‘সর্বতো মঙ্গল রাধে’ গানের পরে হৈচৈ বেঁধে গেলে আসলেই অশান্তি হয়েছিল। আমার মতো ঘর থেকে বের না-হবার শত রকমের বাহানা-জানা লোকেও সেই অশান্তির পরিবেশ থেকে পুরোটা রক্ষা পায়নি। চঞ্চল আর শাওন গেয়ে কতটা শান্তি পেয়েছিলেন জানা যায় না, কিন্তু তামাম মিডিয়াসেবী মানুষের বড় একটা অংশ কোস্তাকুস্তি করে কয়েকটা সপ্তাহ পাগলপারা হয়ে গেছিলেন।

ঠিক একই ভাবে ডাক্তারগণ ‘আইলারে নয়া দামান/জামাই’ নেচেগেয়ে করোনাসেবকদের কতটা উদ্দীপ্ত করেছিলেন তা সঠিক জানা না-গেলেও গীতবাদ্যসেবকদের বিরাট অংশের ব্যাপক লড়াইঝগড়া উপলক্ষ তৈরি করতে পেরেছিলেন। আমার মনে হয় না যে দুই পার্ফর্ম্যান্সেরই লোকজনের কিছুমাত্র ধারণা ছিল পরে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে। সেই হিসাবে যাসব আলাপ-আলোচনা হয়েছে তা সেসব দিলখুশ পার্ফর্মারদের জন্য হতভম্বতা এনে থাকতে পারে। সেসব বিষয়ে আপনারা খোঁজ-খবর নিতে পারেন; তবে আমার জানা নাই। এই মুহূর্তে আসলে আগ্রহও নাই।

ফোকগান বিষয়ক সাইবারের হৈচৈয়ের মধ্যে কপিরাইট বিষয়ক আলাপ একটা প্রধান বিষয় হয়ে গেছিল। কপিরাইট অত্যন্ত দুর্বোধ্য একটা বিষয়। এত দুর্বোধ্য যে অনেকক্ষণ এ বিষয়ে বক্তৃতা শোনার পরও তেমন কাজের কিছু একটা বোঝা যায় না। এটা অনেকটা ধরুন অরণ্যচারী মানুষজনকে গিয়ে জমির দলিলের গুরুত্ব বিষয়ে বোঝানোর মত একটা পরিস্থিতি। বাস্তবেও ঠিক তাই ঘটেছে মুণ্ডা কিংবা সাঁওতাল, মারমা কিংবা তনচাঙ্গ্যা, চাকমা কিংবা মান্দি জাতির লোকজনের সঙ্গে। যাকগে এসবই আপনারা জানেন, মনে না রাখতে চাইলে তো বার বার ভ্যাজর ভ্যাজর করার কোনো মানে নাই। তবে কপিরাইটের বিষয়ে এই গল্পটা আপনাদের না শোনালেই চলছে না।

আমার একজন অগ্রজ-বান্ধব তামাক কোম্পানির বিশাল বড় কর্মকর্তা তখন। সম্ভবত ১৯৯৯র দিকে। তো তিনি একটা সেমি-অফিসিয়াল নাকি ব্যক্তিগত সফরে গেছিলেন যশোর না যেন কোথায়। তখন গোল্ডলিফ সিগারেট সবচেয়ে জনপ্রিয় কিংবা সবচেয়ে বেশি আয়কারী ব্র্যান্ড সেই কোম্পানির। বা মোটামুটি এরকম কিছু একটা। আমি নিজেও তখন গোল্ডলিফ খাই। কিন্তু আমি খাই বলে তিনি গল্প করেন নাই। সম্ভবত, আমার সিগারেট ব্র্যান্ড তিনি জানতেন না, বা লক্ষ্য করেননি। তারপর যশোর থেকে সন্দেশ-টন্দেশ নিয়ে এসেছিলেনও বোধহয়। আমিও ভাগ পেয়েছিলাম। তিনি গল্প-বলিয়ে হিসাবে দুর্দান্ত। তাঁর বলবার গুণ আমাকে পিটানি দিলেও আনতে পারব না। কেবল ঘটনাটাই পারব।

ফিরে এসে বললেন যশোরে রাস্তার পাশে গোল্ডলিফ ব্র্যান্ডের জিনিসপাতি দেখে তার মাথা নষ্ট! মানে নকল ব্র্যান্ডিং বলতে পারেন। রাস্তার পাশে তিনি যে সিগারেট দেখতে পান নাই তা বলার মধ্যেই লুক্কায়িত ছিল। আবার জিনিসপাতি তিনি নিজে না বলে আমাকে গেইস করতে বললেন। সম্ভবত আমি পেরেছিলাম, কারণ বস্তুটা অন্যত্র আমার চোখেও পড়েছিল। পুরুষ প্যান্টপরিয়ে জাতির অন্তর্বাস বিক্রি হচ্ছিল রাস্তার পাশে গোল্ডলিফ নামে। স্থানীয় ও অস্থানীয় ভাষায় যাকে জাঙ্গিয়া বলা হয়ে থাকে। কেবল গোল্ডলিফ নামে বিক্রিই হচ্ছিল না কেবল, উপরন্তু সিগারেটের খোসার গায়ে যে হরফমালা তার অবিকল চেহারায় হরফছাপা ছিল। তখনকার যুগে স্মার্টফোন থাকলে আমি এখন নিশ্চিত যে তিনি খানকয় ছবিও তুলে আনতেন।

