যোগ্য হিসাবে। আরও আছে! সার-কীটনাশক প্রস্তুতকারী যে তাঁর কাঁড়ি কাঁড়ি মজুদ থেকে সার বা কীটনাশকই ছোট মোড়কে ভরে দিচ্ছেন না; বরং দিচ্ছেন নতুন আয়োজন করে মুড়িই, সেটাকে তাঁদের মহত্ত্ব হিসাবেও দেখতে পারা দরকার। সংরক্ষণের তাগিদ গূঢ় মহৎভাব থেকে জাগ্রত হয়ে থাকে। আর তা বড়দের পক্ষেই সম্ভব, তাঁদেরই কৃতকাজ।

ধরুন ওই বাখরখানিওয়ালা কারিগর কিংবা চুলাওয়ালা মালিক! তাঁরা যথাক্রমে ভবনের সালামদানকারী দারোয়ান আর মুদিখানার দোকানদার হলেন। আমরা সবাই গিয়ে তাঁদের সামনে মিছিল-মিটিং করলে, কিংবা হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করলেও, তাঁরা পুনর্বার বাখরখানির চুলা জ্বালাতে পারতেন না। কোনো একদিন পহেলা বৈশাখের সকালে বাখরখানি-কারিগরের ছেলেমেয়ে আব্দার করবে যে তাদের বাবা (বিশেষ ক্ষেত্রে যদি মা-ও বাখরখানির কারিগর হন, তাহলে মা-ও) যেন বাখরখানি বানিয়ে খাওয়ায়—সেই সম্ভাবনাও অতি ক্ষীণ। আর তারা যদি সত্যিই আব্দার করে বসে, তিনি কিছুতেই বাখরখানি বানানো শুরু করতে পারবেন না। ওটার পুরাদস্তুর একটা আয়োজন আছে, পানিতে সুজি আর চিনি দিয়ে জ্বালিয়ে ফেলে বানানো যায় না। ঝালমুড়ির বিষয়টা কিছু ভিন্ন হলেও, সন্তানের আব্দারে ঝালমুড়ি বিক্রেতা যদি বাসায় বানিয়ে খাওয়ানও, তা ঠিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ হতো না। ফলে, বোঝাই যাচ্ছে, এখানে উদ্যোক্তাদের চরিত্র-ব্যক্তিত্ব-সামর্থ্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

ইতিহাসে ঝালমুড়ি হয়তো ততটা শক্তিশালী নায়ক নয়। কিন্তু সংরক্ষিত ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ তালিকা পাওয়া সম্ভব যা সকলই কোনো-না-কোনো ভাবে শক্তিশালী সংরক্ষকের কল্যাণে অবলুপ্ত হওয়া-থেকে রক্ষা পেয়েছে। ঐতিহ্যের সংরক্ষণ আর ঐতিহ্যবাহী মানুষের সংরক্ষণ কিন্তু কিছুতেই এক কথা নয়। বরং, মহৎ ও শক্তিমানেরা নিরিখ করে টার্গেট করেন ঐতিহ্যটাকেই। আর তা সংরক্ষিত হয়ে পড়ে; অন্তত কখনো কখনো।

একবার কেবল একটা কুকুরকেও টার্গেট করতে দেখা গেছে। সংরক্ষিত মোড়ক-ঝালমুড়ির বিজ্ঞাপনে, টেলিভিশনে, খুন্তি দিয়ে একটা কুকুরকে তাড়া করতে দেখা যায় রাস্তার পাশের ‘ঐতিহ্যবাহী’ ঝালমুড়ির নির্মাতা-বিক্রেতাকে। কুকুরকে টার্গেটকরণ আসলে একটা কাঠামোগত উদ্যোগ। ওটা কুকুর-সংরক্ষণের তাগিদে ছিল না। কুকুরের হাত থেকে ঝালমুড়ির স্বাস্থ্যসম্মত দূরত্ব বজায় রাখার একটা চিত্রকল্প হাজির করা হয়েছিল যাতে মোড়ক-ঝালমুড়ির গুরুত্ব ক্রেতাকুল বুঝতে পারেন।

(আমাকে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিলেন মধ্যবিত্তদের এই রাজশাহীর আম, যশোরের গুড়, পাবনার লুঙ্গি বিক্রি করাকে আমি কীভাবে দেখি; কিংবা করোনাকালে এমনকি আরো আরো দ্রব্যাদি বিক্রিকেও। আমি আর কীভাবে দেখব! মধ্যবিত্ত মানুষজনের ঐতিহ্যপ্রীতি হিসাবেই তো দেখা উচিত! এমনকি দেশপ্রেম হিসাবেও দেখা যেতে পারে।)

আদাবর, ১০ আগস্ট ২০২০