ইতিহাস জুড়ে মানুষ বয়স কমানো, শক্তি বাড়ানো বা আয়ু বাড়ানোর নানা ওষুধ, টনিক আর প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে কত যে ধোঁকা খেয়েছে, তার হিসাব নেই। তবে এসব ঢাকঢোলের মাঝেও কিছু সত্যি কথা টিকে আছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালে, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস বলেছিলেন, “হাঁটা মানুষের জন্য সবচেয়ে সেরা ওষুধ।” দুই হাজার বছর পেরিয়ে এসে আজ বিজ্ঞান সেই কথাকেই প্রমাণ করতে পেরেছে।
যারা দিনে ৮,০০০ পদক্ষেপ বা তার বেশি হাঁটেন, তাদের অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক কমে যায়। বিশেষ করে, যারা দিনে ৫,০০০ পদক্ষেপের কম হাঁটেন—যা অলস জীবনযাপনের চিহ্ন—তাদের তুলনায় এই ঝুঁকি প্রায় অর্ধেক কমে যায়। তবে ৮,০০০ পদক্ষেপের পর উপকার কমতে শুরু করে, যা বহু প্রচলিত ১০,০০০ পদক্ষেপের লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
থমাস ই. ইয়েটস
দি কনভারসেশন, মে ১৫, ২০২৫
আসলে ১০,০০০ পদক্ষেপের এই ধারণার পেছনে বিজ্ঞান নয়, ছিল বিজ্ঞাপন। ১৯৬০-এর দশকে জাপানে তৈরি হয় বিশ্বের প্রথম পদক্ষেপ গণনার যন্ত্র ‘মানপো-কেই’, যার মানে—“১০,০০০ পদক্ষেপ মিটার।” সেখান থেকেই শুরু এই সংখ্যার যাত্রা।
এই নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলি বলছে, একটা প্রশ্ন খুব জরুরি হয়ে উঠেছে—সব পদক্ষেপ কি সমান কাজ দেয়, নাকি জোরে হাঁটা—প্রতি মিনিটে ১০০ পদক্ষেপ, মানে ঘণ্টায় তিন-চার মাইল—আরও বেশি উপকারে আসে?
বয়স ও হার্টের স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে দেখলে, এখন প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে গতি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন ১৪ মিনিট ধীরে হাঁটার বদলে যদি কেউ ৭ মিনিট জোরে হাঁটে, তাহলে তার হার্টের রোগের ঝুঁকি প্রায় ১৪% কমে যেতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ৪.৫ লাখেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্কের ওপর করা এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জিনগত বয়স মাপার একটা পদ্ধতি দিয়ে বোঝা গেছে—যারা জীবনে সবসময় জোরে হাঁটেন, মাঝবয়সে তাদের দেহগত বা জৈব বয়স (Biological Age) ধীরে হাঁটাদের তুলনায় ১৬ বছর পর্যন্ত কম হতে পারে।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন মাত্র ১০ মিনিটের জোরে হাঁটা (brisk walking) ৬০ বছরের বেশি বয়সী নিষ্ক্রিয় নারী ও পুরুষদের জন্য গড়ে এক বছর বা তার বেশি আয়ু বৃদ্ধি করতে পারে।
জোরে হাঁটার একটা বড় শক্তি হল—এটা ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য কেমন হবে, তার ধারণাও দিতে পারে। কেউ কতটা দ্রুত হাঁটে, সেটা দেখে তার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি রক্তচাপ বা কোলেস্টেরলের থেকেও ভালভাবে বোঝা যায়। এমনকি খাদ্যাভ্যাস, স্থূলতা বা মোট ব্যায়ামের তুলনায়ও এটা অনেক ভাল সূচক।
একজন ডাক্তার তার রোগীকে যদি শুধু এই প্রশ্নটাই করেন: “অন্যদের তুলনায় আপনি কতটা জোরে হাঁটেন?”, সেটাই হতে পারে সবচেয়ে কাজে লাগার মতো প্রশ্ন।

হাঁটার আশপাশের ভাল দিকগুলি
তবে সবসময়ই জোরে হাঁটা অতিরিক্ত উপকার দেয় এমন নয়। যেমন, ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে হালকা হাঁটার চেয়ে জোরে হাঁটা কতটা বাড়তি উপকার দেয়, তা এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে মোট যত বেশি হাঁটা যায়, ১৩ ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি ততটা কমে। তবে সেই গবেষণায় জোরে হাঁটার বাড়তি কোনো উপকার পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি, যারা দীর্ঘক্ষণ একটানা বসে থাকেন, তাদের জন্য মাঝেমাঝে উঠে হালকা হাঁটা বা ঘরের ভেতরে পায়চারি করাও শরীরের বিপাক ক্রিয়ার (metabolism) ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।”
সবচেয়ে মজার বিষয় হল, হাঁটার উপকার শুধু শরীরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না—এটা মাথার কাজেও লাগে। হাঁটলে মস্তিষ্কের চিন্তা-ভাবনার অংশগুলি খুব ভালভাবে কাজ করে, আর সৃষ্টিশীল চিন্তার হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। স্মৃতি আর কল্পনার জন্য মস্তিষ্কের যে অংশগুলি কাজ করে, হাঁটার সময় ঠিক সেই অংশগুলিই সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আমরা অনেকেই হয়ত নিজের অজান্তে এটা কাজে লাগাই—হেঁটে হেঁটে ভাবি, সমস্যার সমাধান খুঁজি, যা চুপচাপ বসে কখনও মাথায় আসত না। বিশেষ করে প্রকৃতির মধ্যে হাঁটার সময় মন ভাল হয়ে যায়, মাথাও পরিষ্কার থাকে—এটা অনেক গবেষণায় উঠে এসেছে।
এই কারণেই এখন “নেচার প্রেসক্রিপশন” নামে একটা ধারণা চালু হয়েছে, যেখানে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষদের প্রকৃতির মধ্যে হাঁটার উপদেশ দেওয়া হয়—আর এতে সত্যিই ভাল ফল মিলছে।
আজকের দিনে শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা আমাদের সমাজে ডায়াবেটিস আর হার্টের রোগের মত অসুখের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর ৩.৯ মিলিয়ন মানুষের অকালে মৃত্যু রোধ করা যেত যদি সবাই একটু বেশি নড়াচড়া করত।
কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা রোগ প্রতিরোধে না, বরং মানুষ অসুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় মন দেয়। গড়ে একটি নতুন ওষুধ বাজারে আনতে এক বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। অথচ, এরপরও সেই ওষুধগুলি বিশাল মুনাফা এনে দেয়, যা বোঝায়—এই গোটা স্বাস্থ্যখাত কী বিশাল এক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
এই বিপুল টাকার সামান্য অংশ যদি মানুষকে হাঁটায় উৎসাহ দিতে বা শারীরিকভাবে সক্রিয় রাখতে ব্যবহার করা হত, তাহলে আমাদের এত চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হত না।
সংক্ষেপে, যদি দীর্ঘজীবনের রহস্য খুঁজে থাকেন, তাহলে আপনার পায়ের দিকে তাকান। হয়ত সেখানেই সবচেয়ে সহজ উত্তরটা লুকিয়ে আছে।
কেন হাঁটাই হতে পারে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের সহজ চাবিকাঠি?