জাঙ্গিয়ার নাম অন্য আর পাঁচটা বস্তুর মতোই আকস্মিক। (পিটার বিকসেলের টেবিল হলো টেবিলের মতোই।) মানে কিনা জাঙ্গিয়ার নাম যে চিচিঙ্গা নয়, কিংবা বাঙ্গি নয়; কিংবা বাঙ্গির নাম যে ঢেঁড়শ নয়, কিংবা চামচিকা সেগুলোর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ বা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। সেজন্য ঢেঁড়শ, চামচিকা কিংবা বাঙ্গির মতোই জাঙ্গিয়ারও নির্দোষ নিরপেক্ষ উচ্চারিত হতে পারার অধিকার আছে। তবে জগতে সকল অধিকার ওভাবে সুনিশ্চিত থাকে না। বরং, কিছু কিছু নাম উচ্চারণের আগে থেকেই হাস্যরস তামাশাঠাট্টা লজ্জাশরম ইত্যাদি জগতের মধ্যে বিরাজ করে, উচ্চারণের সময়েও করে; এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই উচ্চারণ ও আলাপের পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত ওইসব জগতে থেকে থাকতে থাকে। এরও ন্যায্য কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে সিদ্ধ করা মুস্কিল। যেমন, ওইদিনটাতেও আমি বা আমার সেই অগ্রজ বান্ধব বেশতক সময়ে হাসাহাসির মধ্য দিয়ে এই গল্পটা শুনছিলাম। আমি পরিষ্কার আন্দাজ করেছিলাম। তারপরও তাঁর কাছ থেকেই নিশ্চিত হওয়া গেল যে রাস্তার পাশে গোল্ডলিফ জাঙ্গিয়াগুলোকে তিনি আইনের দরবারে ঠেলে দেননি। বরং ঝুড়ি বা মাদুরের উপর বিছানো নিরীহ ক্ষুদ্রাকার বস্তুগুলো তামাক কোম্পানির বড়কর্তার স্নেহধন্য হয়ে থেকে যেতে পারল।

এই যে সসম্মানে বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত লজ্জামূলক জাঙ্গিয়াবৃন্দ; এর থেকে কী বুঝলেন আপনারা? আপনারা যদি ভেবে থাকেন যে লজ্জাশরমের কারণেই আইনি মোকদ্দমার মধ্যে তামাক কোম্পানি যান নাই সেটা নিছক ভুল ভাবলেন আপনারা বা ভাববেন যদি সেরকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। কিংবা যদি ভেবে থাকেন এরকম তুচ্ছ ক্ষুদ্রাকার, এমনকি সাধারণ চোখে দেখাও যায় না (মাইকেল জ্যাকসনেরটা ছাড়া) এমন বস্তু এর অস্তিত্বগুণের কারণে মোকদ্দমামুক্ত থাকতে পেরেছে তাতেও আপনাদের ভাবনার তারিফ করতে পারছি না। জাঙ্গিয়া না হয়ে যদি গোল্ডলিফ গরুর গাড়িও যশোর বা গাইবান্ধাতে বানানো হতো তাতেও মোকদ্দমা হতো বলে মনে হয় না; যদিও জাঙ্গিয়ার তুলনায় গরুর গাড়ি অনেক বড়। আরেকটু ভাবুন। তাহলে আপনারা বুঝতে পারবেন যে, জাঙ্গিয়া গোল্ডলিফ যে সিগারেট গোল্ডলিফের বাজার খাচ্ছে না, তার স্বার্থের ক্ষতি করছে না এটাই এখানে মুখ্য বিষয় মোকদ্দমামুক্ত থাকতে পারার। স্বার্থের ব্যাপারটা বুঝলেন তো কপিরাইট বলেন ফোকের মালিকানা বলেন আর জাঙ্গিয়ার গোল্ডলিফিয় অস্তিত্ব বলুন সব প্রায় পৌনে একভাগ বুঝে গেছেন আপনারা। বাকিটুকুর জন্য আর বেশি কসরৎ করতে হবে বলে আমার মনে হয় না।

স্বার্থ নিয়ে টানাটানি না হলে মালিকানার বিষয়ে আর কীইবা আছে? এখন ফোকের মালিকানা নিয়ে স্বার্থ বিষয়ক টানাটানি করবেন কে? আমরা চাইলে অবশ্যই আলোচ্য দুই গানের সঙ্গে জড়িত অমুক তমুক গানের ব্যান্ড, অমুক তমুক শিল্পী, ইউটিউবার প্রমুখের নামধাম বলে একটা শোরগোল লাগাতেই পারি। আমরা সেটা করব না। কারণ, আমাদের আজকের স্বার্থ সেটা নয়। এই কাজগুলো কমবেশি আব্বাসউদ্দিন আহমেদ, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অমল পাল কিংবা শচীন দেব বর্মণদের সময়কাল থেকেই হয়ে আসছে।

খেয়াল করুন যে আমরা কিন্তু ঘুরেফিরে সেসব লোকজনেরই নাম আনলাম যাঁরা স্বকণ্ঠমহিমা, ও অবশ্যই কলের গানের বাজারের দোয়ায়, তারকা হয়ে পড়েছিলেন। আমরা অতারকাদের নাম তো আনলামই না, এমনকি ওই রেকর্ডের চাকতিগুলোতে গীতিকার-সুরকার নামগুলো কাদের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছিল তাঁদের নামও টানলাম না। কারণ আমাদের তা মুখস্থ নাই, তাঁরা তারকাও নহেন। তাইলে তারকাপ্রথা বা খ্যাতি স্বার্থের আরেকটা দিক হিসাবে সহজেই দেখা যাচ্ছে।

আবারো জিগাই চলুন, ফোকের মালিকানা নিয়ে কে ভাববেন? আপনি দেড়শ বছর আগে মুণ্ডা জাতির বা সাঁওতাল জাতির লোকজনের কাছে গিয়ে বললেন “এই দেখো আমার জমি, আমার দলিল, তোমার জঙ্গল এখন আমার আমার!” এসব শুনে ওই বেচারাদের তো আকাশ থেকে পড়ার যোগাড়। কারণটা এই নয় যে তাঁদের শিক্ষার ভারি অভাব, আর নিজের “অধিকার” বিষয়ে তাঁরা অচেতন। কারণটা হলো তাঁদের সঙ্গে জঙ্গলের শয়ে শয়ে বছর ধরে যে সম্পর্ক তাতে দলিল দস্তাবেজ দিয়ে নিজের-নিজের বানিয়ে নেবার প্রসঙ্গই দেখা দিয়েছিল না। আপনাদের বুজরুকি বুঝতে-বুঝতেই তাঁর জঙ্গল সাফ হয়ে গিয়েছে। অধুনা বছরগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নানাবিধ বন, কিংবা মান্দিদের শালবন কিংবা খাসিদের এলাকায় ইকোপার্ক এসব নিয়ে তো কথাই বলব না। পাগল নাকি! কিন্তু না বলব বলে না বুঝে থাকতে হচ্ছে না আপনাদের। ঠিক একই ভাবে কাঁথা বলেন বা পিঠা, গান বলেন বা মিঠা এসবের মালিকানার প্রসঙ্গ আসবে তখনই যখন সেখানে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বানানো যাবে, নিদেন পক্ষে গাদা গাদা খ্যাতিযশ বানানো যাবে।

লোকজ সুরের প্রসঙ্গ এমনিতেই মেলা পেঁচানো জিনিস। আসলে তামাম সুরের জগতই। আমি সুরে পাকা লোক না। কিন্তু তাই বলে তা নিয়ে কথা বলতে পারব না সেরকম কম মনের জোর আমার নাই। বরং বলেছি আগেও, দরকার মতো আবার বলব; তবে আজ সেটা মুলতবি। যদি আমরা লোকজ গানের বাণীর দিকেও একটু তাকাই, দেখা যাবে নানান গাইয়ে নানান পদে নানান বাণীতে একই কিসসা বা গীত পরিবেশন করে আসছিলেন শয়ে শয়ে বছর। যখন সকলের মালিকানা, এজমালি, তখন সেটা অতিশয় আকর্ষণীয়। যখন মুণ্ডাজঙ্গল দখল করতে যাবার মতো আপনাদের হাতে পড়ল সেই বাণীমালা, তখন সেটা যারপরনাই কুৎসিত স্বার্থের বিষয়বস্তু হয়ে পড়ছে। তখন আপনি কী করেন, আমরা জানি। আপনি কলসের জায়গায় ঢেঁড়শ, কিংবা রাধার জায়গায় গাধা বসিয়ে বাণীগুলো আপনার ‘মালিকানা’য় নিয়ে নেন। তারপর কপিরাইট দোকানে গিয়ে সেটাতে আপনার আর আপনার চাচাতো ভাই বা পুরা গুষ্টির, ব্যান্ডের, নাম বসায়ে নেন। এরপর কোনো লোকের পক্ষে আর লোকশিল্পের মালিকানা নিয়ে কথা বলার উপায় কি থাকল? বরং আপনি ওটুকু বাণীবদল যে করেন তাতেই আপনার বিনয়ে তামাম লোকজাতি ধন্য। এরপর দেশে ৪০টা ফোকলোর ডিপার্টমেন্ট খোলেন আর লোকলোর বলে ডাকেন সেগুলোকে আলিবাবার ৪০ চোরের মতোই ভূমিকা হতে বাধ্য তাদের। পুরাই ফুক-ফ্যান্টাসি!

আদাবর, ৩ জুন ২০২১
কভারে মানস চৌধুরী; ছবি. ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা, ২০১৯